Thursday, March 21, 2019

প্রবন্ধ


অনালোকিত উলুপী
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

ভারতবর্ষের দুই মহাকাব্যের অন্যতম হল মহাভারত যেখানে রয়েছে অসংখ্য রত্নমাণিক নানাবিধ ঘটনার পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য উজ্জ্বল চরিত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে এখানে পুরুষ প্রাধান্য চোখে পড়লেও নারীরা যে পুরোপুরি উপেক্ষিত কিংবা অবহেলিত ছিলেন এমনটা নয় মহাভারতের বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে বেশকিছু বর্ণময় নারী চরিত্র এদের মধ্যে কুন্তী, গান্ধারী, দ্রৌপদী প্রমুখ নারী চরিত্রগুলো অনেক বেশি আলোচিত কিন্তু এরা বাদেও আরও অসংখ্য নারী চরিত্র রয়েছে যারা সেভাবে আলোকিত হননি, অথচ মহাকাব্যিক ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় যাদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তেমনি এক অনালোকিত নারী চরিত্র হল উলুপী মহাভারতের পাতায় উলুপীর উপস্থিতি খুবই সামান্য কিন্তু এর ঘটনা প্রবাহে তার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে
    উলুপী কে? নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা উলুপী এবং তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের স্ত্রী অর্জুনের জীবনে প্রথম নারী উলুপী—একথা বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না। যদিও উলুপীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পূর্বে দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অর্জুনের, কিন্তু শুধু মাল্যদানই হয়েছিল, স্ত্রী হিসেবে তাকে কাছে পাননি। নিয়ম আর শর্তের যাঁতাকলে পড়ে দ্রৌপদীকে কাছে পাওয়ার আগেই অর্জুনকে ব্রহ্মচারীর ব্রত নিয়ে বারো বছরের জন্য বনবাসী হতে হয়েছিল। উলুপীকেই তিনি প্রথম আপন করে পেয়েছিলেন স্ত্রী হিসেবে। অর্জুনের প্রথম সন্তানের জন্ম হয় উলুপীর গর্ভে। যাই হোক, যুগে যুগে আমরা অনেক মহান প্রেমের কাহিনি পড়েছি অর্জুন-উলুপীর প্রেম পর্য্যালোচনা করলে দেখা যাবে মহত্বের এক উচ্চ শিখরে তার অবস্থান যদিও উলুপীর জীবনে অর্জুনের উপস্থিতি খুব সামান্য, তবুও আমরা দেখতে পাবো, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উলুপী এমন এক নারী চরিত্র, যিনি আপন কর্তৃত্ব ও মহিমায় অর্জুনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অর্জুনের মতো এমন এক বীরকে তার ব্রহ্মচার্যের ব্রত ভাঙিয়েছেন, তার কামনার আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য করেছেন শুধু তাই নয়, পুত্রের হাতে নিহত অর্জুনকে তিনিই জীবনদান করেছিলেন এবং তাকে নরক দর্শনের  অভিশাপ মুক্ত করেছিলেন।
    অর্জুনের স্ত্রী হিসেবে আমরা দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও চিত্রাঙ্গদার নাম বেশি শুনে থাকি। কিন্তু উলুপী! না, তার কথা বিশেষ জানা যায় না। উলুপী চরিত্রটি রয়ে গেছে অনেকটাই উপেক্ষার অন্তরালে। কিন্তু এটাই বাস্তব, উলুপীকে না জানলে অর্জুনকে জানা আমাদের অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুধু তাই নয়, মহাভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে যাবে অনালোকিত। তাই উলুপী চরিত্রটিকে আমাদের বিশেষভাবে জানা দরকার।
    অর্জুন-উলুপীর কথা জানতে গেলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে যে সময় পাণ্ডবদের জীবনে আবির্ভাব ঘটে দ্রৌপদীর। দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদী। মেয়ের স্বামী নির্বাচনের জন্য তিনি একটি কঠিন শর্ত রাখেন। জলে প্রতিবিম্ব দেখে যিনি শূন্যে ঘুরন্ত মাছের চোখে তীর নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবেন তারা হাতেই তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন। অর্জুন এই পরীক্ষায় সফল হন এবং দ্রৌপদী তার গলায় বরমাল্য দেয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে তারা যখন কুন্তীকে বলে তারা মায়ের জন্য কি এনেছে দেখার জন্য, দ্রৌপদী না দেখেই বলে দেন যা এনেছে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে নিতে। মাতৃ আদেশের কারণে দ্রৌপদীকে পাঁচজন স্বামীকে বরণ করে নিতে হয়। নারী হিসেবে দ্রৌপদী ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্না। কিন্তু এক মেয়ের পক্ষে একসঙ্গে পাঁচজন স্বামীকে নিয়ে ঘর করা বেশ কঠিন ব্যাপার। তাতে নানান সমস্যা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তাই মহর্ষি নরদের পরামর্শে একটা নিয়ম তৈরি হয়। এই নিয়মের তাগাদাটা আসে মূলত নারদের পক্ষ থেকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে পাঁচ ভাই যতই খুশি হোক না কেন, এই সুন্দরী নারী তাদের মধ্যে বিভেদের কারণ হতে পারে। বিয়ের পরে তাদের আশীর্বাদ করতে এসে তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু সরাসরি নিজের উদ্বেগের কথা পাণ্ডবদের জানাতে পারেন না। এদিকে তার মুখের উদ্বেগের ছায়া দেখে যুধিষ্ঠির জানতে চান ব্যাপারটা কি। সরাসরি নিজের মনের সন্দেহের কথা না বলে নারদ তাদের দুই অসুর ভাইয়ের গল্প শোনান।
    হিরন্যকশিপুর বংশজাত দৈত্যরাজ নিকুম্ভর দুই পুত্র ছিলেন সুন্দ এবং উপসুন্দ। তাদের মধ্যে ছিল গভীর ভালোবাসা ও একতা। তারা অমরত্বের জন্য কঠোর তপস্যা করেন। তাদের তপস্যায় ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হন। কিন্তু তিনি তাদের অমরত্বের বর দেন নাতবে জানান তারা পরস্পরকে যদি না হত্যা করে তাহলে কেউ তাদের মারতে পারবে না। দুই ভাইয়ের মধ্যে এতখানি গভীর ভালোবাসা ছিল যে, তারা নিজেদের হত্যা করা দূরে থাক একে-অপরকে আঘাত করার কথা ভাবতেই পারত না। যাই হোক ব্রহ্মার আশীর্বাদে তারা অত্যন্ত দুর্বিনীত হয়ে ওঠে এবং স্বর্গরাজ্য অধিকার করে দেবতাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। বিতাড়িত দেবগন প্রতিকারের আর্জি নিয়ে ব্রহ্মার কাছে হাজির হন। ব্রহ্মা তখন মায়া বলে এক সুন্দরী রমনীর সৃষ্টি করেন, যার নাম তিলোত্তমা। তিলোত্তমা এতটাই সুন্দরী যে দেবতারাও তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। এরপর ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে দুই ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। তিলোত্তমাকে দেখে দুই ভাই তার প্রেমে পড়ে যায়। দুজনেই চায় তাকে বিয়ে করতে। এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। যে বিবাদ থেকে দুজনের মধ্যে লড়াই শুরু হয় এবং পরিশেষে দুজনেরই মৃত্য হয়।
    নারদের মুখে এই গল্প শোনার পর যুধিষ্ঠির বুঝতে পারেন তিনি কী বলতে চাইছেন। দ্রৌপদী সুন্দরী। তাকে নিয়ে যাতে না ভায়ে-ভায়ে কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদ সৃষ্টি হয় তার জন্য তিনি মহর্ষি নারদের কাছে পরামর্শ চান। নারদের পরামর্শ মতো স্থির হয়, দ্রৌপদী প্রতি এক বছর এক একজন ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে থাকবে। একবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে আগুনের মধ্যে পবিত্র হয়ে দ্রৌপদী দ্বিতীয় স্বামীর কাছে যাবেন। যে বছর দ্রৌপদী যে ভাইয়ের কাছে থাকবেন, সে বছর অন্যান্য ভাইদের দ্রৌপদীর উপর স্ত্রী হিসেবে কোনো অধিকার থাকবে না। শুধু তাই নয়, কোনো ভাই যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকবেন, সেখানে অন্য কোনো ভাই প্রবেশ করতে পারবেন না। যদি কেউ এই নিয়মের লঙ্ঘন করেন তাহলে তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বছর বনবাসে কাটাতে হবে। স্থির হয় যুধিষ্ঠির যেহেতু ভায়েদের মধ্যে বড়ো তাই তিনিই প্রথম দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে পাবেন। এই হিসেবে অর্জুনের গলায় বরমাল্য দিলেও, স্ত্রী হিসেবে দ্রৌপদীকে প্রথম সংসার করতে হয় যুধিষ্ঠিরের
    এর সামান্য কিছুদিন পরের ঘটনা। এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ এসে অর্জুনের কাছে জানায় যে, চোরেরা তার গো-ধন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কাকুতি মিণতি করে বলে চোরেদের হাত থেকে তার গো-ধন উদ্ধার করে দিতে। ব্রাহ্মণের কথা শুনে অর্জুন তাকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্রাগারে যান তার গাণ্ডীব আনতে কিন্তু সেখানে তিনি তা খুঁজে পান না। তখন তার মনে পড়ে কিছুদিন আগে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তার গাণ্ডীব নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা বলতে বলতে যুধিষ্ঠির ভুলবশত সেটি নিজের কাছে রেখে দেন। যুধিষ্ঠিরের কক্ষে ঢুকতে যেতে তার মনে পড়ে যায় শর্তের কথা। এদিকে ব্রহ্মণ তার সাহায্যের প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে। আর্তকে সাহায্য করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। তাই নিজের পরিণতির কথা না ভেবে তিনি যুধিষ্ঠিরের ঘরের মধ্যে যান এবং নিজের গাণ্ডীব নিয়ে আসেন। তস্করের হাত থেকে তিনি ব্রাহ্মণের গো-ধন রক্ষা করেন।
    অর্জুন জানতেন তিনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন। যদিও যুধিষ্ঠির তাকে বোঝান তিনি ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করেছেন। এটা না করলে বরং তিনি অন্যায় করতেন। তিনি অর্জুনকে বলেন তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে বনবাসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অর্জুন  বলেন ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করা যেমন তার কর্তব্য তেমনি শর্ত পালন করাও তার কর্তব্য। তাই শর্ত অনুযায়ী তিনি ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বছর বনবাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।
    ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন এলেন বর্তমানের হরিদ্বারেএখানকার আশ্রমিক পরিবেশ তার খুব ভালো লাগে। এখানে আশ্রম বানিয়ে তিনি থাকতে শুরু করেন। একদিন তিনি গঙ্গায় নেমেছেন স্নান করার জন্য। স্নান সেরে আশ্রমে ফিরে অগ্নিহোত্র করবেন। সেই মতো স্নান সেরে পিতৃপুরুষের তর্পণ সেরে তিনি উঠতে যাবেন, এমন সময় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেন এক সুন্দরী রমনী তাকে বাহু বেষ্টনীতে নিয়ে টেনে নিয়ে চলেছেন। সেই সুন্দরী নারীকে দেখে অর্জুন এতটাই মোহিত হয়ে যান যে তার বাহুবেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা ভুলে যান। এই সুন্দরী নারী হলেন উলুপী, নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা। উলুপী তাকে পিতার প্রাসাদে নিয়ে আসেন। সেখানে পৌঁছে অর্জুন দেখেন অগ্নিহোত্র করার জন্য হোম প্রজ্জ্বলিত হয়ে আছে। তখন অর্জুনের মনে পড়ে অগ্নিহোত্রের কথা। মাথা থেকে অন্য চিন্তা সরিয়ে তিনি প্রথমে অগ্নিহোত্র সমাধান করেন।
    এই প্রসঙ্গে একটু উলুপীর কথা বলে নেওয়া ভালো। পূর্বেই বলেছি উলুপী নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা। উলুপী আসামান্য সুন্দরী। নাগরাজ সুপর্ণ নাগের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের অল্পদিনের মধ্যে তাকে বিধবা হতে হয়। গড়ুরের হাতে নিহত হয় সুপর্ণ নাগ। উলুপী সুন্দরী, যুবতী। তার শরীর জুড়ে কামনার আগুন। সেটাই স্বাভাবিক। এদিকে গঙ্গাবক্ষে সুপুরুষ অর্জুনকে দেখে মোহিত হয়ে যায় উলুপী। তার মধ্যে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে। অর্জুনের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। অর্জুনকে কাছে পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং তাকে সরাসরি নিয়ে আসেন পিতার প্রাসাদে।
    অগ্নিহোত্র সমাধা হওয়ার পর উলুপী অর্জুনকে তার পরিচয় দিয়ে ব্যক্ত করে তার মনোবাসনা। কোনোরূপ রাখঢাক না রেখে তিনি সরাসরি অর্জুনকে জানান তার কামনার কথা, তার মিলন সুখ পাওয়ার বাসনার কথা। অর্জুনকে তিনি অনুরোধ করেন তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্যপ্রাথমিকভাবে উলুপীর এমন অভিপ্রায় প্রকাশ আমাদের অবাক করে। এক যুবতী বিধবা অন্য এক পুরুষের সঙ্গসুখ আকাঙক্ষা করছে, তার কাছে সন্তানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে—ব্যাপারটা যেন উলুপীর চরিত্রের দীনতা প্রকাশ করে। এ-প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলার। সে যুগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যার যাকে লাভ করার বাসনা জাগত তা তারা অকপটভাবে একে-অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারতেনপরপুরুষ কিংবা পরনারীর সঙ্গে মিলনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে মহাভারতে। দ্বিতীয়ত, কোনো মহিলা বিধবা হলে অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে না এমনটা ছিল না। বরং দেখা যায় কোনো মহিলা সন্তানহীন অবস্থায় বিধবা হলে বংশ রক্ষার্থে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্ষেত্রজ পদ্ধতিতে তার গর্ভে সন্তান উৎপাদনের ব্যবস্থা করতেন। মহাভারতে দেখি, সত্যবতীর পুত্র বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে মাতা সত্যবতী প্রথমে ভীষ্মকে বলেন তার ভার্তৃবধূদ্বয়ের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য। ভীষ্ম রাজি না হওয়ায়, তারই পরামর্শে সত্যবতী তার কুমারী অবস্থায় জন্ম দেওয়া সন্তান ব্যাসদেবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। মাতৃ আদেশে ব্যাসদেবের ঔরষে দুই পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে যথাক্রমে জন্ম নেয় ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। বিয়ের পূর্বে কুন্তীকে দেখা যায় সূর্যের ঔরষে গর্ভে সন্তান ধারণ করতে। জন্ম হয়েছিল কর্ণের, যদিও কুন্তী লোকানিন্দার ভয়ে তার মাতৃত্ব স্বীকার করেননি। কুন্তীর অন্য তিন সন্তানও তার স্বামী পাণ্ডুর ঔরষজাত নয়। এক অভিশাপের কারণে স্ত্রীদের সঙ্গে পাণ্ডুর মিলনের উপায় ছিল না। তাহলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল। তই বংশরক্ষায় কুন্তী তিন দেবতার ঔরষে যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের জন্ম দিয়েছিলেন। মাদ্রীর দুই সন্তান নকুল ও সহদেব, তার স্বামী পাণ্ডুর ঔরষজাত ছিলেন না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র কুমারী অবস্থায় নয়, বিবাহিত স্ত্রীও পছন্দের পুরুষের সঙ্গে মিলনের সুযোগ পেত। সেসব বিচার করে উলুপীর অর্জুনকে কাছে পাওয়ার আকাঙক্ষার মধ্যে আশ্চর্য বা অন্যায়ের কিছু ছিল না। একে যুবতী নারী হিসেবে তার মধ্যে শরীরী মিলনের আকাঙক্ষা থাকবেই। এক নারী হিসেবে সন্তানের জননী হওয়ার বাসনা থাকাও তার মধ্যে স্বাভাবিক। আর সেক্ষেত্রে এক অনার্য রমনী হয়ে অর্জুনের মতো এক ক্ষত্রিয় বীরের সঙ্গলাভ ও তার সন্তানের জননী হওয়া তার কাছে অনেক গৌরবের।
    যাই হোক, উলুপীর আবেদনে অর্জুন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন এক সুন্দরী রমনীর প্রণয় আহ্বানকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না তিনিকিন্তু তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার শর্ত। তিনি উলুপীকে সবকিছু জানান। বলেন, তার কথা রাখতে তিনিও চান, কিন্তু তার শর্তই তার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উলুপী বুঝতে পারেন অর্জুনও তার প্রতি আকৃষ্ট। তিনি তাকে বোঝান, তার ব্রহ্মচারী হওয়ার শর্ত কেবল দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্য কোনো নারীর ক্ষেত্রে নয়। তাতেও অর্জুন পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত হতে পারেন না। ওদিকে উলুপী অর্জুনকে পেতে ব্যাকুল। তখন উলুপী তাকে বলেন, অর্জুনকে কাছে না পেলে তিনি মারা যাবেন। আর একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে অর্জুনের উচিৎ পীড়িতের জীবন রক্ষা করা। অর্জুনকে তার শর্তের থেকে তার ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করা বেশি জরুরি।
    উলুপীর কথার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পায় অর্জুন। উলুপীর আহ্বানে সাড়া দেন তিনি। উলুপীর প্রণয় আকাঙক্ষা পূরণ করেন। তবে শুধু উলুপীর প্রণয় আকাঙক্ষা পূরণ করেছেন বললে বোধহয় ভুল হবে। অর্জুন নিজেও গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন উলুপীর প্রতিযাই হোক, একরাত তিনি কাটান উলুপীর সঙ্গে। পরের দিন উলুপীর পিতা কৌরব্যের সম্মতিতে তাকে বিয়েও করেন। বিয়ের পর উলুপী অর্জুনকে বর দেন, যে জলের কোনো প্রাণী কোনোদিন অর্জুনের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এরপর তিনি উলুপীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। উলুপীও তার কাছে আর বেশি কিছু প্রত্যাশা করেনি। অর্জুনকে তিনি কাছে পেয়েছেন, অর্জুনের স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছেন, এতেই তার জীবন সার্থক হয়ে যায়। পরেরদিন তিনি নিজেই অর্জুনকে ফিরিয়ে দিয়ে যান সেই জায়গায় যেখান থেকে তিনি তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অর্জুনের মধ্যেও কোনো ইচ্ছা দেখা যায়নি উলুপীর সঙ্গে আরও কিছুটা সময় থাকার। তাকে কথাও দেননি পরবর্তী সময়ে নিজের রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার। অর্জুনের প্রতি উলুপীর ভালোবাসা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি অর্জুনকে কতখানি গভীরভাবে ভালোবাসতেন তা পরবর্তী সময়ে পরিস্ফুট হবে। কিন্তু অর্জুনের মধ্যে যেন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার আচরণে এমনটা মনে হয় যেন তিনি তাকে দয়া করেছেন। অনেকটা যেন, এক অনার্য নারী যে আবার বিধবা তাকে তিনি সঙ্গ সুখ দিয়েছেন, তাকে বিয়ে করেছেন, এটাই অনেক বিরাট ব্যাপারঅর্জুনের জীবনে অনেকটাই উপেক্ষার আড়ালে রয়ে যান উলুপী। দীর্ঘ্য বনবাস জীবনে তার একবারও মনে পড়েনি উলুপীর কথা। তার কাছে অন্তত একবার ফিরে যাওয়ার কথাও মনে হয়নি যেমনটা তিনি করেছিলেন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে।
    এই বনবাস জীবনেই চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে বিয়ে হয় অর্জুনের। উলুপীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর নানা তীর্থ ও জায়গা ভ্রমণ করতে করতে তিনি এসে পৌঁছোন মণিপুর রাজ্যে। সেখানে ভ্রমণ করতে করতে একদিন রাজপথে তিনি দেখতে পান মণিপুরের রাজকন্যা সুন্দরী, দীপ্তিময়ী চিত্রাঙ্গদাকে। চিত্রাঙ্গদার অপরূপ সৌন্দর্যে অর্জুন বিমোহিত হয়ে যান। তাকে বিয়ে করার বাসনা প্রবলভাবে জেগে ওঠে অর্জুনের মনের মধ্যে। এক্ষেত্রে আর তার মনে পড়েনি ব্রহ্মচর্যের শর্তের কথা। যদিও সেই শর্ত তিনি আগেই ভেঙে ফেলেছিলেন। যাই হোক, কালবিলম্ব না করে তিনি সরাসরি চিত্রাঙ্গদার পিতা রাজা চিত্রভানুর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে চিত্রাঙ্গদার পানি প্রার্থনা করেন। অর্জুনের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চিত্রভানুর কোনো আপত্তি ছিল না। তবে তার একটা সমস্যা ছিল। তিনি অর্জুনকে জানান মহাদেবের আশীর্বাদে তাদের বংশে কেবল একটি সন্তান হবে। চিত্রাঙ্গদা তার একমাত্র সন্তান। তার গর্ভের সন্তান হবে এই বংশের উত্তরাধিকারী। অর্জুন তাকে বিয়ে করে নিয়ে চলে গেলে তার বংশ লোপ পাবে। তাই তিনি তাকে বলেন, অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করলেও সে এই রাজ্যেই থাকবে এবং তার সন্তান এই বংশের পরবর্তী রাজা হবে। চিত্রভানুর শর্ত মেনে নেন অর্জুন এবং চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায় বিয়ের পর প্রায় তিন বছর চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে মণিপুর রাজ্যে কাটান অর্জুন। একসময় অর্জুনের উপলব্ধি হয় তিনি অনেকদিন চিত্রাঙ্গদারর সঙ্গে থেকেছন। তাই চিত্রাঙ্গদা যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন তিনি আবারও তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে যান। কিন্তু মন কিছুতেই শান্ত হয় না। তার বার বার মনে হতে থাকে চিত্রাঙ্গদা অন্তঃসত্ত্বা। তাই তিনি আবারও ফিরে আসেন চিত্রাঙ্গদার কাছে। ইতিমধ্যে চিত্রাঙ্গদা বভ্রুবাহন নামে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। শর্ত মতো সেই সন্তানকে চিত্রভানুর হাতে তুলে দিয়ে চিত্রাঙ্গদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন। চিত্রাঙ্গদাকে সঙ্গে করে না নিয়ে এলেও তাকে হস্তিনাপুরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন। বলেন, যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করবেনতাতে যেন চিত্রাঙ্গদা উপস্থিত থাকেন।
    ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে উলুপীকে উপেক্ষিতা মনে হয়। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন অর্জুন। অন্তঃস্তত্বা স্ত্রীর কথা ভেবে পুনরায় তার কাছে ফিরেও এসেছেন। কিন্তু উলুপীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। উলুপীকে তিনি বিয়ে করেছেন কিন্তু তার সঙ্গে তিনি মাত্র একটি রাত কাটিয়েছেন। তার মনে ইচ্ছে জাগেনি অন্তত একবার স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে। চিত্রাঙ্গদার মতো অর্জুনের ঔরষে উলুপীর গর্ভেও এক সন্তানের জন্ম হয়, নাম ইরাবান। কিন্তু অর্জুন সেকথা জানতেনই না। ইরাবানকে পিতার কাছে দিয়ে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পিতৃত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে হয়। উলুপী পূর্বের স্বামীকে অল্প বয়সেই হারিয়েছিল। অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেলেও তাকে একটিমাত্র রাত ছাড়া আর পাশে পাননি। একাকী জীবন কেটেছে তার। নিজের দায়িত্বে সন্তানকে মানুষ করেছেনকিন্তু এর জন্য তার মধ্যে কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ দেখা যায়নি। অনার্য বলে তিনি ক্ষত্রিয় অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেয়েই কি নিজেকে ধন্য মনে করেছেন? এভাবে বিশ্লেষণ করলে উলুপীর চরিত্রটিকে ছোটো করা হবে। আসলে উলুপীর মন ছিল উদার, বিশাল। পাশাপাশি নারী হিসেবে তিনি ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী। তাই সামাজিক অনেক বাধা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একা তার সন্তানকে মানুষ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। চিত্রাঙ্গদার মতো সৌভাগ্য তার হয়নি। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ দূরে থাক, কোনোরূপভাবে তাকে আমন্ত্রণ জানাননি অর্জুন। দুটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়—চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করে নিজে ধন্য হয়েছিলেন অর্জুন। আর উলুপীকে বিয়ে করে যেন তাকে ধন্য করেছিলেন তিনি। চিত্রাঙ্গদার মতো ক্ষত্রিয় বংশজাত ছিলেন না বলেই কি এই অবহেলা? নাকি উলুপী ছিলেন বিধবা, সেই জন্য? যে কারণেই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট অর্জুনের কাছ থেকে উপেক্ষা আর অবহেলা পেয়েছেন তিনি, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খুবই বেদনাদায়ক লাগে, যখন দেখা যায় ইরাবানকে অর্জুনের কাছে গিয়ে পিতৃত্বের স্বীকৃতিলাভের জন্য চেষ্টা করতে হচ্ছে।
    আথচ, আমরা যদি চিত্রাঙ্গদা আর উলুপীর চরিত্র বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো অর্জুনকে ভালোবাসার নিরিখে চিত্রাঙ্গদার থেকে অনেক এগিয়ে উলুপী। একথা অস্বীকার করা যাবে না, অর্জুনকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন চিত্রাঙ্গদাও। কিন্তু ভালোবাসার নিরিখে উলুপীর থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন তিনি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আমরা দেখতে পাই স্বামীর কথা ভেবে উলুপী তার একমাত্র সন্তান ইরাবানকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। তাকে হারাতে হতে পারে এ-কথা জেনেও ইরাবানকে পাঠাতে দ্বিধা করেননি। স্বামীর প্রয়োজনে তার পাশে দাঁড়ানো যেমন নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন, তেমনি পিতার বিপদে পুত্রেরও তার পাশে থাকা কর্তব্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। অথচ চিত্রাঙ্গদা কিন্তু তার ছেলে বভ্রুবাহনকে পাঠাননি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ নিতে। বভ্রুবাহন তার পিতার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার খারাপ কিছু হয়ে গেলে তার পিতার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে, এই ভাবনা হয়তো মনে কাজ করছিল। তা যদিও হয়, তাহলে পরিস্কার চিত্রাঙ্গদা কর্তব্যের আগে স্বার্থের কথা ভেবেছিলেন। যেটা ভাবেননি উলুপী। ইরাবানের কিছু হয়ে গেলে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে, এই ভাবনা মাথায় প্রশ্রয় দেয়নি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দিয়ে একাধিক শক্তিশালী যোদ্ধাকে হত্যা করে ইরাবান কিন্তু নিজেও মারা যান। পুত্রের মৃত্যুতে তেমন শোক করতে দেখা যায় না অর্জুনকে। ছেলের বীরত্ব নিয়ে গর্বের কথা শোনা যায় না তার মুখে। এটাও কি উলুপীর প্রতি উপেক্ষা নয়? ইরাবানের এই আত্মাহুতি অর্জুনের কাছে কি কেবল একজন পুত্রের পিতার প্রতি কর্তব্য কিংবা যোদ্ধার কর্তব্য ছিল? এর মধ্যে মায়ের ত্যাগের মহত্বের কথা কি তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন?
    এক ক্ষত্রিয় হিসেবে অর্জুন স্বাভাবিকভাবে চাইবেন তার সন্তানদের মধ্যে বিরোচিত সত্বার প্রকাশ। পুত্র ইরাবানের বীরত্ব দেখে তিনি কতটা খুশি বা মুগ্ধ হয়েছিলেন সেকথা বিশেষ বলা নেই। তবে পুত্র বভ্রুবাহনের মধ্যে বীরত্বের অভাব তাকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। সেই অশ্ব অনেক রাজ্য ঘুরতে ঘুরতে হাজির হয় মণিপুরে। তখন মণিপুরের রাজা বভ্রুবাহন। পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে বভ্রুবাহন শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে বরণ করে নিতে হাজির হন। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের এমন বিনীত আচরণ অর্জুনকে একদম মুগ্ধ করতে পারেনি। সন্তানের মধ্যে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ক্ষত্রিয়োচিত বীরভাব। তার এই দুর্বল মনোভাবে ক্ষুন্ন হন তিনি। ঠিক এমন সময় সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে হাজির হন উলুপী। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বভ্রুবাহনকে উৎসাহিত করেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু বভ্রুবাহন পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে চান না। উলুপী তখন তাকে বোঝান, এক আদর্শ সন্তানের কর্তব্য হল পিতাকে খুশি করা, তার মনোবাসনা পূরণ করা। পিতা তার মধ্যে বিনয় নয় বীরত্ব দেখতে চান। তাই তার উচিত পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা। বিমাতা উলুপীর কথায় অর্জুনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন বভ্রুবাহন। তার প্ররাক্রমের কাছে অর্জুন শুধু পরাজিতই হন না, নিহত হন।
    স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে চিত্রাঙ্গদা ছুটে আসেন। তিনি যখন জানতে পারেন এই যুদ্ধের পেছনে উলুপীর মদত রয়েছে তখন তিনি নানাভাবে উলুপীকে তিরস্কার করেন। তার হয়তো মনে হয়ে থাকতে পারে স্বামীকে কাছে না পাওয়ার আক্রোশবশত উলুপী পুত্রকে দিয়ে পিতাকে হত্যা করিয়েছেন। কিন্তু উলুপী নিজের সর্বস্ব দিয়ে অর্জুনকে ভালোবেসেছিলেনমাত্র একদিনের জন্য তিনি অর্জুনকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার জন্য স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা একবিন্দুও কমে যায়নি। সারাজীবন ধরে তিনি স্বামীর মঙ্গল চেয়ে এসেছেন। বভ্রুবাহনকে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করার ক্ষেত্রে তার মহৎ উদ্দেশ্যই ছিল।
    কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পরাক্রমশালী ভীষ্মকে পরাজিত করার জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন অর্জুন। ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় তিনি শ্রীখণ্ডীকে সামনে রেখেছিলেন। শ্রীখণ্ডী ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী। এই নিয়ে মহাভারতে নানাবিধ মত আছে। সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। উল্লেখ্য ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি কখন রূপান্তরকামী, নারী ও দুর্বলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। শ্রীখণ্ডীকে সামনে দেখে তিনি অস্তর ত্যাগ করেন। নিরস্ত্র ভীষ্মকে শরবিদ্ধ করেন অর্জুন। ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। শরসয্যায় শায়িত হয়েও তিনি মারা যামনি। তবে এই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। ভীষ্মের এমন অন্যায়ভাবে হত্যা মেনে নিতে পারেনি তার বসু ভাইয়েরা। তারা খুব ক্ষুব্ধ হয় অর্জুনের ওপর। মাতা গঙ্গার অনুমতি নিয়ে তারা অর্জুনকে নরক দর্শনের অভিশাপ দেন। গঙ্গাবক্ষে যখন তারা অর্জুনকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন উলুপী। স্বামীর নরক দর্শনের অভিশাপ শুনে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। ছুটে যান পিতা কৌরব্যের কাছে। তাকে সবকিছু খুলে বলেন। কৌরব্য বসুগনের কাছে অনুনয় করেন এই অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু একবার দেওয়া অভিশাপ আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তবে বসুগন তাকে জানায়, ভীষ্মকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে অর্জুন যে পাপ করেছে তার জন্য তাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। যে যদি পুত্রের হাতে নিহত হয় তাহলে তার এই শাপমুক্তি ঘটবে। আর এ-কারণেই উলুপী বভ্রুবাহনকে প্ররোচিত করেছিলেন তাকে পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য। স্বামীকে নরকভোগের অভিশাপ মুক্ত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
    যাই হোক, শোকার্ত চিত্রাঙ্গদা আর বভ্রুবাহনের অনুরোধে তিনি নাগজাতির সঞ্জীবনী মণি এনে বভ্রুবাহনের হাতে দেন। বভ্রুবাহন সেই মণি পিতার বুকের ওপর ছোঁওয়ালে প্রাণ ফিরে পান অর্জুন। জীবন ফিরে পাওয়ার পর উলুপীর মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে অর্জুন মুগ্ধ হন। তিনি তাকে দেবী’ সম্বোধন করেন। শুধু তাই নয়, অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত থাকার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান।
    মাত্র একদিন উলুপীর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন অর্জুন। তাসত্ত্বেও তিনি তাকে পুরোপুরি বিস্মৃত হননি কিংবা স্ত্রীর মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেননি—এটা উলুপীর কাছে একটি বিরাট প্রাপ্তি। সর্বসমক্ষে অর্জুনের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তি—অনেক উপেক্ষার পর বলা যেতে পারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠত হন তিনি। এখানেই শেষ নয়, উলুপী আর চিত্রাঙ্গদা যখন অশ্বমেধ যজ্ঞের আসরে উপস্থিত হন কুন্তী, দ্রৌপদীরা তাদের মর্যাদার সঙ্গে বরণ করে নেন। যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর হস্তিনাপুরেই তাদের থাকার ব্যবস্থা হয় একদা নাগবধু পাণ্ডববধূ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এতখানি প্রাপ্তি উলুপী নিজেও বোধহয় কখনও প্রত্যাশা করেননি। সময় অতিবাহিত হয়েছে। পাণ্ডবদের পুত্রবধূ হিসেবে তার স্বীকৃতি আরও মজবুত হয়েছে।
    সময় বয়ে যায়। একসময় পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ ঘটে একমাত্র দ্রৌপদীর। অর্জুনের অন্যান্য স্ত্রীরা হস্তিনাপুরে থেকে গেলেও উলুপী থাকেন না। নিজের পিতৃগৃহেও ফিরে যান না। গঙ্গাবক্ষে প্রাণ বিসর্জন দেন তিনি। অর্জুনকে কাছে না পান, অর্জুন ছিলেন, তাই তার বেঁচে থাকাটাকে সার্থক মনে করেছিলেন। সেই স্বামী যখন মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেছেন, তখন আর বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সার্থকতা খুঁজে পাননি উলুপী। তাই তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দেন। এটা প্রমাণ করে কত গভীরভাবেই না তিনি ভালোবাসতেন অর্জুনকে।
    অর্জুনের প্রতি উলুপীর এই ভালোবাসার গভীরতা আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। তার ভালোবাসা ছিল অনেকটাই একতরফা। তার দাবি ছিল সামান্যআর পাঁচটা স্ত্রীর মতো তার মনে ক্ষোভ, অভিমান কিংবা অভিযোগ ছিল না। ভালোবাসা তার কাছে ছিল পূজা। সারাজীবন তিনি সেই পূজা করে গেছেন। আর তার ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, একদিন সেই ভালোবাসাই তার স্বামীকে তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে
    উলুপীর জীবন বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, সারাজীবন ধরে তাকে নানান উপেক্ষা আর অবহেলা স্বীকার করতে হয়েছে। মহাভারতের বিস্তৃত অধ্যায়ে তার চরিত্রটি নিতান্তই ছোটো, ব্যাপ্তিও তাই। কিন্ত ঘটনা পর্য্যালোচনায় দেখা যায়, তার চরিত্রের গভীর তাৎপর্য্য রয়েছে। কেবলমাত্র একটি সাধারণ চরিত্র হিসেবে উপস্থিতি নয়, মহাভারতের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র, অর্জুনের জীবনের ঘটনাপ্রবাহে তার অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে।
    মহাভারত আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলার কথা জানতে পারি যাদের নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা হয়েছে। গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদীর কথা বাদ দিলাম, এমনকি চিত্রাঙ্গদার চরিত্রও যেভাবে আলোচিত হয়েছে সেভাবে আলোচিত কিংবা আলোকিত হননি উলুপী। অথচ ভালোবাসা আর ত্যাগের মহত্বে তার অবদান অন্যান্যদের থেকে কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং বেশিই ছিল। পতিব্রতা রমনীদের কথা আলোচনা করতে গেলে অনেক বড়ো বড়ো নাম আমাদের মাথায় আসে। সেই দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে উলুপীরও বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার কথা। জীবনের প্রায় শেষ অধ্যায়ে এসে উলুপী হয়তো মর্যাদার আসন ফিরে পেয়েছিলেন, তাই বলে তার বঞ্চনা আর উপেক্ষাগুলো অস্বীকার করা যাবে না। আর আমাদের নানাবিধ আলোচনায় বিশেষ করে মহীয়সী নারী চরিত্রের আলোচনায় যেভাবে অনেক বড়ো বড়ো নাম নিয়ে আমরা আলোচনা করি, উলুপীরও কথা সেখানে মাথায় আসে না। অথচ এই চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে আমরা অনেক মণি-মুক্তোর সন্ধান পাই। এও তো এক ধরনের উপেক্ষা।
    উলুপী স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবাদী এবং ব্যক্তিত্বময়ী। অর্জুনকে ভালোলাগার কথা আর তার সঙ্গসুখ পাওয়ার তীব্র বাসনার কথা তিনি অকপটে ব্যক্ত করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর দেবরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে অর্জুনের ক্ষেত্রজ সন্তানের জননী হয়েছেন। পুত্রকে মানুষ করেছেন পুরোপুরি নিজের দায়িত্বে। স্বামীর অবহেলা, উপেক্ষা নিয়ে অভাব-অভিযোগ জানাননি বরং স্বামীর প্রতি ভালোবাসা বুকের মধ্যে রেখে তার কর্তব্য পালন করে গেছেনপুত্রেক বীরের মতো বড়ো করেছেন। চরিত্র বিশ্লেষণে তার বাস্তববাদী এবং ব্যক্তিত্বময়ী সত্বাটি আমাদের সামনে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। এরকম একটি চরিত্র পাঠককর্তৃক বেশিমাত্রায় আলোচিত হলে, নারী চরিত্রের মহত্বর সত্ত্বার দিকগুলি প্রবলভাবে প্রতীয়মান হবে। কিন্তু তা না করাটাই এক নিষ্ঠুর উপেক্ষা। যে উপেক্ষা কেবল উলুপীকে আড়ালে রাখেনি, সেই সঙ্গে অনালোচিত করে রেখেছে সময়ে এক স্বর্ণ মুহূর্তকে।






সৌরভকুমার ভূঞ্যা
তেরপেখ্যা, মহিষাদল
পূর্ব মেদিনীপুর, ৭২১৬২৮
৯৪৭৬৩৩০৫৩৩, ৭৪৩১৯৮৫৪৮৫

Thursday, January 10, 2019

কবিতা - ৩

স্বেচ্ছা-মৃত্যু
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ঝরনা শুকিয়ে গেছে
মরা গাছ বুকে নিয়ে আস্ত ন্যাড়া পাহাড় বুড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
জলের পথ ধরে চুঁইয়ে নামছে লাল-স্রোত
শুষ্ক বাতাসকে জড়িয়ে রেখেছে যন্ত্রণার লুকোচুরি খেলা,
নীল আকাশের নীচে সেই আস্ত পাহাড়
ক্রমশ ছোটো হতে হতে নেমে আসে সমতলে,
বিরাট শূন্যস্থান জুড়ে জেগে থাকে এক ভয়ংকর মুখ
রূপকথা নয়, তবু যেন ফিরে আসে দানব-রাক্ষস...

এরকম একটি আজগুবি স্বপ্ন দেখতে দেখতে
ঘুম ভেঙে যায়। অবাক হয়ে দেখি
মাথার ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন
শুভ্র কেশওয়ালা এক অতি প্রাচীন বৃদ্ধ,
তিনি তার শরীর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমায় দেখান।
দেখি, অজস্র ক্ষতচিহ্ন, রক্তের শুকনো দাগ
মাথার মধ্যে জেগে ওঠে যুদ্ধ আর মহাভারত...

বৃদ্ধটি আমার দিকে তাকিয়ে জল চাইলেন
আমি হতাশ দৃষ্টি মেলে দেখালাম শূন্য হাত,
তিনি আমার দু-চোখ স্পর্শ করলেন মমতায়
উষ্ণ স্রোত থেকে তুলে নিলেন কয়েক ফোঁটা অশ্রু,
তারপর, ফিরে যেতে যেতে আমায় শেখালেন
স্বেচ্ছামৃত্যুর গোপন কৌশল।

কবিতা - ২


সেতু পারাপার
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছ তুমি।
জোর করে যতই শব্দ লিখি না কেন—
একটি নিষ্ঠুর নীরবতা ফুটে ওঠে কথামালায়।
স্মৃতির পাতায় আজ রামধনু সুখ
জীবন থেকে হারিয়ে যায় সমস্ত বৃষ্টিকথা।
সাদা-কালো রংয়ের মাঝে বিবর্ণ বিষাদ—
কেমন যেন আজ বেমানান লাগে।

সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছ তুমি,
অতীত আর আগামীর মাঝে তোমার পথচলা,
সাম্য বজায় রাখতে রাখতে এগিয়ে চলেছ সন্তর্পণে
স্মৃতি ও সুখের অবাস্তব মেলবন্ধনে।

একমাত্র জীবন কখনো বন্ধন রচনা করতে পারে না
সময়ের এক-একটি অধ্যায় পেরোতে পেরোতে—
একদিন জীবনের বিনিময় মাঝে জেগে থাকে সেতু।
এখন তুমি ভুলে গেছ বিনিময় সুখ,
কী করে স্বপ্ন দেখো সেতু পেরোবার?

কবিতা - ১


বিষাদ রংয়ের স্মৃতি
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

১.

কবিতা লিখতে পারি না কোনোদিন
একথা আমার থেকে ভালো বোঝে না কেউ।
তবুও প্রতিদিন কলম নিয়ে বসি,
দুর্বল শব্দে শুভ্রতায় আঁচড় টানি।
বস্তুত, এ-কেবল আড়াল আড়াল খেলায়
তোমাকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা।

২.

একবার ভেবেছিলে তুমি ভালোবাসা হবে
তারপর বললে, কেবল বন্ধুত্বটুকুই থাক,
সম্পর্কটাকে তুমি গুলিয়ে ফেলেছিলে।
আসলে তুমি বুঝতে পারোনি
কোন পথে পা ফেললে—
একটা সঠিক সেতু-বন্ধ পাওয়া যায়।

৩.

কথা দিয়েছিলে, পাশাপাশি হাঁটবে অনেকটা পথ
হারিয়েও যেতে চেয়েছিলে অনন্ত দ্রাঘিমায়।
এখন নিকষ অন্ধকার
একটাও পথ আর যায় না দেখা,
যে পথে হাঁটতে পারি তুমি আর আমি
পড়ে থাকা জীবনের কিছুটা সময়।


৪.

অভিনয় করেছো, জেনেছি অনেক আগে
তবুও মুখ ফুটে বলিনি কোনো কথা,
আমার বোকামি দেখে অনেক হেসেছো তুমি
তবুও ভুলটা ভাঙাতে চাইনি কোনোদিন।
বুঝতে পারো না, তুমি হেরে গেলে—
পরাজয় গ্লানিতে ভারী হয় আমার পথচলা।

৫.

তোমার চোখে এখন সাবলীল উপহাস।
বোকা বোকা অভিমানগুলো
নীরবে কেবল পুড়তেই থাকে।

জীবন ফুরিয়ে যায়
তবে কেন যন্ত্রণার বুকে—
জেগে থাকে অমরত্বের লোভ?

৬.

নত হতে হতে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে,
নিজেকে সহজ করে ফেলেছ অনেকটাই,
তাই নির্দিদ্ধায় মাড়িয়ে যাও ফেলে আসা পথ।
স্মৃতির পাতায় ঢুকে হিসেব কষে দেখি—
অসংখ্য কাটাকুটির মাঝে জেগে আছে
একরাশ উদাসীন শূন্যতা।

৭.

মৌণতা ভালো,
উত্তর দেওয়ার কোনো দায় থাকে না।
বুঝতে পারি না কিছুতেই
মানবী থেকে তুমি তপস্বী হয়ে গেছ,
নাকি, ভণ্ডামির প্রশ্নচিহ্নে
তালগোল পাকিয়েছি বারবার?

৮.

সবকিছুই কি হিসেব করে হয়?
তাহলে তো হাঁটাই হত না পাশাপাশি
মাড়িয়ে যেতাম না এতখানি পথ!

মাঝপথে এসে তুমি খুলেছ হিসেব খাতা।
বলো, পিছু ফেরা পথে—
কী করে ফিরব একা একা?

৯.

এখন অনেক রাত্রি,
আমি জেগে আছি রোজকার মতো
হয়তো তুমিও জেগে আছো
তবুও মাঝখানে নীরব ব্যবধান।
এখন আর বিনিময় নেই
সেতুবন্ধের শব্দগুলো হারিয়ে ফেলেছি দুজনেই।

১০.

আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে খুব,
বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভেসে উঠল তোমার মুখ।
তুমি বলতে, বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখো
দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে।

এখন বৃষ্টি নেই, আমি মনের মাঝে উঁকি মারি
দেখি, বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম।

১১.

ঠিক আছে, তবে তোমার কথাই থাক।
বিশ্বাস করি না, সে-কথা তুমিও জানো,
তবুও তোমার কথা মেনে সত্য হোক পরজন্ম।
আর কিছু না হোক,
শান্ত্বনার মিথ্যা আশ্বাসে—
সুপ্ত থাক সমস্ত আপশোশ।

১২.

স্মৃতির দরজায় যতবার কড়া নাড়ি না কেন
কিছুই পাবো না ফিরে আর
কেবল দুঃখটুকু ছাড়া,
দুর্বল শব্দে তাই নিজেকে ব্যক্ত করি রোজ,
এ-কেবল তোমার সঙ্গে—
কিছুটা সময় পাশে থাকা।