Thursday, January 10, 2019

কবিতা - ৩

স্বেচ্ছা-মৃত্যু
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ঝরনা শুকিয়ে গেছে
মরা গাছ বুকে নিয়ে আস্ত ন্যাড়া পাহাড় বুড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
জলের পথ ধরে চুঁইয়ে নামছে লাল-স্রোত
শুষ্ক বাতাসকে জড়িয়ে রেখেছে যন্ত্রণার লুকোচুরি খেলা,
নীল আকাশের নীচে সেই আস্ত পাহাড়
ক্রমশ ছোটো হতে হতে নেমে আসে সমতলে,
বিরাট শূন্যস্থান জুড়ে জেগে থাকে এক ভয়ংকর মুখ
রূপকথা নয়, তবু যেন ফিরে আসে দানব-রাক্ষস...

এরকম একটি আজগুবি স্বপ্ন দেখতে দেখতে
ঘুম ভেঙে যায়। অবাক হয়ে দেখি
মাথার ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন
শুভ্র কেশওয়ালা এক অতি প্রাচীন বৃদ্ধ,
তিনি তার শরীর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমায় দেখান।
দেখি, অজস্র ক্ষতচিহ্ন, রক্তের শুকনো দাগ
মাথার মধ্যে জেগে ওঠে যুদ্ধ আর মহাভারত...

বৃদ্ধটি আমার দিকে তাকিয়ে জল চাইলেন
আমি হতাশ দৃষ্টি মেলে দেখালাম শূন্য হাত,
তিনি আমার দু-চোখ স্পর্শ করলেন মমতায়
উষ্ণ স্রোত থেকে তুলে নিলেন কয়েক ফোঁটা অশ্রু,
তারপর, ফিরে যেতে যেতে আমায় শেখালেন
স্বেচ্ছামৃত্যুর গোপন কৌশল।

কবিতা - ২


সেতু পারাপার
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছ তুমি।
জোর করে যতই শব্দ লিখি না কেন—
একটি নিষ্ঠুর নীরবতা ফুটে ওঠে কথামালায়।
স্মৃতির পাতায় আজ রামধনু সুখ
জীবন থেকে হারিয়ে যায় সমস্ত বৃষ্টিকথা।
সাদা-কালো রংয়ের মাঝে বিবর্ণ বিষাদ—
কেমন যেন আজ বেমানান লাগে।

সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছ তুমি,
অতীত আর আগামীর মাঝে তোমার পথচলা,
সাম্য বজায় রাখতে রাখতে এগিয়ে চলেছ সন্তর্পণে
স্মৃতি ও সুখের অবাস্তব মেলবন্ধনে।

একমাত্র জীবন কখনো বন্ধন রচনা করতে পারে না
সময়ের এক-একটি অধ্যায় পেরোতে পেরোতে—
একদিন জীবনের বিনিময় মাঝে জেগে থাকে সেতু।
এখন তুমি ভুলে গেছ বিনিময় সুখ,
কী করে স্বপ্ন দেখো সেতু পেরোবার?

কবিতা - ১


বিষাদ রংয়ের স্মৃতি
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

১.

কবিতা লিখতে পারি না কোনোদিন
একথা আমার থেকে ভালো বোঝে না কেউ।
তবুও প্রতিদিন কলম নিয়ে বসি,
দুর্বল শব্দে শুভ্রতায় আঁচড় টানি।
বস্তুত, এ-কেবল আড়াল আড়াল খেলায়
তোমাকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা।

২.

একবার ভেবেছিলে তুমি ভালোবাসা হবে
তারপর বললে, কেবল বন্ধুত্বটুকুই থাক,
সম্পর্কটাকে তুমি গুলিয়ে ফেলেছিলে।
আসলে তুমি বুঝতে পারোনি
কোন পথে পা ফেললে—
একটা সঠিক সেতু-বন্ধ পাওয়া যায়।

৩.

কথা দিয়েছিলে, পাশাপাশি হাঁটবে অনেকটা পথ
হারিয়েও যেতে চেয়েছিলে অনন্ত দ্রাঘিমায়।
এখন নিকষ অন্ধকার
একটাও পথ আর যায় না দেখা,
যে পথে হাঁটতে পারি তুমি আর আমি
পড়ে থাকা জীবনের কিছুটা সময়।


৪.

অভিনয় করেছো, জেনেছি অনেক আগে
তবুও মুখ ফুটে বলিনি কোনো কথা,
আমার বোকামি দেখে অনেক হেসেছো তুমি
তবুও ভুলটা ভাঙাতে চাইনি কোনোদিন।
বুঝতে পারো না, তুমি হেরে গেলে—
পরাজয় গ্লানিতে ভারী হয় আমার পথচলা।

৫.

তোমার চোখে এখন সাবলীল উপহাস।
বোকা বোকা অভিমানগুলো
নীরবে কেবল পুড়তেই থাকে।

জীবন ফুরিয়ে যায়
তবে কেন যন্ত্রণার বুকে—
জেগে থাকে অমরত্বের লোভ?

৬.

নত হতে হতে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে,
নিজেকে সহজ করে ফেলেছ অনেকটাই,
তাই নির্দিদ্ধায় মাড়িয়ে যাও ফেলে আসা পথ।
স্মৃতির পাতায় ঢুকে হিসেব কষে দেখি—
অসংখ্য কাটাকুটির মাঝে জেগে আছে
একরাশ উদাসীন শূন্যতা।

৭.

মৌণতা ভালো,
উত্তর দেওয়ার কোনো দায় থাকে না।
বুঝতে পারি না কিছুতেই
মানবী থেকে তুমি তপস্বী হয়ে গেছ,
নাকি, ভণ্ডামির প্রশ্নচিহ্নে
তালগোল পাকিয়েছি বারবার?

৮.

সবকিছুই কি হিসেব করে হয়?
তাহলে তো হাঁটাই হত না পাশাপাশি
মাড়িয়ে যেতাম না এতখানি পথ!

মাঝপথে এসে তুমি খুলেছ হিসেব খাতা।
বলো, পিছু ফেরা পথে—
কী করে ফিরব একা একা?

৯.

এখন অনেক রাত্রি,
আমি জেগে আছি রোজকার মতো
হয়তো তুমিও জেগে আছো
তবুও মাঝখানে নীরব ব্যবধান।
এখন আর বিনিময় নেই
সেতুবন্ধের শব্দগুলো হারিয়ে ফেলেছি দুজনেই।

১০.

আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে খুব,
বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভেসে উঠল তোমার মুখ।
তুমি বলতে, বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখো
দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে।

এখন বৃষ্টি নেই, আমি মনের মাঝে উঁকি মারি
দেখি, বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম।

১১.

ঠিক আছে, তবে তোমার কথাই থাক।
বিশ্বাস করি না, সে-কথা তুমিও জানো,
তবুও তোমার কথা মেনে সত্য হোক পরজন্ম।
আর কিছু না হোক,
শান্ত্বনার মিথ্যা আশ্বাসে—
সুপ্ত থাক সমস্ত আপশোশ।

১২.

স্মৃতির দরজায় যতবার কড়া নাড়ি না কেন
কিছুই পাবো না ফিরে আর
কেবল দুঃখটুকু ছাড়া,
দুর্বল শব্দে তাই নিজেকে ব্যক্ত করি রোজ,
এ-কেবল তোমার সঙ্গে—
কিছুটা সময় পাশে থাকা।

Monday, January 7, 2019

ছোটোগল্প


সংবর্ধনা
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় গায়ত্রী। দেখে ঘরের মধ্যে উদ্বিগ্নভাবে পায়চারি করছে প্রকাশ বুঝতে বাকি থাকে না কোনো ঘোরতর সমস্যায় পড়েছে। সমস্যা ব্যাপারটা নতুন নয় প্রকাশের জীবনেএকটা রাজনৈতিক দলের ছোটোখাটো নেতা সে। রোজই প্রায় নানাবিধ সমস্যা লেগে থাকে। বিয়ের প্রথম প্রথম প্রকাশকে সমস্যায় পড়তে দেখলে সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাই আজকাল প্রকাশকে সমস্যায় পড়তে দেখলে গায়ত্রী হুটহাট প্রশ্ন করে না। কিন্তু আজ প্রকাশের উদ্বিগ্নতার ব্যাপারটা কেমন যেন অন্যরকম। চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হল? তখন থেকে দেখছি উদ্বিগ্নভাবে ঘরময় পায়চারি করছ কোনো সমস্যা হয়েছে?’
    সমস্যা বলে সমস্যা, একেবারে ঘোরতর সমস্যা। জীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে প্রকাশ, কিন্তু এমন সমস্যা এই প্রথম। এর আগে বাহুবল, লোকবল কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতায় কত বড়ো বড়ো সমস্যা তুড়ি মেরে সমাধান করে দিয়েছে। কিন্তু, আজকের সমস্যাটা তাকে একেবারে টলিয়ে দিয়েছে। তার সমস্ত ভাবনার তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে
    উত্তর না পেয়ে গায়ত্রী আবারও বলে, কিছু বলছ না কেন? আমার তো টেনশন হচ্ছে।
    এবার মুখ খোলে প্রকাশ। ‘না না, তেমন কিছু নয়। টেনশনের কারণ নেই।’
    প্রকাশের কথা বিশ্বাস না হলেও এ-নিয়ে আর কথা বলে না গায়ত্রী। বেরিয়ে আসতে যাবে, এমন সময় প্রকাশ বলে, ‘শোনো, আমাকে এককাপ কড়া চা দিয়ো যাও তো।
    সন্দিগ্ধ চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে যায় গায়ত্রী
   প্রকাশ ভাবতে থাকে, চিঠিটায় ভুল দেখা হয়নি তো! কিন্তু একবার নয়, বেশ কয়েকবার চিঠিটা পড়েছে। ভুল হওয়ার কথা নয়। তবুও মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। চিঠিটা আবারও পড়ে। চিঠি মনে আমন্ত্রণপত্র। সম্মাননা জ্ঞাপনে তার নাম লেখা আছে। বিশিষ্ট কবি হিসেবে তাকে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় সবুজ সংঘভাবে ভুল করে তার নাম ছাপা হয়নি তো! কিন্তু তা কী করে হবে! ক্লাবের সম্পাদক নিজে এসে চিঠি দিয়ে গেছে। শুধু চিঠি দেওয়া নয়, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে, কার্ডে নাম ছাপার আগে তার অনুমতি নিতে পারেনি বলে বারেবারে দুঃখপ্রকাশ করেছ। এসব তো মিথ্যা হতে পারে না। তাই পুরো ব্যাপারটার কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় তার।
    আবারও কার্ডটার দিকে তাকায় প্রকাশ। ‘বিশিষ্ট কবি’ শব্দ দুটি অবিশ্বাসী লাগে তার কাছেঅনেক ভেবেও মনে করতে পারে না কোনো কবিতা-টবিতা লিখেছে কি না। লেখা দূরে থাক, শেষ কবে কবিতা পড়েছে মনে করতে পারে না।
    বর্তমান ছেড়ে অতীতে ডুব দেয় প্রকাশএকেবারে স্কুলজীবন থেকে শুরু করে। স্মৃতি রোমন্থনে অনেক অস্পষ্ট ঘটনাও মনে হাজির হয় কিন্তু তার মধ্যে কবিতা সম্পর্কিত কিছু পায় না। স্কুল-জীবন ছেড়ে আসে কলেজ জীবনে। কিন্তু সে আরও বড়ো এলোমেলো সময়। স্কুল-জীবনে তবু বইখাতা সঙ্গে ছিল। কলেজ জীবনে এসে সেসব সঙ্গছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কলেজে বছর গড়াতে না গড়াতে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সে। মিটিং-মিছিল, ধর্ণা-বক্তৃতা, মাঝেমাঝে মারদাঙ্গা—এসব করে তিন বছরের কলেজ জীবনকে টেনে টেনে বছর ছয়-সাত পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। তারপর যতদূর সম্ভব চক্ষুলজ্জার খাতিরে আর কলেজমুখো হয়নি। রাজনীতিতে ভিড়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর এক নেতার ছাতার নীচে থাকতে থাকতে এখন সে নিজেই ছোটোখাটো নেতা
    যাই হোক, অনেক ভেবেও প্রকাশ কবিতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায় না। সহসা একটা ব্যাপার তাকে উত্তেজিত করে তোলেমিটিং-মিছিলের প্রয়োজনে নিয়মিত শ্লোগান লেখে সে। উপরতলার নেতানেত্রীরাও তার শ্লোগানের রীতিমতো প্রশংসা করে। প্রায়শই সে বলতে শোনে, তার শ্লোগানের মধ্যে নাকি আগুন আছে। শুনলেই মানুষের শরীরে উত্তেজনার স্রোত বয়ে যায়। সহসা ভাবে, এগুলো কবিতা নয় তো? ব্যাপারটা মাথায় আসতে তার সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায়
    একটা আলমারিতে সামান্য কিছু বইখাতা, কাগজপত্র আছে তার। তার মধ্যে কিছু শ্লোগান থাকলে থাকতে পারেতন্নতন্ন করে সেই আলমারিটায় খুঁজতে থাকে প্রকাশ। কিন্তু একটা শ্লোগানও খুঁজে পায় না। হতোদ্যম না হয়ে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।
    চা নিয়ে ঢুকে বেশ অবাক হয় গায়ত্রী। প্রকাশ একাগ্রচিত্তে বইখাতার পাতা উল্টে যাচ্ছিল। কৌতূহল চাপতে না পেরে বলেই ফেলে,একমনে কী খুঁজছো?’
    ‘কবিতার খাতা।’ বলেই চমকে ঘুরে তাকায় প্রকাশ। বুঝতে পারেনি কখন গায়ত্রী ঘরে ঢুকেছে। এতটাই নিজের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল যে মুখ ফস্কে সত্যিটা বেরিয়ে গেছে। তার জবাব শুনে গায়ত্রীর মুখ থমথমে হয়ে যায়। আপাত শান্ত হলেও এখন তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে তীব্র রাগ। চায়ের কাপটা ঠকাস করে টেবিলে রেখে দিয়ে বেশ ঝাঁঝালো সুরে বলে, কবিতার খাতা!’
    গায়ত্রীর এমন রাগের কারণ বুঝে উঠতে পারে না প্রকাশ নেতা হিসেবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হলেও এখন স্ত্রীর মেজাজের সামনে বেশ মিইয়ে যায়। গায়ত্রী ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, কবিতার খাতা তোমার কাছে কেন? কবিতা কে? তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? এতিদন তোমার অনেক বন্ধু-বান্ধবের নাম শুনেছি কিন্তু কবিতার নাম তো আগে কোনোদিন শুনিনি! রীজনীতির নামে ভেতরে ভেতরে এসব চলছে! এমন আকুল হলে খাতা খুঁজছো কেন?  কবিতা কি খাতায় শ্লোগান লিখে পাঠিয়েছে নাকি প্রেমপত্র?’
    গায়ত্রীর রাগের কারণটা এবার মাথায় ঢোকে প্রকাশের। এমনটিতে মাথাটা অশান্ত ছিল। গায়ত্রীর এমন অবান্তর কথা শুনে মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। একটু তিরিক্ষে মেজাজে বলে, কবিতা কোনো মেয়ে নয়।’
    ‘তাহলে কি ছেলে?’
    ‘কবিতা মেয়েও নয়, ছেলেও নয়। কবিতা কবিতা।’
    ‘কীসব হেঁয়ালি করছ।’
    ‘কবিতা বোঝ না! মাধ্যমিক পাশ করেছ যে! বইতে কবিতা পড়োনি?’
    ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এবার একটু লজ্জা পায় গায়ত্রী। মেজাজটা সামলে নিয়ে বলে, ‘কার কবিতার খাতা?’
    ‘কার আবার, আমার।’
    গায়ত্রী চরম বিস্ময়ের সুরে বলে, তোমার কবিতার খাতা! তুমি কবিতা লেখ?’
    ‘কেন, আমার কি কবিতা লিখতে মানা?’
    ‘তা কেন? কিন্তু কোনোদিন তো শোনাওনি। বাসররাতেও তুমি আমায় শ্লোগান শুনিয়েছ।’
    ‘তখন লিখতাম না। পরে লিখেছি। মানে বেশিদিন হয়নি।’
    ‘তাহলেও আমাকে কোনোদিন শোনাওনি।’
    পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে প্রকাশ লাজুক সুরে বলে, তেমন কী আর লিখতে পারি। দু-চারটা কখনও-সখনও লিখেছি। তাও বলার মতো নয়। এই দেখছ না, কোথায় লিখে রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না।’
    স্বামীর দুঃখে গায়ত্রীও কিছুটা যেন সমব্যাথী হয়ে পড়ে। বলে, ‘আমি একবার খুঁজে দেখব?’
    ‘আমিই খুঁজে পাচ্ছি না, তুমি কী করে পাবে? তুমি তোমার কাজ কর। আমি খুঁজে দেখি।
   মন না চাইলেও মেনে নেয় গায়ত্রী। কিন্তু প্রকাশকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেয় বিবাহ-বার্ষিকীতে তাকে কবিতা শোনাতেই হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজি হয় প্রকাশ।

    এলাকার বিধায়ক রত্নেশ্বর হাজরা একসময় কবিতা লিখতেন। কলেজ লাইফে একটা কবিতার চক্রও ছিল তার। কিন্তু কলেজে থাকতে থাকতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কলেজ লাইফ পেরোনোর পর আর কবিতা লেখা হয়নি। তবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সভায় গেলে মাঝে মাঝে নিজের কবিতা লেখার প্রসঙ্গ তোলেন। কখনওবা নিজের দু-একটা লাইনও শুনিয়ে দেন।
    সবুজ সংঘ এলাকার প্রাচীন ক্লাব। খুব নামডাক। সারা বছর ধরে তাদের নানান সাংস্কৃতিক কর্মসূচি থাকে। তারা অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করছিল ক্লাবে একটি জিমনাসিয়াম করার। তার জন্য তারা পরিকল্পনা করেছিল এলাকার সাংসদকে বাত্সরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আনার। কিন্তু প্রপার চ্যানেলে যোগাযোগ না করতে পারলে সাংসদকে আনা সম্ভব নয়। আর সেই প্রপার চ্যানেল হল রত্নেশ্বর হাজরা। সাংসদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রত্নেশ্বরকে খুশি করতে তারা স্থির করে তাকে কবি হিসেবে সংবর্ধনা দেবে।
    প্রস্তাবটা পাওয়ার পর রত্নেশ্বরের যে লোভ হয় না তা নয় কিন্তু মাস কয়েক পরে ভোট। তিনি বোঝেন তাকে যদি এই সম্মান দেওয়া হয় বিরোধীরা এই নিয়ে ব্যাঙ্গ করবে, বিরূপ প্রচার করবে। তাই তিনি রাজি হন নাওদিকে উদ্যোক্তারাও মরীয়া, রত্নেশ্বরকেই কবি-সংবর্ধনা দেবে। অনেকবার না বলা সত্ত্বেও যখন তারা নাছোড়বান্দা তখন রত্নেশ্বর বলেন, তিনি সম্মাননা নিতে পারবেন না বদলে তার কোনো প্রিয় মানুষকে এই সম্মান দেওয়া হোক সেটাই তার সম্মানপ্রাপ্তি। সংঘের সদস্যদের কোনো আপত্তি ওঠে না। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য রত্নেশ্বরকে খুশি করা। রত্নেশ্বরের কাছে তারা জানতে চায় তার প্রিয় মানুষের কথা।
    মাস কয়েক পরে ভোট। এই ভোটে ভালো ফল করতে গেলে প্রকাশকে যে হাতে রাখা দরকার সেটা রত্নেশ্বর বোঝেন। এমনিতে যা অবস্থা তাতে প্রকাশ যদি হাত ফস্কে বেরিয়ে যায় তাহলে খুব সমস্যায় পড়তে হবে। তাকে খুশি করতে তার নামটাই প্রস্তাব করে রত্নেশ্বর। তার ধারনা ছিল প্রকাশ যেহেতু এত সুন্দর শ্লোগান লেখে, নিশ্চয়ই তার কবি-প্রতিভা আছে। প্রকাশ-অপ্রকাশ যে নামই হোক তাতে সবুজ সংঘের আপত্তি নেই। তাদের দরকার রত্নেশ্বরের কৃপা। তাই তার কথাই সংবর্ধনার মাপকাঠি হয়ে যায়।
   
    সভার শেষ অনুষ্ঠান, সম্মাননা জ্ঞাপন পর্ব। প্রকাশের বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করতে থাকে। সামনে প্রচুর দর্শক। এর মধ্যে তারও লোক রয়েছে অনেক। পাঁচটা মারুতি ভর্তি করে লোক এনেছে সে।
    প্রকাশকে উত্তরীয়, শাল, মেমেন্টো দেওয়া হয়। ক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মানপত্র পাঠ করে তার হাতে তুলে দেয়। এরপর ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় কিছু বলার জন্য।
    কথা শুরু করতে একটু সময় নেয় প্রকাশরাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ায় সে দক্ষ। কিন্তু এই অনুষ্ঠান অন্য ধরনের। প্রাথমিকভাবে ক্লাব ও সদস্যদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে নিজের অনুভূতির কথা বলতে শুরু করে। কথা বলতে বলতে একটা সময় ফ্লো এসে যায়।
    ক্রমশ বক্তব্যের শেষ দিকে চলে আসে প্রকাশ। দীর্ঘ্য অভ্যাসবশত কিছুটা রাজনৈতিক ঢংয়ে সে বলে চলে, বর্তমানে একটা খারাপ সময়ে মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। চারিদিক অনাচার, অনাসৃষ্টি। সমাজে বিশৃঙ্খল অবস্থা। সমাজকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করতে অসির চেয়ে মসীই বেশি দরকার। আর এই মসী অর্থাৎ কলম নিয়ে যারা কাজ করেন সেইসব কবি-সাহিত্যিকদের সমাজে এখন বেশি দরকার। আমাদের উচিত এই সব কবি-সাহিত্যিকদের হাত...
    ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’ হাতের সঙ্গে এই শ্লোগানে অভ্যস্ত শাকরেদরা হাত’ শোনামাত্রই পেছন থেকে এই আওয়াজ তুলে দেয়
    প্রকাশ থমকে যায়। বুঝতে পারে গণ্ডগোলটা কোথায়। তাদের ভুল ভাঙানোর জন্য বলতে যায়, কবিদের হাত শক্ত করতে হবে।’ কিন্তু শক্ত পর্যন্ত গিয়ে আর এগোতে পারে না। পেছন থেকে আওয়াজ আসে...
‘শক্ত হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’
    ‘কবিদের শক্ত হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।’
    থমকে যায় প্রকাশ। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব। সকলের নজর প্রকাশের দিকে। তার প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে গেছেমেজাজ গরম হয়ে যায় তার। নিজের লোকেদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, দূর হটো।’
    পেছনে আওয়াজ ওঠে—দূর হটো, দূর হটো।’
    ‘কবিরা দূর হটো
    প্রকাশ বিপর্যস্ত। ওদিকে পেছন থেকে সম্মিলিত শ্লোগান ভেসে আসতে থাকে...
    ‘কবিদের শক্ত হাত... ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।’
    ‘কবিরা দূর হটো...দূর হটো, দূর হটো।’
    প্রকাশের হাতে আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আয়োজক সংস্থার মুখেও চুনকালি পড়ে গেছে। কিন্তু উপস্থিত জনতার মেজাজ গরম হয়ে যায়। প্রকাশের লোকেদের সঙ্গে প্রথমে তর্কাতর্কি পরে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। দু-একজন প্রকাশকে লক্ষ করে জুতো ছুঁড়তে থাকে। একটা গিয়ে লাগে তার মাথায়। অবস্থা বেগতিক দেখে মানপত্র মেমেন্টো সব ফেলে মঞ্চ থেকে নেমে পেছন দিকে দৌড় লাগায় প্রকাশ
   

প্রবন্ধ


দক্ষিণ আফ্রিকা : গান্ধিজির দ্বিতীয় স্বদেশ
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম সেনানী হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যিনি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত গান্ধিজি ও মহাত্মা গান্ধি নামে শুধু তাই নয়, তিনি আমাদের জাতির জনক কালো, শীর্ণকায়, অতি সাধারণ বেশভূষার মানুষটির জীবনের পরম ধর্ম ছিল সততা ও অহিংসা ভারত মায়ের কোলে তাঁর জন্ম। এই দেশ তাঁর জন্মভূমি, তাঁর স্বদেশ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলেন তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। সততা আর অহিংসাকে হাতিয়ার করে সারাজীবন লড়াই করেছেন তিনি। নিজেকে নিয়ে গেছেন এক সুমহান উচ্চতায়। মানুষের মাঝে তাঁর প্রভাব ছিল অপরিশীম। তিনি ডাক দিলে আসমুদ্র হিমাচলের লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামত, তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। এই যে ‘নেতা’ গান্ধিজি, তাঁর জন্ম কোথায়? উত্তরটা অবশ্যই ভারতবর্ষ নয়। এই গান্ধিজির জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাই বলা যেতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা হল ‘নেতা’ গান্ধিজির জন্মের আঁতুড়ঘর, তাঁর দ্বিতীয় জন্মভূমি।
    দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধিজির কাছে কেবল একটি দেশ কিংবা মহাদেশ নয়। বলা যেতে পারে এটি তাঁর আর এক স্বদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটানো তাঁর ২১ বছরের কার্য্যকলাপ পর্য্যালোচনা করলে একথা সহজেই প্রমাণিত হয়। তবে এ শুধু আমার কথা নয়। গান্ধিজি নিজেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাঁর স্বদেশ মনে করতেন। তাঁর নানান বক্তব্যে এই কথা বারবার উঠে এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, সেখানে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ও বিকাশের কথা, নতুন জীবন-দর্শনের জন্মকথা বারে বারে তিনি ব্যক্ত করেছেন নানাভাবে। উল্টোদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষও গান্ধিজিকে বিদেশী বলে ভাবতেন নাতারা দাবি করত, দক্ষিণ আফ্রিকাই পরবর্তী জীবনের এক আসামান্য দেশনায়ক তথা নেতা গান্ধিজির জন্ম দিয়েছে। গান্ধিজি তাদের এই দাবিকে সারাজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে Dr. Dadoo ও Dr. Naicker তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের তিনি বলেনছিলেন, “Truly speaking, it was after I went to South africa that I became what I am now. My love for South Africa and my concern for the problem are no less than for India...”
    উভয়পক্ষের এই বক্তব্য কি কেবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ নাকি এর মধ্যে গভীর বাস্তবতা রয়েছে. গান্ধিজি বললে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বল্পবাস পরিহিত, শীর্ণকায় ও লম্বা-চওড়া মানুষ যিনি সত্য আর আহিংসাকে হাতিয়ার করে জীবনের এক বৃহৎ লড়াই লড়েছেন। সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এক নতুন বার্তা, জীবনকে চিনততে শিখিয়েছেন নতুন আলোয়। সাধারণের মাঝেও যে অসাধারণত্ব রচণা করা যায় তা তিনি শিখিয়েছেন। এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মানুষের মাঝে নিজের জীবনকেই বাণী করে তুলেছেন। গান্ধি চরিত্রের এই দিকটির জন্ম খুঁজতে গেলে অবশ্যই আমাদের পাড়ি দিতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকায়।
    সাল ১৮৯১। বিলেতে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন গান্ধিজি। রাজকোট ছেড়ে তিনি মুম্বাই যান ওকালতি প্রাকটিশ করার জন্য। কিন্তু লাজুক স্বভাবের জন্য এই পেশায় তিনি সফল হন না। অবস্থা এমন জায়গায় দাঁড়ায় যে তিনি ওকালতি ছেড়ে শিক্ষকতা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্রাজুয়েট না হওয়ায় শিক্ষকও হতে পারেন না। কর্মময় জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতার হাহাকার পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনায় মানসিকভাবে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ঠিক এমনসময় কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর কাছে সুযোগ এসে যায় দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দেওয়ার।
    দক্ষিণ আফ্রিকায় অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী দাদা আবদুল্লা শেঠ এর ওখানে শেঠ তৈয়বজী নামে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাদের একটি মামলা চলছিল বড়ো বড়ো উকিলরা দাদা আবদুল্লার কেস লড়ছিলেন কৌঁসুলীদের তাদের কেস বোঝানোর জন্য তাদের এক আইন-প্রতিনিধির প্রয়োজন হয়গান্ধিজির কাছে এই প্রস্তাব আসার পর তিনি তা গ্রহণ করেন। করেন স্থির হয় গান্ধিজিকে সেখানে এক বছর থাকতে হবে থাকা খাওয়ার খরচ বাদে বার্ষিক ১০৫ পাউন্ড দেওয়া হবে, এই চুক্তিতে এক বছরের জন্য সেখানে যান গান্ধিজি।
        ১৮৯৩ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার নাতালে পৌঁছোন গান্ধিজি। এখানে আসার পরপরই তিনি এখানকার ভারতীয়েদর চরম দূর্দশার চিত্রটা দেখতে পান। যাত্রাপথে তাঁকে নানান অপ্রীতিকর ও অপমাননাকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। প্রথম শ্রেণির টিকিট থাকা সত্বেও রেলে নাতাল থেকে প্রিটোরিয়া যাওয়ার পথে এক শেতাঙ্গ তাকে জোর কের তার কামরা থেকে নীচে নামিয়ে দেন। ব্যাপারটা গান্ধিজিকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। কিন্তু ওই আঘাতই তাঁর মনে সত্যাগ্রহী ভাবনার সূচনা করে। ড. জন মটকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে এই প্রসঙ্গে তিনি বলেনছেন, "I was afraid for my very life... What was my duty, I asked myself. Should I go back to India, or should I go forward, with God as my helper, and face whatever was in store for me? I decided to stay and suffer. My active non-violence began from that date.”
    এখানকার ভারতীয়দের দূর্দশা তাঁকে ব্যাথিত করে। এই নিয়ে প্রতিবাদ করার জন্য তিনি একটি সভা ডাকেন। এই সভাই আগামী দিনে তার জীবনপথকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল কেননা এই সভাই এক নেতার অভিষেক ঘটিয়েছিল। যাই হোক, দাদা আবদুল্লার যে কেসটি অনেকদিন ধরে আদালতে চলেও কোনো সমাধান হচ্ছিল না, সেই সমস্যা তিনি আপোশের মাধ্যমে সমাধান করেন। ব্যাপারটা সহজ ছিল না তবে শেষপর্যন্ত তিনি সফল হয়েছিলেন। এই সাফল্য তাঁর জীবনের বিরাট জয়। এর মাধ্যমে তাঁর অহিংসা শক্তি ও নেতৃত্ব গুণ পরিস্কারভাবে পরিস্ফূট হয়।
    এক বছরের মেয়াদ শেষে গান্ধিজি দেশে ফেরার আগে তাঁর জন্য একটি বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেন দাদা আবদুল্লা। সেই সভায় Natal Mercury নামক কাগজের একটি খবর দেখে তিনি চমকে ওঠেন। নাতাল বিধানসভার সদস্য নির্বাচনে সেখানকার ভারতীয়দের ভোটাধিকার বাতিল করার জন্য Franchise Bill নামে একটি বিল পেশ করা হয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন এই আইন যদি পাশ হয় তাহসে এখানকার ভারতীয়দের জীবনে চরম দুর্দশা নেমে আসবে। উপস্থিত মানুষদের কাছে তিনি এই আইনের ভয়ংকর দিক তুলে ধরেন। সব শুনে উপস্থিত অতিথিরা তাঁকে অনুরোধ না করে এখনি দেশে ফিরে না গিয়ে কয়েক মাস এখানে থেকে যেতে। তারা কথা দেন, এই বিষয়ে তারা গান্ধিজির নির্দেশমতো তারা কাজ করবেন। সকলের আবেদনে সাড়া দিয়ে গান্ধিজি দেশে ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করেন। বিদায় সংবর্ধনা সভা বদলে হয়ে যায় স্বাগত জানানোর সভা। উপস্থিত মানুষেরা গান্ধিজিকে তাদের নেতারূপে মেনে নিয়ে প্রিটোরিয়ার বুকে ঘটতে চলা আগামী আন্দোলেন তাকে স্বাগত জানান। শুরু হল গান্ধিজির আর এক নতুন জীবন।
    প্রতিবাদ হলেও শেষমেষ বিল পাশ হয়ে যায়। তবে আন্দোলন থেমে থাকে না। গান্ধিজি বুঝতে পারেন দীর্ঘমেয়াদি এই আন্দোলন চালাতে গেলে একটি স্থায়ী কমিটি দরকার। তাঁরই পরামর্শমতো ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দেক ২২ মে গঠিত হয় নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস। গান্ধিজি এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভারতীয়দের ভোটাধিকার বাতিলের পাশাপাশি এখানকার ভারতীয় শ্রমিকদের ওপর অন্যায়ভাবে যে কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধেও তাঁরা প্রতিবাদ করতে থাকেন।
    ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি দেশে ফেরেন স্ত্রী-পুত্রদের দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখানে যে কয়েকমাস ছিলেন, সেখানেও তিনি চুপ করে থাকেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের দূর্দশা নিয়ে পুস্তিকা লেখেন। এখানকার বড়ো বড়ো নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। সভা-সমিতিতে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে চাঁচাছোলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন। এখানকার পত্রপত্রিকায় তার বক্তব্য প্রকাশিত হতে থাকে। কলকাতায় সভা করার আগে নাতাল থেকে জরুরি তারবার্তা আসে ফিরে যাওয়ার জন্য।
    স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক ভাগ্নেকে নিয়ে ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছোন গান্ধিজি। কিন্তু নানান অজুহাত দেখিয়ে তাদের নামার অনুমতি দেয় না সরকার। এমনকি ক্রুদ্ধ ইউরোপীয়রা হুঁশিয়ারি দেয় ফিরে না গেলে জাহাজে আগুন লাগিয়ে দেবে কিংবা ডুবিয়ে দেবে। কিন্তু গান্ধিজিরা নামতে মরীয়া ছিলেন। প্রায় ২৩ দিন জাহাজে কাটানোর পর অবশেষে নামার অনুমতি মেলে। পরিস্থিতি খারাপ থাকায় গান্ধিজি স্ত্রী পুত্রেদর নিজের বাড়িতে না পাঠিয়ে বন্ধু পার্সি রুস্তমজীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি যখন সে পথেই যান, তখন একদল বিক্ষুব্ধ ইউরোপীয় তাকে আক্রমণ করে। এতটাই আঘাত পান যে কিছু সময় জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল তিনি বোধহয় বেঁচে ফিরতে পারবেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে যিনি জাতির নায়ক হবেন তাঁকে মেরে ফেলবে কে. অশ্চর্যজনকভাবে তিনি সেখান থেকে রুস্তমজীর বাড়ি পৌঁছোন। সেখানেও একদল বিক্ষুব্ধকারী জড়ো হয়ে গান্ধিজিকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। পুলিশ সুপারিনটেন্ডেট মিঃ আলেকজান্ডার অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ছদ্মবেশ পরিয়ে গান্ধিজিকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। গান্ধিজির ওপর এই আক্রমণে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ মন্ত্রী মিঃ চেম্বারলেন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এই ঘটনায়তিনি নাটাল সরকারের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে নির্দেশ দেন এমন নিন্দনীয় ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু গান্ধিজি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান না। কেননা ইতিমধ্যেই তিনি বুঝেগিয়েছিলেন যে অহিংসাই হল বড়ো শক্তি, শাস্তি দেওয়ার বড়ো মাধ্যম। তাঁ এই সিদ্ধান্তে চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। শুরু হয় গান্ধিজির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
    দ্বিতীয়বার দ্বিতীয়বার দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান কালে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল বোর যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা। ১৮৯৯-১৯০২ দ্বিতীয় বোর যুদ্ধ হয়েছিল ইংরেজ এবং বুয়রদের মধ্যে এটি অ্যাংলো-বুয়র ওয়ার কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকান ওয়ার নামেও পরিচিত। এই সময় গান্ধিজি একটি সেবাদল গঠন করেছিলেন এবং ইউরোপীয়দের হয়ে কাজ করেছিলেন তাঁর কাজ ইউরোপীয়দের দ্বারা প্রশংসিতও হয়েছিল এবং তিনি পদকও পেয়েছিলেন তাঁর এই ভূমিকা নিয়ে পরে অনেক বিতর্ক হয়েছে। একই বিতর্ক হয়েছিল জুলু বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয়দের প্রতি তাঁর সহযোগিতায়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় জুলু বিদ্রোহ। অমানুষিক করের প্রতিবাদে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জুলু সম্প্রদায়। ইংরেজরা নির্মমভাবে তাদের এই বিদ্রোহ দমন করে। এই সময় আহতদের সেবা করার জন্য গান্ধিজি একটি স্ট্রেচার বাহিনি গঠন করেন এবং ইউরোপীয়দের হয়ে কাজ করেন। এমনকি ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’-এ কলাম লিখে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের আহ্বান জানান ব্রিটিশ হয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে।
    পরবর্তীকালে গান্ধিজি তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন বুওর ও জুলুদের প্রতি তার কোনো রাগ ছিল না। তাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। তবুও ইউরোপীয়দের সহযোগিতার পেছনে তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের অধীন। সেই হিসেবে ভারতীয়রা ইংরেজদের প্রজা। একজন দায়িত্বশীল প্রজা হিসেবে তিনি শাসকের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করেছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন ভারতীয়রা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান। তাঁর এই ব্রিটিশ আনুগত্য নিয়ে তুমল সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু গান্ধিজির দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে সত্যিকার ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। যদি তিনি তাদের হয়ে কাজ না বোর কিংবা জুলুদের পক্ষে দাঁড়াতেন, তাহলে তা হত শাষকের প্রতি আনুগত্যহীনতা যা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে পড়ত। তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের অধিকার রক্ষার তার যে লড়াই সেটা ব্যর্থ হত। কেননা রাষ্ট্রের অধিকার পেতে গেলে রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অনুগত হতে হবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সেটা পাওয়া সম্ভব নয়।
    তাঁর সর্বান্তকরণ প্রচেষ্টা ছিল ভারতীয়দের দূর্দশা মোচন করা। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। তবে সেবার কাজ প্রশংসিত হলেও যে উদ্দেশ্যে তিনি এটা করেছিলেন সেটা হয়নি। ভারতীয়েদর প্রতি ইউরোপীয়দের অবমাননা, নিগ্রহ, অসম্মান প্রভৃতি বেড়েছে বই কমেনি। বুওর যুদ্ধের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেখানকার মানুষেরা তাঁকে প্রথমে আসতে দিতে চাননি। তবে প্রয়োজন পড়লে গান্ধিজি ফিরে যাবেন এই কথা দেওয়ায় তাঁরা গান্ধিজিকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। ১৯০১-এর শেষএর দিকে গান্ধিজি দেশে ফিরে আসেন এবং এই সময় মুম্বইতে তিনি অফিস করেন। কিন্তু পরের বছর তাঁকে পুনরায় দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে হয়। আর এই যাওয়া গান্ধিজির জীবনের এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বলা যেতে পারে এইবারের যাত্রার পর এক নতুন গান্ধিজির জন্ম হয়।
    যাই ইতিমধ্যে গান্ধিজির জীবনেও ধীরে ধীরে কিছু পরিবর্তন হতে থাকে। গান্ধিজি একসময় বিশ্বাস করতেন একজন ব্যারিস্টারকে ভালো পোশাক পরতে হবে, ভালো জায়গায় থাকতে হবে, তার জীবন-ধারা উন্নত মানের হতে হবে এবং সেইভাবেই তিনি জীবন কাটাতেন। কিন্তু ক্রমশ তাঁর সেই ভাবনার বদল হতে থাকে। এই সময় শ্রীমদ্ভগবত গীতা, প্লেটোর 'অ্যাপোলজি', জন রাসকিনের 'আনটু দিস লাস্ট', উইলিয়াম সল্টারের 'এথিক্যাল রিলিজিয়ন' প্রভৃতি বইগুলি তার মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। তিনি অন্তর থেকে অনুভব করতে থাকেন মানুষের জন্য কাজ করতে গেলে তাঁর ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন আনতে হবে। সেই মতো তিনি বিলাসিতার জীবন ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযযাপন করতে থাকেন। এই সময় গান্ধিজি তাঁর পেশায় একজন সফল ব্যাক্তি ছিলেন। তাঁর বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৫০০০ পাউন্ড। তাঁর উপার্জনের বেশিরভাগটাই তিনি মানুষের কাজে ব্যায় করতেন। এই সময় ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন নামে যে পত্রিকাটি চালু হয় তাতেও তিনি আর্থিক সাহায্য করতেন। পাশাপাশি তিনি Phoenix Settlement প্রতিষ্ঠা করেন যার উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ জীবনযাপন। তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে জোহানেসবার্গে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েসেই সময় তাদের চিকিৎসা ও সেবা করার জন্য গান্ধিজি একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।
    ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের তিনি ব্রহ্মচর্যের শপথ নেন। এর ঠিক বছর দুই পরে তিনি আইনের ব্যবসা ছেড়ে দেন এবং একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করতে থাকেন। ক্রমে ক্রমে তিনি ইউরোপীয় পোশাক বর্জন করেন। তাঁর খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন আসে।
    যাই হোক, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ট্রান্সভাল সরকার Asiatic Ordinance (Asiatic Registration Act) জারি করে। এটা কেবল ভারতীয়েদর মর্যাদা, সম্মান নষ্ট করবে না ভারতেরও মর্যাটা নষ্ট করবে। তিনি এই আইনের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই আইন যাতে না চালু করা হয় তার জন্য প্রথমে তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু একটা সময় তিনি বুঝতে পারেন এভাবে কাজ হবে না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই অবমাননাকর আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দালনে নামবেন।  এই আইনের খারাপ দিক তিনি মানুষের কাছে তুলে ধরেন এবং তাদের আবেদন জানান এই আন্দালেন সামিল হতে। ভারতীয়রা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন। গান্ধিজিকে নেতা মেনে তাঁরা তার দেখানো পথে আন্দোলেনর শপথ নেন। গান্ধিজি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এই আন্দালন কোনোমতেই সহিংস নয়। তিনি তাদের বলেন, পুলিশ তাদের গ্রেপ্রাত করতে পারে, তাদের ওপর অত্যাচার করতে পারে, আরও অনেক সমস্যা আসতে পারে। কিন্তু যযত সমস্যাই আসুক না কেন অহিংসার পথে থেকে এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। শুরু হয় এক নতুন লড়াই, যার নাম সত্যাগ্রহ আন্দোলন।  সেই সঙ্গে সঙ্গে সূচিত হয় গান্ধিজির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
    গান্ধিজির ডাকে হাজার হাজার মানুষ সত্যাগ্রহ আন্দোলেন সামিল হন এবং তারা এশিয়াটিক রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট মানতে অস্বীকার করে। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন পথে। শুরু হয় বিক্ষোভ, ধর্ণা প্রভৃতি কর্মসূচি। ১৯০৮-এ ১৫০ জন ভারতীয় গ্রেপ্তার হয়। ওই বছর গান্ধিজি ও আভ্যন্তরীন মন্ত্রী General Jam Smuts–এর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হলে আন্দোলন সাময়িক বন্ধ হয়। কিন্তু সরকার এই আইন বাতিল করতে রাজি না হওয়ায় পুনরায় সত্যাগ্রহ শুরু হয় এবং দু-হাজার মানুষ কারাবরণ করে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে আবারও সত্যাগ্রহ আন্দোলন বন্ধ থাকে। এই সময় ইউনিয়ন অব সাউথ আপ্রিকা গঠিত হয়। আশা করা হয়েছিল কিছু একটা বোঝাপড়া হবে কিন্তু তা হয় না। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় দফা সত্যাগ্রহ শুরু হয়। এবার গান্ধিজি মহিলাদেরও এই আন্দোলনে সামিল হতে আহ্বান জানান। শ্রমিকদের বলেন হরতাল করতে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না ৩ পাউন্ড কর বাতিল হয়। মানুষ কেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেছিল তা গান্ধিজির একটি বক্তব্যে পরিস্কার হয়ে যায়...“The whole community rose like a surging wave. Without organisations, without propaganda, all nearly 40,000 courted imprisonment. Nearly ten thousand were actually imprisoned…”
    নিউ ক্যাসেল থেকে ট্রান্সভাল সীমা পর্যন্ত ২২০০ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পদযাত্রায় গান্ধিজি নেতৃত্ব দেনএই পদযাত্রায় গান্ধিজির স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধিও পথে নেমেছিলেন। এই সময় চতুর্থবারের জন্য জেলে যান। এই সময় নাটালে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল করে। এমন হরতাল এর আগে নাটালে দেখা যায়নি। হাজার হাজার মানুষ বন্দী হয়। তাদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার হতে থাকে। অনেককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাও করা হয়। গান্ধিজির অহিংস প্রভাব এমন ছিল যে তিনি বা নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার হলেও সাধারণ মানুষ নিয়মানুবর্তী ভাবে অহিংস নীতির পক্ষে থেকে আন্দোলন করে গেছে। বহু ইউরোপীয়ও গান্ধিজির এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। যাই হোক, অবশেষে চাপের কাছে নতি স্বীকার করে জেলরেল স্মাট গান্ধিজির সঙ্গে চুক্তি করেন এবং সত্যাগ্রহীদের সমস্ত দাবি মেনে নেন। ভারতীয়দের ওপর চাপানো বাড়তি কর প্রত্যাহার করা হয়। ভারতীয় রীতিতে হিন্দু, মুসলমান ও পার্সিদের বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জয় হয় সত্যাগ্রহের, সেই সঙ্গে গান্ধিজির বিশ্বাসের। এই জয় তাঁর মনের মধ্যেকার এই বিশ্বাসকে আরও জোরদার করে যে, অহিংসা ও সত্যকে হাতিয়ার করে যে কোনো বড়ো লড়াই সম্ভব। পরবর্তী সময়ে তাঁর এই বিশ্বাসের প্রতিফল দেখতে পাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে।
    অবশেষে ১৯১৪-এর ১৮ জুলাই পাকাপাকি ভাবে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন গান্ধিজি। প্রথমবার যখন গিয়েছিলেন তখন ছিলেন কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এক মানুষ, যার নিজের প্রতি বিশ্বাসটাই ঠিকঠাক ছিল না। আর শেষবার যখন ফিরলেন তখন তিনি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সম্পূর্ণ এক অচেনা মানুষ যিনি একক দক্ষতায় হাজার হাজার মানুষকে একসূত্রে বেঁধে ফেলতে পারেন, তাদের নির্দিষ্ট লক্ষপথে চালিত করতে পারেন। শুধু তাই নয়, ফেরার সময়ে সঙ্গে নিয়ে এলেন নতুন জীবন দর্শন, অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নীতি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের জন্য যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য দরকার এটা তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসেই অনুধাবন করেত পেরেছিলেন। আর নারীরা কেবল চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থাকার নয়। দেশমাতৃকার সেবার মতো বৃহৎ কাজে তাদেরও যে প্রয়োজন এই ভাবনা আর বিশ্বাস নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে করে। তিনি গিয়েছিলেন একজন সাদামাটা ব্যারিস্টার হয়ে, যার বাইরেটায় ছিল জাঁকজমক ভেতরে ছিল একরাশ দুর্বলতা। কিন্তু ফিরলেন এমন একজন মানুষ হয়ে যিনি বহিরাঙ্গে অতি সাধারণ কিন্তু ভেতরে এক অনন্য অসাধারণত্বে ভরপুর। সর্বোপরি তিনি গিয়েছিলেন একজন সাদামাটা মানুষ হয়ে আর ফিরে এলেন একজন নেতা হয়। এমন একজন নেতা যাঁর অহিংসআর সত্যাগ্রহ নীতি পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক নতুন ইতিহাস রচনা করে। এসব দিয়ে বিচার করলে এটা প্রমাণিত হয় যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় এক নতুন গান্ধিজির জন্ম হয়েছিল। সেই অর্থে দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধিজির আর এক জন্মভূমি। আর দীর্ঘ্য ২১ বছর সেখানে অবস্থান কালে তিনি সেখানকার মানুষদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন। সেখানকার মানুষেরাও তাঁকে বিদেশী না ভেবে তাঁকে নিজেদেরই একজন মনে করত। তাই দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল গান্ধিজির দ্বিতীয় স্বদেশ, একথা বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।