Monday, April 13, 2020

অনুবাদ

অপরাজিতা
মুল গল্প : দ্য আনকনকার্ড (The Unconquered)
ডব্লিউ সামারসেট মম

অনুবাদ : সৌরভকুমার ভূঞ্যা


হান্স রান্নাঘরে ফিরে এল লোকটি তখনও মেঝের সেই জায়গায় পড়েছিল যেখানে হান্স তাকে আঘাত করেছিলতার মুখ ছিল রক্তাক্ত। সে গোঙাচ্ছিল মহিলাটি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সে হান্সের বন্ধু উইলির দিকে তাকিয়েছিল যখন হান্স ঘরে এল মহিলাটি শ্বাস ছাড়ল এবং কান্নায় ভেঙে পড়ল। উইলি হাতে রিভালবার নিয়ে টেবিলের পাশে বসেছিল তার পাশের মদের গ্লাসটি ছিল আর্ধেক খালি হান্স টেবিলের কাছে গেল, গ্লাস ভর্তি করল এবং একনিঃশ্বাসে শেষ করল।
    উইলি বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘বন্ধু, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছো
    হান্সের মুখে ছিল রক্তের দাগ এবং সেখানে দেখা যাচ্ছিল হাতের ধারালো নখের পাঁচটি গভীর ক্ষত। সে খুব সাবধানে তার গালে হাত রাখল।
    ‘সে যদি পারত, বোধহয় আমার চোখটাই উপড়ে নিত। শয়তানী! আমাকে এর ওপর কিছুটা আয়োডিন লাগাতে হবে। তবে সে এখন ঠিক আছে। যাও, এবার তোমার পালা।’
    ‘আমি বুঝতে পারছি না যাবো কিনা দেরি হয়ে যাচ্ছে
    ‘বোকার মতো কথা বল না তুমি একজন পুরুষমানুষ তাই নয় কী? দেরি হলে কী যায় আসে? আমরা আমাদের পথ হারিয়েছি
    তখনও আলো ছিল এবং পশ্চিমি সূর্য খামারবাড়ির রান্নাঘরের জানালায় কিরণ ঢেলে দিয়েছিল। উইলি একমুহূর্ত ইতস্তত করল। সে ছিল কালো, পাতলা মুখের বেঁটেখাটো মানুষ। স্বাভাবিক জীবনে সে ছিল একজন পোশাক ডিজাইনার। হান্স তাকে মেয়েলি ভাবুক এটা সে চায় না। সে উঠে পড়ে এবং যে দরজা দিয়ে হান্স বেরিয়ে এসেছিল সেই দিকে যায়স্ত্রীলোকটি যখন দেখতে পেল উইলি কী করতে যাচ্ছে, আর্তনাদ করে সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘না, না।’
    হান্স এক লাফে তার সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁধটা ধরে তাকে জোর করে পেছন দিকে সরিয়ে দিল। মহিলাটি টলমল করতে করতে পড়ে গেল। হান্স উইলির রিভালবারটা নিল। জার্মান বাচনভঙ্গিমাখা ফরাসিতে সে কর্কশভাবে বলল, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো দুজনে।’ তারপর দরজার দিকে ইশারা করে উইলিকে বলল, ‘তুমি যাও। আমি এদেরকে দেখে নেব।’
    উইলি বেরিয়ে যায় কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে।
    ‘মেয়েটির জ্ঞান নেই
    ‘তাতে কী যায় আসে’ হান্স বলল।
    ‘আমি পারব না। এটা ভালো নয়।’
    ‘নির্বোধ কোথাকার! মেয়েছেলে!’
    উইলির মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল।
    ‘আমাদের চলে যাওয়াটাই ভালো।’
    হান্স ঘৃণা সহকারে তার কাঁধ নাড়াল। ‘আমি আগে মদের বোতলটা শেষ করব, তারপর যাবো
    হান্সের খুব আরামবোধ হচ্ছিল এবং দেরি করতে ভালো লাগছিলসকাল থেকে সে কাজ করে চলছে। অনেকটা সময় মোটর সাইকেল চালানোর পর তার শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছিল। সৌভাগ্যবশত তাদের আর বেশিদূর যেতে হবে না। সইসনস এখান থেকে দশ-পনেরো কিলোমিটার দূরে। সে কল্পনা করছিল যদি ঘুমোনোর জন্য একটি বিছানা পাওয়ার সৌভাগ্য এখন হত
    অবশ্যই এসব কিছু ঘটত না, যদি না মেয়েটি বোকামি করতহান্স ও উইলি পথ হারিয়েছিল। মাঠে কর্মরত একজন কৃষককে তারা পথ জানতে চেয়েছিল কিন্তু সে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ভুল পথ দেখিয়ে দেয়ফলে মূল রাস্তা ছেড়ে তারা পাশের রাস্তায় চলে আসে। যখন তারা এই খামারের সামনে আসে, তারা সঠিক রাস্তা জানার জন্য দাঁড়ায় তারা খুব বিনয়ের সঙ্গেই জানতে চেয়েছিল কেননা তাদের ওপর নির্দেশ ছিল যতক্ষণ ফরাসিরা ভদ্র ব্যবহার করবে ততক্ষণ তারা যেন তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়একটি মেয়ে দরজা খুলে জানায় সে সইসনসের রাস্তা জানে না। তখন তারা দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। একটি স্ত্রীলোক, হান্সের অনুমান সম্ভবত মেয়েটির মা তাদের রাস্তা বলেছিল। কৃষক, তার স্ত্রী এবং তাদের মেয়ে, তিনজনে সবে তখন রাতের খাওয়া শেষ করেছে এবং টেবিলের ওপর এক বোতল মদ ছিল। মদটা দেখে হান্সের মনে পড়ল যে সে শয়তানের মতো তৃষ্ণার্ত। সারাদিন তাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে এবং দুপুর থেকে সে কিছু পান করেনি। হান্স তাদের বলল এক বোতল মদ দিতে এবং উইলি জানালো এর জন্য তারা ভালো মূল্য দেবে। উইলি ছিল বেঁটেখাটো, ভালো মানুষ এবং নরম স্বভাবের। সর্বোপরি, তারা বিজেতা। হঠকারী যুদ্ধে ফরাসি সেনাবাহিনী কোথায়? ইংরেজরা তাদের সবকিছু ফেলে দিয়ে খরগোশের মতো দ্রুত দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বিজেতারা যা চায় তাই নেয় না কি? কিন্তু উইলি প্যারিসের পোশাক দোকনে দু-বছর কাজ করেছে। এটা সত্যি সে ফরাসিটা ভালো বলতে পারে। এই কারণে সে বর্তমান কাজটায় আছে কিন্তু প্যারিসে থাকা তার মধ্যে কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। একজন অধঃপতিত মানুষ। কোনো জার্মানের পক্ষে ফরাসিদের মধ্যে বাস করাটা ভালো নয়।
    কৃষকের স্ত্রী টেবিলে দু-বোতল মদ রাখল এবং উইলি পকেট থেকে কুড়ি ফ্রাংক বের করে দিল। তাসত্ত্বেও মহিলাটি তাকে ধন্যবাদ জানায় না। হান্সের ফরাসি ভাষাজ্ঞান উইলির মতো ভালো ছিল না। তবে সে বুঝতে পারত তারা নিজেদের মধ্যে সবসময় ফরাসিতে কথা বলত। উইলি তার ভুলগুলো শুধরে দিত। এই কাজে উইলি খুব প্রয়োজনীয় হওয়ার কারণে সে তাকে বন্ধু করেছিল। হান্স জানত উইলি তার তারিফ করে কারণ সে ছিল লম্বা, ছিপছিপে, চওড়া কাঁধওয়ালা। তার কোঁকড়ানো চুলগুলো ছিল খুব সুন্দর এবং চোখগুলো ছিল নীল। হান্স ফরাসি অনুশীলনের কোনো সুযোগ হারাতে চাইত না। সে কথা বলতে চাইল কিন্তু সেই তিনজন ফরাসি মানুষ তার সঙ্গে সঙ্গ দিল না। হান্স তাদের জানাল যে সে নিজেও কৃষকের সন্তান এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সে আবার খামারে ফিরে যাবে। তাকে মিউনিখের স্কুলে পাঠানো হয়েছিল কেননা তার মা চেয়েছিল সে ব্যবসা করুক কিন্তু ব্যবসায়ে তার মন ছিল না। তাই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর সে কৃষি কলেজে ভর্তি হয়।
    মেয়েটি বলল, আপনারা পথ জানতে এসেছিলেন এবং জেনেও গেছেন মদটা খেয়ে চলে যান।’
    হান্স এর আগে তার দিকে প্রায় তাকায়নি। মেয়েটি সুন্দরী নয় কিন্তু তার কালো কালো চোখ দুটি ছিল খুব সুন্দর এবং নাকটা ছিল ঋজু। তার মুখটা ছিল বিবর্ণ। তার পরণের পোশাক ছিল সাদামাটা কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তাকে যেমনটা দেখাচ্ছিল সত্যিকার তেমন বলে মনে হচ্ছিল না। তার চেহারায় একটা স্বাতন্ত্র্য ছিল। যুদ্ধ শুরু হয়ওার পর থেকে হান্স আশেপাশে লোকেদের কাছে ফরাসি মেয়েদের কথা জেনেছে। তাদের মধ্যে নাকি এমন কিছু আছে যা জার্মানদের নেই। চতুর উইলিও এটা বলেছিল কিন্তু হান্স যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কী বোঝাতে চাইছে উইলি কেবল বলেছিল এটা তোমাকে দেখে বুঝতে হবে অবশ্যই সে অন্যদের বলতে শুনেছে যে তারা অর্থ দ্বারা প্রলুব্ধ হয় এবং খুব শক্ত-সমর্থঠিক আছে, এক সপ্তাহের মধ্যে তারা প্যারিসে যাবে এবং তখন সে নিজেই এটা খুঁজে বার করবে। তারা জেনেছিল যে লোকেরা সেখানে যাবে হাইকমান্ড ইতিমধ্যেই তাদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করেছে।
    মদটা খেয়ে চলো।’ উইলি বলে।
    কিন্তু হান্সের বসে থাকতে খুব ভালো লাগছিল এবং তার মধ্যে ব্যস্ততার কোনো লক্ষণ ছিল না।
    হান্স মেয়েটিকে বলল, ‘তোমাকে কৃষকের মেয়ের মতো দেখাচ্ছে না।’
    ‘তাতে কী?’ মেয়েটি জবাব দিল।
    ‘ও শিক্ষিকা।’ মেয়েটির মা বলল।
    ‘তাহলে তো তোমার ভালো শিক্ষা আছে’ মেয়েটি কাঁধ ঝাঁকাল কিন্তু হান্স তার খারাপ ফরাসি উচ্চারণে খোশমেজাজে কথা চালিয়ে গেল। ‘তোমার বোঝা উচিত যা ঘটেছে ফরাসিদের পক্ষে ভালো ঘটেছে। আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করিনি। তোমরাই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলে। এখন আমরা ফ্রান্সকে সুন্দর করে গড়ে তুলব। আমরা এখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনব। আমরা তোমাদের কাজ করতে শেখাব। তোমরা মান্যতা শিখবে, নিয়মানুবর্তিতা শিখবে।’
    মেয়েটি তার মুষ্ঠি দৃঢ় করে তার দিকে তাকাল। ঘৃণায় তার চোখ কালো হয়ে উঠল। কিন্তু সে কথা বলল না।
    ‘হান্স, তুমি মাতলামি করছ।’ উইলি বলল।
    ‘আমি বিচারকের ন্যায় সংযতআমি কেবল সত্যিটা বলছি এবং এটা তাদের এখুনি জানা উচিত।’
    নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না মেয়েটি। চিত্কার করে বলে, ‘উনি ঠিক কথাই বলেছেন। আপনি মাতলামি করছেনএখনি এখান থেকে চলে যান।’
    ‘ওহ্, তুমি জার্মান বোঝ! ঠিক আছে, আমি চলে যাব। তবে তার আগে তোমাকে অবশ্যই আমাকে একটা চুমু দিতে হবে।’
    তাকে এড়ানোর জন্য মেয়েটি এক পা পিছিয়ে যায় কিন্তু হান্স তার কোমর জড়িয়ে ধরে।
    ‘বাবা, বাবা।’ মেয়েটি চিত্কার করে ওঠে।
    কৃষকটি হান্সের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হান্স মেয়েটিকে ছেড়ে দেয় কিন্তু সর্বশক্তি দিয়ে লোকটির মুখে আঘাত করে। লোকটি মেঝেতে পড়ে যায়। তারপর মেয়েটি পালিয়ে যাওয়ার আগেই হান্স তার হাত ধরে ফেলে। মেয়েটি তার গালে জোরে একটা চড় মারে। হান্স নিষ্ঠুরভাবে হেসে ওঠে
    ‘একজন জার্মান সৈনিক যখন চুমু খেতে চায় তখন তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা উচিত? তোমাকে এর মূল্য দিতে হবে।’
    সর্বশক্তি দিয়ে হান্স মেয়েটিকে পিছমোড়া করে ধরে এবং তাকে টানতে টানতে দরজার দিকে নিয়ে যায়। মেয়েটির মা দৌড়ে আসে। হান্সের কাপড় ধরে টেনে তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। হান্স এক হাতে মেয়েটিকে তার শরীরের সঙ্গে শক্ত করে ধরে অন্য হাত দিয়ে মহিলাটিকে জোর ধাক্কা দেয়মহিলাটি টলতে টলতে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খায়।
    ‘হান্স। হান্স।’ উইলি চিত্করা করে ওঠে।
    ‘চুপ কর। জাহান্নামে যাও।’
    মেয়েটির মুখে হাত চাপা দিয়ে হান্স তার চিত্কার আটকায় এবং তাকে টানতে টানতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে যায়।
   
    ‘সবকিছু এভাবেই ঘটেছিল এবং তোমাকে স্বীকার করতে হবে মেয়েটি নিজেই এমন পরিস্থিতি ডেকে এনেছিল। হান্সকে চড় মারা তার উচিৎ হয়নি। হান্সের কথামতো যদি সে তাকে একটা চুমু খেত তাহলে সে চলে যেত।’ হান্স কৃষকটির দিকে একঝলক দেখল। সে তখনও মেঝেতে পড়েছিল। তার মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি দেখে না হেসে পারল না হান্স। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে তাকিয়ে হান্সের চোখে হাসি খেলে গেল। ‘মহিলাটি কি ভয় পাচ্ছে যে এবার তার পালা!’ একটা ফরাসি প্রবচন মনে পড়ল তার
    ‘প্রথম পদক্ষেপ সবসময়ই খুব কঠিন। ওহে বুড়ি, কাঁদার মতো কিছু হয়নি। আগে হোক কিংবা পরে, এটা হওয়ারই কথা ছিল।’ প্যান্টের পেছনে হাত ঢুকিয়ে সে একটি পার্স বের করল। ‘দ্যাখো, এখানে একশো ফ্রাঁ আছে। আমার মনে হয় মহাশয়া এটা দিয়ে তার নতুন পোশাক কিনে নিতে পারবে। তার কাপড়ের বিশেষ কিছু প্রায় অস্তিত্ব নেই।’ সে নোটগুলো টেবিলের ওপর রাখলতারপর হেলমেটটা পরে নিয়ে বলল, ‘চলো যাওয়া যাক।’
    তারা সশব্দে দরজাটা বন্ধ করল এবং মোটর সাইকেলে করে চলে গেল। বয়স্কা মহিলাটি উঠে বৈঠকখানায় গেল। তার মেয়ে ডিভানের ওপর পড়েছিল। যেমনভাবে তাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনিই সে শুয়েছিল এবং খুব কাঁদছিল।

    তিনমাস পর হান্স আবারও সইসনস-এ এল। বিজয়ী সৈনিকদের সঙ্গে সে প্যারিসে ছিল এবং মোটর সাইকেলে করে আর্ক ডি ত্রোম্প-এ গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রথমে সে টুরস-এ গেছে তারপর বর্দোতেসে খুব কম লড়াই দেখেছে। সে কেবল বন্দী ফরাসি সৈন্যদের দেখেছে। এইসব অভিযানগুলির চরম উন্মত্ততা ছিল তার কল্পনার বাইরে যুদ্ধ বিরতির পর সে একমাস প্যারিসে কাটায় বাভারিয়াতে তার পরিবারে ছবির পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে এবং তাদের নানান উপহার কিনে দিয়েছে শহরটাকে হাতের তালুর মতো চেনার কারণে উইলিকে সেখানে থাকতে হয়েছে কিন্তু হান্স এবং তার দলের বাকি সব সদস্যকে সইসনসে পাঠানো হয়েছে সেখানকার বাহিনিতে যোগ দেওয়ার জন্য এটি ছিল একটি সু্ন্দর ছোট্ট শহর এবং সে একটি আরামদায়ক বাসস্থান পেয়েছিল এখানে প্রচুর খাওয়ার এবং জার্মান মুদ্রায় এক মার্কেরও কমে এক বোতল শ্যাম্পেন পাওয়া যায় হান্স যখন সেখানে যাওয়ার আদেশ পেয়েছিল তখন এটা ভেবে সে মজা পেয়েছিল যে সেই মেয়েটিকে আবারও একবার দেখতে পাবে যার সঙ্গে সে খারাপ ব্যাবহার করেছিল মেয়েটির জন্য সে একজোড়া মোজা কিনল এটা বোঝাতে যে তার মধ্যে কোনো বিদ্বেষ নেই এলাকাটি সম্পর্কে তার ভালো ধারনা ছিল এবং সে ভেবেছিল কোনো সমস্যা ছাড়া খামারবাড়িটি খুঁজে পাবে তাই এক বিকেলে, যেদিন তার কোনো কাজ ছিল না, শিল্কের মোজাগুলো পকেটে ভরে নিয়ে সে বাইকে চাপল এটি ছিল শরতের এক চমত্কার দিন আকাশে মেঘ ছিল না প্রায় এবং যে রাস্তা দিয়ে সে যাচ্ছিল তা ছিল খুব সুন্দর ও ঢেউ খেলানো শুষ্কতা এবং সৌন্দর্য এত দীর্ঘদিন ছিল যে, মাসটা সেপ্টেম্বর হলেও অমসৃণ ঝাউ গাছগুলোতেও গ্রীষ্ম শেষ হওয়ার কোনো চিহ্নই ছিল না একবার ভুল বাঁক নেওয়ার কারণে তার দেরি হল তবে সবকিছু মিলিয়ে আধঘন্টারও কম সময়ে হান্স বাড়িটা খুঁজে পেল যখন সে দরজা ঠেলে ঢুকল তখন একটি মোঙ্গল কুকুর তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠল হান্স দরজায় টোকা দিল না দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল টেবিলের পাশে বসে মেয়েটি আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল সেনার উর্দি পরিহিত লোকটিকে দেখামাত্র সে লাফিয়ে উঠল
    ‘কী চান আপনি?’ তখনই সে লোকটিকে চিনতে পারল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে ছুরিটা তুলে নিয়ে বলল, ‘ও আপনি! শুয়োর!’
    ‘উত্তেজিত হয়ো না আমি তোমাকে আঘাত করব না দেখ, আমি কিছু শিল্কের মোজা এনেছি।’     
    ‘ওগুলো নিয়ে যান এবং আপনিও এখান থেকে চলে যান।’
    ‘বোকামি কর না ছুরিটা ফেলে দাও খারাপ কিছু করতে গেলে তুমি নিজে আঘাত পাবে আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’
    ‘আমি আপনাকে ভয় পাই না মেয়েটি বলল।’
    সে ছুরিটা মেঝেতে ফেলে দিল হান্স শিরস্ত্রাণ খুলে বসল এবং সামনের দিকে পা বাড়িয়ে ছুরিটা টেনে নিল
    ‘আমি তোমার হয়ে কয়েকটা আলুর ছাল ছাড়িয়ে দেব?’
    মেয়েটি কোনো জবাব দিল না হান্স ঝুঁকে ছুরিটা তুলে নিল তারপর বাটি থেকে একটা আলু তুলে নিয়ে খোসা ছাড়াতে লাগল মেয়েটির মুখ শক্ত হল তার চোখে ফুটে উঠল ক্রোধ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে তাকে দেখতে লাগল হান্স তার দিকে তাকিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হাসল
    ‘তোমাকে এত বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে কেন? দেখো, আমি তোমার বেশি কিছু ক্ষতি করিনি সেদিন আমি উত্তেজিত ছিলাম আমরা সবাই লোকেরা অপরাজেয় ফরাসি সেনা ও ম্যাগিনট লাইনের কথা বলেছিল... মৃদু হেসে সে বাক্যটা শেষ করল, এবং মদের প্রভাব আমার মাথায় চলে গিয়েছিল তুমি আমাকে খারাপ ভাবতে পার তবে মেয়েরা বলে আমি মানুষটা দেখতে খারাপ নই
    মেয়েটি হান্সকে অত্যন্ত ঘৃণা সহকারে খুঁটিয়ে দেখল এবং বলল, এখান থেকে চলে যান
    যতক্ষণ না আমার ইচ্ছে হয়
    যদি আপনি না যান তাহলে আমার বাবা সইসনস-এ গিয়ে সেনা প্রধানের কাছে অভিযোগ জানাবে
    আমি পরোয়া করি না আমাদের ওপর নির্দেশ আছে এলাকার মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার তোমার নাম কী?’
    সেটা আপনার জানার দরকার নেই
    মেয়েটির চোখ-মুখ রক্তিম হয়ে উঠল এবং তার ক্রুদ্ধ চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল
    হান্স যতটা ভেবেছিল মেয়েটি তার থেকেও সুন্দর এতটা নিখুঁতভাবে সে আগে দেখেনি তার চেহারায় এমন কিছু আছে যা দেখে তাকে কৃষকের মেয়ের তুলনায় বেশি শহুরে মনে হয় তার মনে পড়ল মেয়েটির মা বলেছিল সে স্কুল-শিক্ষিকা সে প্রায় প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা হওয়ায় তাকে বিরক্ত করে হান্স মজা পাচ্ছিল হান্স নিজেকে শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান ভাবে সে তার সোনালী কোঁকড়ানো চুলে হাত বোলাতে লাগল। সে মুখ টিপে হাসল এটা ভেবে যে মেয়েটি যা পেয়েছে সে সুযোগ পেলে অনেক মেয়ে লাফিয়ে উঠত রোদে তার মুখটা এতটাই গভীরভাবে তামাটে হয়ে গিয়েছিল যে তার চোখদুটোকে চমকপ্রদভাবে নীল দেখাচ্ছিল
    তোমার বাবা-মা কোথায়?’
    মাঠে কাজ করছে
    আমি ক্ষুধার্ত আমাকে একটুকরো রুটি, চিজ আর এক গ্লাস মদ দাও আমি এর মূল্য দেব
    মেয়েটি কর্কশ হাসি হাসল তিন মাস হল আমরা চিজ দেখিনি নিজেদের ক্ষুধা নিবৃত্তির রুটি আমাদের নেই ফরাসিরা একবছর আগে আমাদের ঘোড়া নিয়ে চলে গেছে আর এখন জার্মানরা আমাদের গরু, শুকর, মোরগ সবকিছু নিয়ে গেছে
    ঠিক আছে তারা সেসবের জন্য মূল্যও দিয়েছে
    তাদের দেওয়া সেই অর্থহীন কাগজ কি আমরা খাব?’ সে কাঁদতে শুরু করল
    তুমি ক্ষুধার্ত?’
    না মেয়েটি তিক্তভাবে জবাব দিল আমরা রুটি, আলু ওলকপি, লটেশাক দিয়ে রাজার মতো খেতে পারি আগামীকাল আমার বাবা সইসনস যাচ্ছে কিছু ঘোড়ার মাংস কিনে আনার জন্য
    শোনো মিস আমি খুব খারাপ মানুষ নই আমি তোমাদের জন্য চিজ নিয়ে আসব এবং আমার মনে হয় একটুকরো পশুর মাংসও নিয়ে আসত পারব
    আপনার উপহারের আমার প্রয়োজন নেই যে খাওয়ার আপনারা আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছেন সে খাওয়ার স্পর্শ করার আগে আমি অনাহারে মরব
    ঠিক আছে, দেখা যাবে খোশমেজাজে সে বলল
    টুপিটা মাথায় দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল এবং মেয়েটিকে অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল

    ইচ্ছে মতো হান্স শহরে বের হতে পারলা না তাকে একটি বার্তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল দশদিন পর সে পুনরায় খামারবাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেল আগের মতো কোনো সৌজন্যতা না দেখিয়ে সে ঢুকল কৃষক ও তার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিল তখন প্রায় মধ্যাহ্ন এবং মহিলাটি স্টোভের ওপর বাটিতে কিছু একটা নাড়ছিল লোকটি আসনে বসেছিল যখন হান্স ঢুকল তখন তারা একপলক তার দিকে তাকাল কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো বিস্ময় দেখা গেল না স্পষ্টতই তাদের মেয়ে তার পূর্বের আগমনের কথা জানিয়েছিল তারা কোনো কথা বলল না মহিলাটি রান্না চালিয়ে গেল এবং লোকটি চোখে-মুখে অদ্ভুত চাউনি নিয়ে টেবিলের ওয়েল-ক্লথের দিকে চেয়েছিল কিন্তু হান্সের ধৈর্য নষ্ট করতে এর থেকে আরও বেশি কিছু দরকার ছিল
    সে আনন্দের সঙ্গে বলল, সুপ্রভাত শুনুন সবাই আমি আপনাদের জন্য একটি উপহার এনেছি
    হান্স তার সঙ্গে আনা প্যাকেটটি খুলে একটি বড়ো আকারের গ্রুয়েরি চিজ, এক টুকরো শুকরের মাংস এবং দুই টিন ভর্তি সার্ডিন বের করল স্ত্রীলোকটি ঘুরে তাকাল তার চোখে লোভের আলো দেখে হান্স হাসল লোকটি গম্ভীর মুখে খাওয়ারগুলোর দিকে তাকিয়েছিল তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসল হান্স
    আমি দুঃখিত, প্রথমবার যখন আমি এখানে এসেছিলাম তখন আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল কিন্তু আপনাদের হস্তক্ষেপ করাটা ঠিক হয়নি
    ঠিক সেই সময় মেয়েটি ঘরে ঢুকল
    আপনি এখানে কী করছেন?’ সে কর্কশভাবে চিত্কার করে উঠল তারপর তার চোখ গেল হান্সের আনা জিনিসগুলোর ওপর সে সেগুলোকে একসঙ্গে জড়ো করে তার দিকে ছুঁড়ে দিল এগুলো নিয়ে যান নিয়ে যান
    কিন্তু তার মা লাফিয়ে তার সামনে এল অ্যানিট, তুই পাগলামি করছিস
    আমি এই উপহার নেব না
    এগুলো আমাদের নিজেদেরই খাওয়ার যা ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে সার্ডিনগুলোর দিকে তাকা ওগুলো বোরদু সার্ডিন
    মহিলাটি জিনিসগুলো তুলল হান্স হাল্কা নীলাভ চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তির্যক হাসল তোমার নাম অ্যানিট, তাই না? খুব সুন্দর নাম তুমি কি তোমার বাবা-মাকে একটু খাওয়ার দিতে চাও না? তুমি তো বলেছিলে তিন মাস ধরে তোমাদের কোনো চিজ নেই আমি পশুর উরুর মাংস পাইনি আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলাম
    কৃষকের স্ত্রী মাংসের তালটি হাতে নিয়ে বুকের ওপর চেপে ধরল সে তাতে চুম্বনও করতে পারত
    অ্যানিটের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে আর্তনাদ করে উঠল, কী লজ্জা!’
    ওহ, শান্ত হও। এক টুকরো গ্রুইরি কিংবা এক টুকরো শুয়োরের মাংসে লজ্জার কিছু নেই।
    হান্স বসল এবং একটি সিগারেট ধরালো। তারপর সে প্যাকেটটি বৃদ্ধ লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিল। কৃষকটি একমুহূর্ত ইতস্তত করল কিন্তু তার মধ্যে প্রলোভন এতটাই জোর ছিল যে সে দমন করতে পারল না। সে একটি সিগারেট নিল এবং প্যাকেটটি ফিরিয়ে দিল।
    ওটা রেখে দিন। হান্স বলল। ‘আমি অনেক পেতে পারি।সে ধুঁয়োটা টেনে নিল এবং নাক দিয়ে ধুঁয়োর কুণ্ডলী বার করল। আমরা কেন বন্ধু হতে পারি না? যা ঘটে গেছে তাকে কি ভোলা যায় না? যুদ্ধ যুদ্ধই। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি? আমি জানি অ্যানিট শিক্ষিত মেয়ে এবং সে আমার কথা বুঝবে আমার মনে হয় আমরা বেশ কিছুটা সময় সইসনস-এ থাকব এবং আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমি মাঝে মাঝে কিছু জিনিস নিয়ে আসব। আপনারা তো জানেন এই শহরের মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য আমরা সবকিছু করতে পারি কিন্তু তারা আমাদের তা করতে দেবে না। এমনকি আমরা যখন রাস্তায় তাদের পাশ দিয়ে যাই তারা আমাদের দিকে তাকায়ও না। সর্বোপরি, উইলির সঙ্গে যখন আমি এখানে এসেছিলাম তখন যা ঘটেছিল তা ছিল একটি দূর্ঘটনা। আমাকে আপনাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অ্যানিটকে আমি নিজের বোনের মতো সম্মান করব।
    কেন আপনি এখানে আসতে চান? কেন আপনি আমাদের একা থাকতে দিচ্ছেন না?’ অ্যানিট জিজ্ঞেস করে
    সত্যিই হান্স জানত না কেন সে আসে। সে এটা বলতে পারে না যে সে মানুষের একটু বন্ধুত্ব চায়। সইসনস-এ তার চারিদিকের ভীষণ প্রতিকূলতা তাকে কখনও কখনও এতটাই ক্লান্ত করে দেয় যে, তার তখন ইচ্ছে করে কোনো ফরাসি ব্যাক্তির কাছে যায় যে তাকে এমনভাবে দেখবে যেন সে তাদেরই তাদেরই একজন কখনও কখনও এটা তাকে এতটাই আক্রান্ত করে যে তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। এটা খুবই ভালো হত যদি এমন কোনো জায়গা থাকত যেখানে লোকে তাকে স্বাগত জানাবে। যখন সে বলেছিল অ্যানিটের প্রতি তার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই তখন সে সত্যি কথাই বলেছিল। সে যেমন মেয়ের কল্পনা করে অ্যানিট তেমন মেয়ে নয়। হান্স সেই মেয়ে পছন্দ করে যারা হবে লম্বা, উন্নত স্তনযুগল বিশিষ্ট, চোখ হবে নীল এবং তার মতো সুন্দর চুল থাকবে। সে চায় মেয়েরা স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী হবে এবং পরিপাটি পোশাক পরবে। সেই বৈশিষ্ট্য, সে বুঝতে পারে না কেন, এই সরু পাতলা নাক এবং কালো চোখ, লম্বা বিবর্ণ মুখে ছিল না। তবে তার মধ্যে সম্ভ্রম সৃষ্টিকারী কিছু একটা ছিল যাতে করে, যদি না যুদ্ধ জয়ে সে উত্তেজিত থাকত, যদি না সে এতটা ক্লান্ত এবং বিজয় গর্বে অহংকারী না থাকত, যাদি না খালি পেটে মদ খেত, তাহলে তার মনে কখনওই এমন ভাবনা আসত না যে মেয়েটির সঙ্গে খারাপ কিছু করে।

    সেদিনের ঘটনার পর পনের দিন হান্স যেতে পারল না। সে খামারে খাবার রেখে এসেছিল এবং নিঃসন্দেহ ছিল যে বৃদ্ধ মানুষ দুটি নিশ্চয়ই তা খেয়েছে। সে ভাবে যদি অ্যানিটও খায়সে অবাক হবে না যদি জানতে পারে যে, যেই মুহূর্তে সে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে, মেয়েটিও বাবা-মায়ের সঙ্গে খেতে বসে পড়েছে। কোনোকিছুর জন্য এই ফরাসি মানুষদের কিছু আটকে থাকে না। তারা দুর্বল ও অধঃপতিত। অ্যানিট তাকে ঘৃণা করে। হা ভগবান! সে কতই না তাকে ঘৃণা করে! কিন্তু মাংস মাংসই এবং চিজ চিজ। হান্স তার কথা অনেক ভাবল। তার মনে হল তার প্রতি মেয়েটির ঘৃণা হতেই পারে। মেয়েদের পছন্দ হওয়াতেই হান্স অভ্যস্ত। সে ভাবল, এটা খুব মজার হবে যদি মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে। সে হবে মেয়েটির প্রথম প্রেমিক। হান্স মুনিখের ছাত্রদের হাল্কাচালে বলতে শুনেছে যে একজন মেয়ে যাকে ভালোবাসে সে হয় তার প্রথম প্রেমিক এবং তারপর ভালোবাসা। যখনই হান্স কোনো মেয়েকে পাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে সে ব্যর্থ হয়নি। সে হাসল এবং তার চোখে এক চতুর দৃষ্টি খেলে গেল।
    অবশেষে হান্স খামারে যাওয়ার সুযোগ পেল। সে চিজ, মাখন, চিনি, এক টিন সসেজ ও কিছুটা কফি নিয়ে মোটর সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু এবার সে অ্যানিটকে দেখতে পেল না। অ্যানিট তার বাবার সঙ্গে মাঠে ছিল। বৃদ্ধা উঠোনে কাজ করছিল। যখন বৃদ্ধাটি পার্শেলগুলো দেখল তার চোখ চিকচিক করে উঠল। সে হান্সকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। প্যাকেটের সুতো খুলতে গিয়ে তার হাত একটু কেঁপে গেল এবং যখন সে হান্সের আনা জিনিসপত্রগুলো দেখল তখন তার চোখ জলে ভরে গেল।
    তুমি খুব ভালো। বৃদ্ধা বলল।
    আমি কি বসতে পারি?’ হান্স বিনয়ের সঙ্গে বলল।
    অবশ্যই। মহিলাটি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। হান্স অনুমান করল, মহিলাটি সম্ভবত নিশ্চিত হতে চাইছে যে অ্যানিট আসছে না। আপনাকে কি এক গ্লাস মদ দেব?’
    আমি খুব আনন্দিত হব।
    হান্স বুঝতে পারল খাওয়ারের লোভ মহিলাটিকে পেয়ে বসেছে। যদি সে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব না করতেও চায়, অন্ততপক্ষে তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে আগ্রহী। জানালার দিকে তাকানোটা তাদেরকে যেন ষড়যন্ত্রকারী বানিয়ে ফেলল।
    আপনি শুয়োরের মাংস পছন্দ করেন?’ হান্স জিজ্ঞেস করল।
    এটা তো খুব প্রিয়।
    পরেরবার যখন আসব আমি আরও বেশি করে আনার চেষ্টা করব। অ্যানিট কি এটা পছন্দ করেছিল?’
    আপনার দিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস সে স্পর্শ করেনি। সে বলেছিল, এর থেকে সে অনাহারে মরবে।
    বোকা!’
    আমিও তাকে ঠিক এই কথাই বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম, যতক্ষণ খাওয়ার আছে সেটা না খেয়ে সে কিছু পাবে না।
    তারা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণভাবে কথা বলছিল। হান্স চুমুক দিয়ে মদটা খেয়ে ফেলল। সে জানতে পারল মহিলার নাম মাদাম পেরিয়ার। হান্স তাকে জিজ্ঞাসা করল এই পরিবারের আর কোনো সদস্য আছে কি না। মহিলাটি দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলল। তাদের এক ছেলে ছিল। যুদ্ধের শুরুর দিকে সে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল। তবে সে যুদ্ধে নিহত হয়নি। তার নিউমোনিয়া হয়েছিল এবং ন্যান্সির হাসপাতালে সে মারা যায়।
    আমি দুঃখিত। হান্স বলল।
    মনে হয় মরে গিয়ে সে ভালোই করেছে। নানা দিক দিয়ে সে অনেকটা অ্যানিটের মতো। হারের লজ্জা সে কখনও সহ্য করতে পারত না। মাদাম পেরিয়ার পুনরায় দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলল। ওহ, বেচারা বন্ধু, আমরা প্রতারিত হয়েছি।
    কেন আপনারা পোল্যান্ডের জন্য লড়াই করতে চেয়েছিলেন? তারা আপনাদের কে হয়?’
    আপনি ঠিক বলেছেন। যদি আমরা আপনাদের হিটলারকে পোল্যান্ড দখল করার জন্য ছেড়ে দিতাম, তাহলে হয়তো তিনি আমাদের ছেড়ে দিতেন।
    হান্স ফিরে যাওয়ার জন্য উঠল এবং জানাল খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবে।
    আমি মাংসের কথা ভুলব না।

    সৌভাগ্যবশত হান্স একটি সুযোগ পেয়ে গেল। তাকে এমন একটা কাজ দেওয়া হল যা তাকে নিকটবর্তী শহরে সপ্তাহে দু-বার করে যেতে হত। এর ফলে সে খামারবাড়িতে বারবার যেতে পারল। কোনোকিছু সঙ্গে না নিয়ে সে আসত না। কিন্তু অ্যানিটের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতি হল না। নিজেকে তার অনুগ্রহভাজন করে তোলার জন্য সে সেইসব সাধারণ কৌশল ব্যবহার করে যা সে অন্যান্য মেয়েদের ক্ষেত্রে করে থাকে কিন্তু সেগুলো কেবল তার উপহাসকে উদ্দীপিত করত। পাতলা ঠোঁটের, কঠোর অ্যানিট তার দিকে এমনভাবে চেয়ে থাকে যেন সে খুব খারাপ। একাধিকবার সে তাকে এতটাই ক্রোধান্বিত করেছিল যে তার ইচ্ছে হত তার জীবন বিপর্যস্ত করে দেয়। একবার সে তাকে একাকী দেখতে পায়। যখন সে চলে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে হান্স তার পথ আগলে দাঁড়ায়।
    যেখানে আছো দাঁড়িয়ে থাকো। আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।
    কথা আমি একজন মহিলা এবং অরক্ষিত...!’
    শোনো, যতদূর জানতে পেরেছি আমাকে এখানে দীর্ঘ্য সময় থাকতে হতে পারে। তোমাদের ফরাসিদের পক্ষে ব্যাপারগুলো সহজ হবে না। সেগুলো আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। আমি তোমাদের সব কাজে আসতে পারি। কেন তুমি তোমার মা-বাবার মতো যুক্তিবাদী হচ্ছ না?’
    এটা সত্যি বৃদ্ধ পেরিয়ার এখন অনেকটাই সামলে উঠেছেন। তবে এটা বলা যাবে না যে তিনি আন্তরিক। বরং তিনি বেশ শীতল ও কঠোর কিন্তু ভদ্র। এমনকি তিনি হান্সকে বলেছিলেন তার জন্য একটু তামাক আনতে এবং হান্স যখন এর বিনিময়ে কোনো টাকাপয়সা নেয়নি তখন তিনি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। সইসনস-এর খবর শুনে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন এবং হান্স যে কাগজ তাকে এনে দিয়েছিল সেগুলো তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন। কৃষকের ছেলে হান্স খামার নিয়ে কথা বলত এটা ছিল একটি ভালো খামার, খুব বড়ো নয় আবার খুব ছোটোও নয়। এর মধ্য দিয়ে বড়ো একটা নদী বয়ে যাওয়ায় এখানে জলের ভালো ব্যবস্থা আছেএখানে ভালো গাছপালা, আবাদী জমি ও তৃণভূমি আছে বৃদ্ধ লোকটি যখন বিলাপ করছিল তখন বেশ সহানুভূতির সঙ্গে তার কথা শুনছিল হান্স। শ্রমিক, সারের অভাব, তার মজুত কেড়ে নেওয়া প্রভৃতি কারণে খামারটি উচ্ছনে যেতে বসেছিল।
    আপনি জানতে চাইছেন কেন আমি বাবা-মায়ের মতো যুক্তিবাদী হতে পারছি না?’ অ্যানিট বলল।
    মেয়েটি তার পোশাক টানটান করে টেনে ধরল এবং নিজের শরীরটা হান্সকে দেখাল। হান্স তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। যা সে দেখে তা তার মধ্যে এমন আন্দোলনের সৃষ্টি করল যেটা সে আগে কখনও অনুভব করেনি। তার গাল রক্তিম হয়ে উঠে
    তুমি প্রেগন্যান্ট?’
    অ্যানিট চেয়ারে বসে পড়ল এবং মাথা ঝুঁকিয়ে এমনভাবে কাঁদতে লাগল যে মনে হচ্ছিল তার হৃদপিণ্ড বোধহয় ভেঙে যাবে। কী লজ্জা! কী লজ্জা!’
    হান্স দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য। প্রিয়তমা...
    মেয়েটি পিছিয়ে গেল এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
    আমাকে স্পর্শ করবেন না। চলে যান। ইতিমধ্যেই কি আপনি আমার যথেষ্ট ক্ষতি করেননি?’
    হান্স ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে একাকী কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তার চিন্তা-ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। ধীর গতিতে সে সইসনস-এ ফিরে এল। যখন সে ঘুমোতে গেল কয়েক ঘন্টা তার ঘুম এল না। অ্যানিট যখন চেয়ারে বসে কাঁদছিল তখন তাকে অত্যন্ত করুণ দেখাচ্ছিলতার সন্তানকে সে গর্ভে ধারণ করেছে। সে ঘুমঘুম অনুভব করল কিন্তু পরমুহূর্তে চমকে জেগে উঠল। সহসা একটা ভাবনা আকস্মিক গুলি বর্ষণের কম্পনের মতো তাকে কাঁপিয়ে দিল... সে অ্যানিটের প্রেমে পড়ে গেছে। এটা এতটাই বিস্ময়কর, এতটাই আঘাতপূর্ণ ছিল যে, সে এটার সঙ্গে যুঝে উঠতে পারল না অবশ্যই অ্যানিটকে নিয়ে সে অনেক সময় ভেবেছে কিন্তু এভাবে নয়। হান্স এমনটা ভেবেছিল, এটা বেশ মজার হবে যদি সে মেয়েটিকে তার প্রেমে পড়াতে বাধ্য করতে পারে। এটাই হবে তার জয়, যদি মেয়েটি তাকে সেই জিনিস উৎসর্গ করে যা সে একদিন মেয়েটির কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু কখনওই তার এমন মনে হয়নি যে মেয়েটি তার কাছে অন্য একটি মেয়ের মতো ছাড়া অন্য কিছু। সে হান্সের মনের মতো নয়। সে সুন্দরী ছিল না। তার মধ্যে কিছুই ছিল না। কেন তার ওপর হঠাৎ করে এমন অনুভূতি হচ্ছে? এটা না ছিল আনন্দের অনুভূতি, না ছিল যন্ত্রণার তবে সে বুঝতে পারে যা হচ্ছে সব ঠিক এটা ভালোবাসা এবং এটা তাকে সেই খুশির অনুভূতি দিল যা সে জীবনে আগে অনুভব করেনি। সে তাকে তার বাহুতে নিতে চেয়েছিল, তাকে শান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল, সে তার জলভরা চোখে চুম খেতে চেয়েছিল। সে ভাবে, যেমনভাবে একজন পুরুষ একজন নারীকে প্রত্যাশা করে তেমনভাবে সে চায়নি তাকে। সে তাকে আরাম দিতে চেয়েছিলসে চেয়েছিল মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসুকঅবাক ব্যাপার, সে কখনও তাকে হাসতে দেখেনি। সে চেয়েছিল তার চোখগুলো দেখতে, যেগুলো ছিল সুন্দর, চমৎকার কোমলতা মাখা।
    তিনদিন হান্স সইসনস থেকে বেরোতে পারল না। তিনদিন, তিনরাত্রি সে অ্যানিটের কথা ভাবল, আর ভাবল সেই শিশুটির কথা যাকে অ্যানিট জন্ম দেবে তারপর সে খামারে যেতে পারল। সে ম্যাডাম পেরিয়ারের সঙ্গেই দেখা করতে চেয়েছিল। তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কেননা বাড়ি থেকে একটু দূরে রাস্তার ওপর ম্যাডাম পেরিয়ারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়মহিলাটি জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল এবং পিঠে একটি বোঝা নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল হান্স তার মোটর সাইকেল থামাল। সে জানে মহিলাটি তার সঙ্গে যে সহৃদয় আচরণ করে তা কেবল তার জিনিসপত্র আনার কারণে। কিন্তু সে তা নিয়ে পরোয়া করে না। মহিলাটি যে ভদ্র এটাই যথেষ্ট এবং সে ততদিন তাই থাকবে যতদিন তার কাছ থেকে কিছু পাবে। হান্স জানাল যে সে তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চায় এবং তাকে তার বোঝাটি নামিয়ে রাখতে বলেহান্স যেমনটি বলল মহিলাটি তাই করল। এটি ছিল ধূসর, মেঘলা দিন তবে ঠান্ডা ছিল না।
    আমি অ্যানিটের ব্যাপারটা জানি। হান্স বলল।
    মহিলাটি চমকে উঠল।
    কীভাবে তুমি জানলে? সে তোমার কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখতে চেয়েছিল।
    সে আমাকে বলেছে।
    সেই সন্ধ্যায় তুমি এমন সুন্দর কাজ করেছিল।
    আমি জানতাম না। কেন আমাকে আগে বলেননি?’
    মহিলাটি কথা বলতে শুরু করল। তিক্ত ভাবে নয়, এমনকি তাকে কোনরূপ দোষারোপ করেও না। এমন ভাব দেখাল যেন এটা প্রকৃতির দুর্বিপাক, যেমন করে একটা গরু তার বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় অথবা বসন্তের ঘন কুয়াশা ফলের গাছ কুরে কুরে খায় কিংবা ফসল নষ্ট করে, এটি এমন এক দুর্ভাগ্য যা মানুষকে গ্রহণ করতে হয় অবমাননা ও সমর্পণের মাধ্যমে। সেই ভয়ংকর রাত্রির পর অ্যানিট তীব্র জ্বরে কাবু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। তারা ভেবেছিল অ্যানিটের স্মৃতিবিভ্রম ঘটেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা সে চিৎকার করত। সেখানে চিকিৎসা করার মতো কোনো ডাক্তার ছিল না। গ্রামের ডাক্তারকে সেনাবাহিনীতে ডেকে নিয়েছিল। সইসনস-এ মাত্র দুজন ডাক্তার ছিল। দুজনেই ছিল বৃদ্ধ এবং তাদের যদি খবর পাঠানোও যেত তাহলেও গ্রামে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা তাদের শহর ছাড়ার অনুমতি ছিল না। যাই হোক, জ্বর কমে যাওয়ার পরও অ্যানিট এতটাই অসুস্থ ছিল যে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিল না। তারপর যখন সে উঠতে পারল তখন সে এতটাই দুর্বল, পাণ্ডুর ছিল যে ব্যাপারটা ছিল খুবই করুণ। আঘাতটা ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর। সুস্থতা ছাড়াও যখন একটা মাস কেটে গেল এবং আরও একটা মাস, অ্যানিট নিজের প্রতি কোনো মনযোগ দিল না। সে খুব অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। ম্যাডাম পেরিয়ার প্রথম সন্দেহ করেন কিছু একটা খারাপ ঘটেছে। তিনি অ্যানিটকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেন। উভয়ে খুব আতঙ্কিত ছিল কিন্তু কেউই নিশ্চিত ছিল নাতারা মিঃ পেরিয়ারকে এ-নিয়ে কিছু বলেনিতৃতীয় মাস আসার পর সন্দেহ করার আর কোনো অবকাশ রইল না। অ্যানিট গর্ভবতী।
    তাদের একটি পুরনো সিটোয়েন গাড়ি ছিল যাতে করে ম্যাডাম পেরিয়ার সপ্তাহে দুদিন সকালে খামারের জিনিসপত্র নিয়ে সইসনস-এর বাজারে যেত। কিন্তু জার্মান অধিগ্রহনের পর তাদের এমন কিছু ছিল না যা বাজারে বিক্রি করলে যাওয়া সার্থক হয়। পেট্রোল জোগাড় করা অসম্ভব ছিল। সেই গাড়ি বের করে তারা শহরে যায়। রাস্তায় জার্মান সৈনিকদের গাড়ি ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ে না। জার্মান সৈনিকরা রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। রাস্তায় ও পাবলিক বিল্ডিং-এ জার্মানদের নিদর্শন ছিল যেখানে কমান্ডিং অফিসারের সই করা ফরাসি ভাষায় ঘোষণাপত্র ছিল। অনেক দোকান বন্ধ ছিল। তারা তাদের পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেল এবং তিনি তাদের সন্দেহ সুনিশ্চিত করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ যাজক এবং তাদের কোনোরূপ সাহায্য করলেন না। যখন তারা কাঁদছিল তিনি কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে তার অসহায়তা প্রকাশ করলেন। বললেন, তোমরা একা নও। আমাদেরকে ভুগতে হবে।
    তারা আর একজন ডাক্তারের কথা জানত এবং তার কাছে গেল। ঘন্টা বাজানোর অনেকটা সময় পরও কোনো জবাব এল না। তারপর এক বিষণ্ণ মুখের শ্যামলা মহিলা দরজা খোলেন। কিন্তু যখন তারা ডাক্তারবাবুর কথা জিজ্ঞেস করে তখন তিনি কাঁদতে শুরু করেন। জার্মানরা সেই চিকিৎসককে বন্দী করেছিল কারণ কারণ তিনি একজন ফ্রিম্যাসন ছিলেন এবং তাকে পনবন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল। একটি কাফেতে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল যেখানে জার্মান অফিসাররা প্রায়শই যেতেন। দুজন মারা গিয়েছিল এবং অনেকে আহত হয়েছিল। যদি অপরাধীকে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে হাতে তুলে না দেওয়া হয় তাহলে ডাক্তারকে গুলি করে হত্যা করবে। মহিলাটিকে বেশ সদয় মনে হয় এবং ম্যাডাম পেরিয়ার তাকে তাদের সমস্যার কথা বলে
    মহিলাটি ক্রুদ্ধ স্বরে উচ্চারণ করলেন পিশাচ!’ তারপর সকরুণ দৃষ্টিতে অ্যানিটের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেচারী!’
    তিনি তাদের শহরের এক ধাত্রীর ঠিকানা দিলেন এবং তাকে বলতে বললেন যে তারা তার কাছ থেকে এসেছে। ধাত্রী তাদের কিছু ঔষধ দিয়েছিল। ঔষধগুলো অ্যানিটকে এতটাই পীড়িত করেছিল যে তার মনে হয়েছিল সে বোধহয় মারা যাবে। তবে ঔষধে কোনো কাজ হয় না। অ্যানিট গর্ভবতী থাকল।
    ম্যাডাম পেরিয়ার হান্সকে এসব কথাই বললেন। কিছু সময়ের জন্য হান্স চুপ থাকেতারপর সে বলে, আগামীকাল রবিবার। আমার কোনো কাজ নেই। আমি আসব এবং আমরা কথা বলব। আমি কিছু সুন্দর জিনিস আনব।
    আমাদের কোনো সূঁচ নেই। তুমি কি কিছু আনতে পারবে?’
    আমি চেষ্টা করব।
    মহিলাটি কাঠের বোঝা পিঠে তুলে নিল এবং ক্লান্ত পায়ে এগোতে লাগল। হান্স সইসনস-এ ফিরে গেল।

    পরেরদিন মোটর সাইকেল চালানোর সাহস হল না হান্সেরসে একটা পুশ-বাইক ভাড়া করল। ক্যারিয়ারে খাওয়ারের পার্শেল বাঁধল। স্বাভাবিক পার্শেলের থেকে এটা বেশ বড়ো হল কারণ সে এর মধ্যে একটা শ্যাম্পেনের বোতল রেখেছিল। সে খামারে গেল পুঞ্জীভূত অন্ধকার নিশ্চিত করল যে কাজ সেরে সকলে ঘরে আছে। সে রান্নাঘরে ঢুকলঘরটি ছিল বেশ গরম ও আরামদায়ক। ম্যাডাম পেরিয়ার রান্না করছিল এবং তার স্বামী প্যারিস-সয়্যার পড়ছিলঅ্যানিট মোজায় রিফু করছিল।
    পার্শেলটা খুলে হান্স বলে, দেখুন আমি কিছু সূঁচ এনেছি। অ্যানিট, তোমার জন্যও কয়েকটা জিনিস আছে।
    আমি এসব চাই না।
    তুমি চাও না?’ সে একটু বাঁকা হাসি হেসে বলল। তোমাকে বাচ্চার জন্য জিনিসপত্র তৈরি করতে হবে।
    এটা ঠিক অ্যানিট, তার মা বলল, এবং আমাদের কিছু নেই।
    অ্যানিট তার বুননের কাজ থেকে মুখ তুলল না। ম্যাডাম পেরিয়ারের লোভী চোখ ঘুরতে লাগল পার্শেলের মধ্যে থাকা জিনিসপত্রে। এক বোতল শ্যাম্পেন!’
    হান্স মৃদু হাসল।
    আমি তোমাকে বলব এখন কী করতে হবে। আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা আছে। হান্স একমুহূর্ত ইতস্তত করল তারপর একটি চেয়ার টেনে অ্যানিটের মুখোমুখি বসল। আমি বুঝতে পারছি না কী করে শুরু করব। অ্যানিট, সেই রাতে আমি যা করেছি তার জন্য দুঃখিত। এটা আমার দোষ ছিল না। পরিস্থিতির শিকার। তুমি আমায় ক্ষমা করতে পার না?’
    অ্যানিট তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল। কখনওই না। কেন আপনি আমায় একা থাকতে দিচ্ছেন না? এটা কি যথেষ্ট নয় যে আপনি আমার জীবন নষ্ট করেছেন?’
    হ্যাঁ, তা হয়তো ঠিক। আবার হতে পারে আমি তা করিনি। আমি যখন জানতে পারলাম তুমি আমার সন্তানের জন্ম দিতে চলেছ, আমার মধ্যে এক বিচিত্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। সবকিছু এখন বদলে গেছে। এটা আমাকে খুব গর্বিত করেছে।
    গর্বিত?’ সে ক্ষিপ্তভাবে তার দিকে তাকাল।
    অ্যানিট, আমি তোমার কাছে ওই সন্তান চাই। আমি আনন্দিত যে তুমি তাকে নষ্ট করে দাওনি।
    একথা আপনি বলছেন কোন সাহসে!’
    আমার কথা মন দিয়ে শোন। ব্যাপারটা জানার পর আমি এই ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। ছ-মাসের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। বসন্তের মধ্যে আমরা ইংরেজদের পরাভূত করতে পারব। তারা কোনো সুযোগ পাবে না। তারপর আমি অব্যাহতি পাব এবং তোমাকে বিয়ে করব।
    আপনি আমাকে বিয়ে করবেন! কেন?’
    হান্সের তামাটে চামড়া রক্তিম হল। ফরাসি ভাষায় সে তার মনের কথা বলতে পারল না। তাই সে জার্মানিতে বলল। সে জানে অ্যানিট তা বুঝতে পারবে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
    উনি কী বলছেন?’ ম্যাডাম পেরিয়ার মেয়েকে জিজ্ঞেস করল
    তিনি বলছেন যে তিনি আমাকে ভালোবাসেন।
    মাথাটা পেছন দিকে ঝুঁকিয়ে অ্যানিট উচ্চস্বরে কর্কশ হাসিতে ফেটে পড়ল। সে জোরে জোরে হাসতে লাগল এবং থামতে পারছিল না। তার চোখ দিয়ে স্রোতের মতো জল বেরিয়ে এল। ম্যাডাম পেরিয়ার তার দু-গালে জোর থাপ্পড় লাগাল
    নিজের প্রতি কোনো মনযোগ নেই। ম্যাডাম পেরিয়ার হান্সকে বলল। এটা হিস্টিরিয়া। তার অবস্থা তো তুমি জানো।
    অ্যানিট হাঁপাতে লাগল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল।
    হান্স বলল, আমাদের এনগেজমেন্ট সেলিব্রেট করার জন্য আমি শ্যাম্পেনের বোতলটি এনেছি।
    এটাই সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার যে আমরা বোকাদের দ্বারা প্রহৃত হয়েছি’, অ্যানিট বলল।
    হান্স জার্মান ভাষায় কথা বলে চলল। যেদিন আমি জানতে পারলাম তুমি আমার সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছ তার আগে পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলামএটা আমার কাছে বজ্রনিনাদের মতো এসেছিলকিন্তু আমার মনে হয় আমি তোমাকে সবসময় ভালোবেসেছি।
    ও কী বলছে?’ ম্যাডাম পেরিয়ার জিজ্ঞেস করে
    তেমন জরুরি কিছু নয়।
    হান্স পুনরায় ফরাসিতে ফিরে এল। সে চাইছিল তার কথা অ্যানিটের বাবা-মাকে শোনাতে।
    যদি তারা আমাকে ছেড়ে দিত তাহলে আমি এখনি তোমাকে বিয়ে করতাম। আমাকে একেবারে তুচ্ছ ভেবো না। আমার বাবা সম্ভ্রান্ত এবং আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের বেশ মান্যিগন্যি আছে। আমি পরিবারের বড়ো সন্তান এবং তোমার কিছু অভাব হবে না।
    তুমি কি ক্যাথোলিক?’ ম্যাডাম পেরিয়ার জিজ্ঞেস করেন।
    হ্যাঁ, আমি ক্যাথলিক।
    এটা ভালো ব্যাপার।
    আমরা যে দেশে বাস করি তা খুব সুন্দর এবং মাটিও ভালো। মিউনিখ ও ইনসবার্কের মধ্যে এর থেকে ভালো চাষের জায়গা নেই এবং এটা আমাদের একেবারে নিজস্ব। সত্তরের যুদ্ধের পর আমার দাদু এটি কিনেছিলেন। আমাদের গাড়ি, রেডিও আছে এবং টেলিফোনও।
    অ্যানিট তার বাবার দিকে তাকাল। বিদ্রূপের সুরে বলল, এই ভদ্রলোকের কাছে পৃথিবীর সমস্ত কৌশল আছে। তারপর সে হান্সের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার অবস্থানটা খুব সুন্দর হবে—বিজয়ী দেশের একজন বিদেশী ও বিবাহহীন সম্পর্কে জন্মানো সন্তান। এটা আমাকে সুখী হওয়ার সুযোগ দেবে। তাই না? একটা সুন্দর সুযোগ!’
    খুব কম কথা বলার মানুষ মি. পেরিয়ার প্রথমবার মুখ খোলে
    না, আমি অস্বীকার করছি না যে তোমার ইঙ্গিতটা সুন্দর। আমি শেষ যুদ্ধে গেছি। আমরা সকলে এমন কিছু করেছিলাম যা আমরা শান্তিপূর্ণ সময়ে করতে পারতাম না। মানুষের স্বভাব যেমন। কিন্তু এখন আমাদের ছেলে মৃত। অ্যানিট ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। আমরা তাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।
    আমি ভেবেছিলাম আপনি ওভাবে বলতে পারেন’, হান্স বলল, এবং আমি আমার জবাব পেয়ে গেছি। আমি আপনাদের এখানেই থাকব।
    অ্যানিট দ্রুত তার দিকে একবার তাকাল।
    তুমি কী বলতে চাইছ?’ ম্যাডাম পেরিয়ার জিজ্ঞেস করে
    আমার আর এক ভাই আছে। সে বাবার সঙ্গে থাকবে এবং তাকে সাহায্য করবে। আমি এই দেশকে পছন্দ করি। উৎসাহ এবং উদ্যোগ থাকলে একজন মানুষ আপনার খামারে ভালো কিছু করতে পারে। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অনেক জার্মান সৈনিক এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকবে। এটা ভালো করে জানা যে ফ্রান্সে চাষআবাদ করার মতো যথেষ্ট মানুষ নেইএক ব্যাক্তি একদিন সইসনস-এ বক্তব্য রেখেছিল। সে বলেছিল যে এক তৃতীয়াংশ খামার আবাদহীন অবস্থায় পড়ে থাকে কারণ কাজ করার লোক নেই।
    পেরিয়ার ও তার স্ত্রী নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে এবং অ্যানিট লক্ষ করে তাদের অবস্থা দোদুল্যমান। ছেলে মারা যাওয়ার পর এমনটাই তারা চাইছিল। এমন একজন জামাই যে হবে হৃষ্টপুষ্ট, বলবান এবং যখন তারা চলাফেরা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে তখন তাদের দায়িত্ব নিতে পারবে।
    এটা অবস্থা বদলাতে পারে ম্যাডাম পেরিয়ার বললএই প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।
    মুখ সামলে কথা বল!’ অ্যানিট রুক্ষ স্বরে চিৎকার করে ওঠে। সামনের দিকে ঝুঁকে জার্মানটির দিকে সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আমি একজন শিক্ষককে ভালোবাসি সে শহরের একটি ছেলেদের স্কুলে কাজ করত। আমিও সেখানে পড়াতাম। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমাদের বিয়ের কথা ছিল। সে আপনার মতো শক্তিশালী, লম্বা-চওড়া কিংবা সুদর্শন নয়। সে বেঁটেখাটো, শীর্ণ। তার একমাত্র সৌন্দর্য তার মেধা যা তার মুখে উদ্ভাসিত। তার একমাত্র শক্তি হচ্ছে তার হৃদয়ের মহত্ব। সে বর্বর নয়, সে সভ্য। তার পেছনে হাজার বছরের সভ্যতা রয়েছে। আমি তাকে ভালোবাসি। আমি আমার সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবাসি।
    হান্সের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তার মাথায় কখনও এ-ভাবনা আসেনি যে অ্যানিট অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে।
    সে এখন কোথায়?’
    কোথায় থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা? জার্মানিতে। সে এখন বন্দী এবং অনাহারে মরছে, যখন আপনারা আমাদের দেশের খাওয়ার খাচ্ছেন। আমি কতবারই না আপনাকে বলেছি যে আমি আপনাকে ঘৃণা করি। আপনি আমাকে বলছেন আপনাকে ক্ষমা করে দিতে। কখনওই না। আপনি ক্ষতিপূরণ করতে চাইছেন? আপনি নির্বোধ। সে মাথাটা পেছনে ঝোঁকাল এবং তার মুখে এক অসহনীয় যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠল। সর্বনাশ হয়েছে আমার। ওহ, সে আমাকে ক্ষমা করবে। সে স্নেহ-পরায়ণ। কিন্তু এটা ভেবে আমি দগ্ধ হচ্ছি, কোনোদিন হয়তো তার মনে সন্দেহ জাগবে যে আমি ধর্ষিতা হইনিআপনার দেওয়া মাখন, চিজ আর সিল্কের মোজার জন্য নিজেকে আপনার কাছে সমর্পণ করেছি। এমনটা তো আমি একা নই। আমাদের দুজনের মধ্যে এই শিশুটির ফলে আমাদের জীবন কেমন হবে? সে সন্তান আপনার, এক জার্মান সন্তান আপনার মতো লম্বা, ফর্সা, আপনার মতো নীল চোখ। হে ভগবান, কেন আমাকে এই যন্ত্রণা ভুগতে হচ্ছে!’
    অ্যানিট উঠে পড়ে এবং দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়একমুহূর্তের জন্য তিনজন নীরব হয়ে যায়হান্স দুঃখপূর্ণভাবে তার শ্যাম্পেনের বোতলের দিকে তাকাল। সে দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।
    যখন হান্স বেরিয়ে যায় ম্যাডাম পেরিয়ার তার সঙ্গে সঙ্গে যায় নীচু স্বরে সে তাকে বলে, তুমি বললে অ্যানিটকে বিয়ে করবেতুমি কি সত্যি বলছ?’
    হ্যাঁ, প্রত্যেকটি শব্দ। আমি তাকে ভালোবাসি।
    তুমি তাকে নিয়ে চলে যাবে না? তুমি এখানে থাকবে এবং খামারে কাজ করবে?’
    আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।
    এটা সত্যি যে আমাদের বৃদ্ধ মানুষটি সব সময়ের জন্য থাকবে না। বাড়িতে তোমাকে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। কিন্তু এখানে তোমাকে কারও সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে হবে না।
    সেখানে তাই করতে হবে।
    আমরা কখনওই চাইনি অ্যানিট ওই শিক্ষককে বিয়ে করুক। কিন্তু আমার ছেলে বেঁচে ছিল এবং সে বলেছিল, অ্যানিট যদি তাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে কেন করবে না? অ্যানিট তার প্রতি পাগল। কিন্তু এখন আমাদের সেই ছেলে মৃত। বেচারা! এখন সবকিছু বদলে গেছে। যদি সে চায়ও, তাহলে সে কীভাবে এই খামারে কাজ করতে পারবে?’
    এই খামারটি যদি বিক্রি করে দেওয়া হয় তাহলে তা লজ্জার হবে। আমি জানি একজনের তার জায়গার ওপর কী অনুভূতি থাকে।
    তারা রাস্তায় পৌঁছায়মহিলাটি হান্সের হাত ধরে হাল্কা করে চাপ দেয়
    আবার এসো, তাড়াতাড়ি।
    হান্স জানত যে মহিলাটি তার পক্ষে আছে। যখন সে বাইকে চড়ে সইসনস-এ ফিরছিল এই ভাবনাটা তাকে সান্ত্বনা দিল। এটাই বিরক্তিকর যে অ্যানিট অন্য কাউকে ভালোবাসে। তবে এটা সৌভাগ্যের যে সে এখন বন্দী এবং তার মুক্তির অনেক আগেই বাচ্চাটি জন্মলাভ করবে। এটা অ্যানিটকে বদলাতে পারে। মেয়েদের ব্যাপার-স্যাপার কখনওই বোঝা যায় না। তাদের গ্রামে এক মহিলা ছিল। সে তার স্বামীকে এতটাই ভালোবাসত যে ব্যাপারটা নিয়ে প্রচুর ঠাট্টা-তামাশা হত তারপর যখন তার একটা সন্তান হল তখন সে স্বামীকে চোখে দেখাটাও সহ্য করতে পারত না। তাহলে কেন তার বিপরিতই বা ঘটবে না? সে যেহেতু তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তখন অ্যানিট নিশ্চয়ই তাকে ভদ্র মানুষ হিসেবে ভাববে। হে ঈশ্বর, মাথা চেপে ধরে যখন সে কথা বলছিল তাকে কী করুণই না দেখাচ্ছিল এবং কী সুন্দরভাবেই না সে কথা বলছিল! কী ভাষা! মঞ্চে কোনো অভিনেত্রী এর থেকে ভালো করে নিজেকে ব্যক্ত করতে পারে নাতথাপি এটাকে একেবারে স্বাভাবিক শোনাচ্ছিল। এটা স্বীকার করতেই হবে, এই ফরাসি মানুষেরা জানে কীভাবে কথা বলতে হয়। ওঃ, সে খুব বুদ্ধিমানএমনকি যখন সে তার তিক্ত কথাবার্তায় তাকে আঘাত করছিল, তা শুনতে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। তার নিজেরও খারাপ শিক্ষা নেইকিন্তু সে তার সামনে মোমবাতি ধরতে পারবে না। তার যা ছিল সেটা হল সংস্কৃতি।
    আমি একটা গাধা!’ বাইক চালাতে চালাতে বেশ জোরেই বলল হান্সঅ্যানিট বলেছিল সে লম্বা, শক্তিশালী ও সুন্দর। অ্যানিট কী এসব কথা বলত যদি না এসব কিছু তার ওপর প্রভাব ফেলত? এমনকি সে এও বলেছিল বাচ্চাটি তার মতো সুন্দর চুল আর নীল চোখ বিশিষ্ট হবে। এটা কি বোঝায় না, তার রং মেয়েটির ওপর এই প্রভাব ফেলেছিল যে সে একজন ওলন্দাজ। হান্স মৃদু হাসল। আমাকে সময় দাও। ধৈর্য ধর। প্রকৃতিকে কাজ করতে দাও।
    কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। সইসনস-এর সিও ছিলেন বয়স্ক এবং সহজ-সরল মানুষ। বসন্তে তাদের জন্য যা সঞ্চয় ছিল তাতে তিনি তৃপ্ত ছিলেন এবং তার লোকেদের বেশি পরিশ্রম করাতে চাননি। জার্মান কাগজ পড়ে তারা জানতে পারছিল যে বিমানবাহিনীর এর দ্বারা ইংল্যান্ড ধ্বংস হচ্ছিল এবং মানুষেরা আতঙ্কে ছিল। ডুবোজাহাজ ব্রিটিশ জাহাজগুলিকে ডুবিয়ে দিচ্ছিল এবং দেশটি অনাহারে ভুগছিল। বিপ্লব আসন্ন ছিল। গ্রীষ্মের মধ্যে সবকিছু মিটে যাবে এবং জার্মানরা পৃথিবীর অধীশ্বর হবে। হান্স বাড়িতে বাবা-মাকে চিঠি লিখে জানাল যে সে এক ফরাসি মেয়েকে বিয়ে করবে এবং তাদের একটি সুন্দর খামার আছে। সে প্রস্তাব দিল পারিবারিক সম্পত্তির তার ভাগের অংশ কিনে নেওয়ার জন্য ভাই যেন টাকার জোগাড় রাখে যাতে করে সে নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে পারে, কেননা যুদ্ধ ও বিনিময়ের কারণে সে নামমাত্র মূল্যে জায়গা কিনতে পারবে। সে পেরিয়ারের সঙ্গে খামারে গিয়েছিল। হান্স যখন তার পরিকল্পনার কথা বলেছিল মিঃ পেরিয়ার মনযোগ দিয়ে চুপচাপ শুনছিলখামারটিকে পুনরায় পূর্ণ করতে হবে এবং জার্মান হিসেবে তার কিছু সুবিধা আছে। মোটর ট্রাক্টর পুরোনো হয়ে গেছে। সে জার্মানি থেকে একটি নতুন সুন্দর ট্রাক্টর কিনে আনবে এবং একটি মোটর লাঙল। একটি খামারকে উপার্জনশীল করতে আধুনিক আবিষ্কারের সুবিধা নেওয়া দরকার। ম্যাডাম পেরিয়ার পরে তাকে জানিয়েছিল, তার স্বামী বলেছিল সে খারাপ ছেলে নয়সে অনেক কিছু জানে। মহিলাটি তার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ এবং তাকে জোর করে রবিবার মধ্যাহ্নভোজ তাদের সঙ্গে করার জন্য। সে সবসময় সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল। যত সময় গড়াচ্ছিল এবং অ্যানিট কম কাজ করতে পারছিল, এমন একজন মানুষের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যে কাজ করতে গিয়ে কিছু মনে করবে না।
    অ্যানিট তীব্র বিরোধী মনোভাবাপন্ন ছিল। একমাত্র সরাসরি করা কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়া ছাড়া সে হান্সের সঙ্গে কথা বলত না এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের ঘরে চলে যেত। যখন খুব ঠান্ডা হত এবং নিজের ঘরে থাকতে পারত না, তখন সে রান্নাঘরে উনুনের পাশে বসে বই পড়ত কিংবা সেলাই করত। তার দিকে কোনো নজর দিত না। ভাবখানা এমন যেন সে সেখানে নেই। সে ছিল দীপ্তিময়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারীতার গালে রং ছিল এবং হান্সের চোখে সে ছিল সুন্দরী। তার আগত মাতৃত্ব তাকে একটা অদ্ভুত মর্যাদা দিয়েছিলহান্স যখন তাকে দেখত, তার মন আনন্দে ভরে উঠত। তারপর, একদিন যখন হান্স খামারের দিকে যাচ্ছিল দেখল ম্যাডাম পেরিয়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তাকে থামতে বলছে। সে জোরে ব্রেক কষল।
    আমি একঘন্টা অপেক্ষা করে আছি। আমি ভাবছিলাম তুমি বোধহয় আসবে না। তুমি ফিরে গেছ। পিইরি মারা গেছে।
    কোন পিইরি?’
    পিইরি গেভিন। সেই শিক্ষক যাকে অ্যানিট বিয়ে করতে চেয়েছিল।
    হান্সের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। কী সৌভাগ্য!’ এখন তার সুযোগ।
    সে কি বিপর্যস্ত?’
    সে কাঁদছে না। আমি যখন কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম সে আমার মাথা খামচে ধরে। যদি সে আজ তোমাকে দেখে তাহলে তোমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে পারে।
    তার মারা যাওয়ায় আমার কোনো দোষ নেই। আপনি কী করে জানলেন?’
    তার বন্ধু, একজন বন্দী সুইজারল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছেসে অ্যানিটকে লিখে পাঠিয়েছে। আজ সকালে আমরা চিঠি পেয়েছি। যথেষ্ট খাওয়ার দেওয়া হচ্ছিল না বলে শিবিরে বিদ্রোহ হয়েছিল এবং বিদ্রোহের নেতাদের গুলি করে মারা হয়। পিইরি ছিল তাদের মধ্যে একজন।
    হান্স নীরব ছিল। সে কেবল ভাবছিল, লেকাটির সঠিক সাজা হয়েছে। বন্দী শিবিরকে তারা কী মনে করে! বিলাসবহুল রেস্তোরা?’
    ম্যাডাম পেরিয়ার বলেন, আঘাতটা সামলানোর জন্য তাকে সময় দাও। সে যখন শান্ত হবে তখন আমি তার সাথে কথা বলব। আমি তোমাকে চিঠি লিখে জানাব কখন তুমি আসবে।
    ঠিক আছে। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন, তাই তো?’
    তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। আমার স্বামী ও আমার সম্মতি আছে। আমরা এটা নিয়ে কথা বলেছিআমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে আমাদের পরিস্থিতিকে স্বীকার করতে হবে। আমার স্বামী বোকা নয়তিনি বলেন ফ্রান্সের পক্ষে এখন সেরা সুযোগ হল সহযোগিতা করাবিশ্বাস কর, আমি মোটেও তোমাকে অপছন্দ করি না। আমি অবাক হব না যদি তুমি অ্যানিটের জীবনে ওই শিক্ষকের চেয়েও ভালো স্বামী হতে পার এবং বাচ্চাটি আসছে।
    আমি ছেলে চাই। হান্স বলে
    ছেলেই হবে। আমি নিশ্চিত। আমি কফি গ্রাউন্ডে দেখেছি এবং কার্ড টেনেছি। প্রত্যেকবারই জবাব এসেছে ছেলে।
    সাইকেল ঘুরিয়ে উঠতে যাওয়ার সময় হান্স বলে, আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। এই নিন আপনার জন্য কিছু কাগজ।
    সে তাকে তিনটি প্যারিস-সয়্যার তুলে দেয়। বৃদ্ধ পেরিয়ার প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাগজগুলি পড়েছিল। সে পড়েছিল যে ফরাসিদের বাস্তববাদী হতে হবে এবং হিটলার ইউরোপে যে নতুন শাসন কায়েম করতে যাচ্ছে তা স্বীকার করতে হবে। সে জেনেছিল জার্মান ডুবোজাহাজ সমুদ্র অভিযানের জন্য নিজেদের সংগঠিত করছে যা ইংল্যান্ডকে তাদের পদতলে এনে হাজির করবে এবং আমেরিকানরা অপ্রস্তুত ছিল। তাদের সাহায্য করার অবস্থায় ছিল না। সে পড়েছিল, ফ্রান্সের ঈশ্বর প্রেরিত এই সুযোগ গ্রহন করা উচিত এবং রিচ-এর সঙ্গে অনুগত সহযোগিতায় নতুন ইউরোপে তার সম্মান উদ্ধার করা উচিত। কেবল জার্মানরা এসবকিছু লেখেনি, ফরাসিরাও লিখেছিল। মিঃ পেরিয়ার সম্মতিসূচকভাবে মাথা নেড়েছিল যখন সে পড়েছিল ধনদর্পী ও ইহুদীদের ধ্বংস করা হবে এবং ফ্রান্সের গরিব মানুষেরা নিজেদের অধিকার ফিরে পাবে। যে চালাক মানুষেরা বলেছিল ফ্রান্স অপরিহার্যভাবে একটি কৃষিভিত্তিক দেশ এবং এর শ্রমজীবী কৃষকেরা এর মেরুদণ্ড, তারা ঠিক বলেছিলএটা ভালো কথা।
    পিইরি গেভিনের মৃত্যুর দশদিন পর এক সন্ধ্যায়, যখন তারা রাতের খাওয়ার খাচ্ছিল, ম্যাডাম পেরিয়ার তার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে অ্যানিটকে বলল, আমি কয়েকদিন আগে হান্সকে চিঠি লিখে বলেছিলাম আগামীকাল তাকে আসার জন্য।
    সতর্ক করার জন্য ধন্যবাদ। আমি নিজের ঘরে থাকব।
    ওহ্, শোনো বাছা, এটা বোকামি করার মতো সময় নয়। তোমাকে বাস্তববাদী হতে হবে। পিইরি মারা গেছে। হান্স তোমাকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়। সে খুব ভালো ছেলে। তাকে স্বামীরূপে পেলে যে কোনো মেয়েই গর্ববোধ করবে। তার সাহায্য ছাড়া কীভাবে আমরা খামারগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনব? সে নিজের টাকায় ট্রাক্টর ও লাঙল কিনবে। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
    মা, তুমি বৃথা সময় নষ্ট করছ। আমি আমার বেঁচে থাকার অর্থ আগে উপার্জন করেছি, পুনরায় তা করব। আমি তাকে ঘৃণা করি। আমি তার অহংকার আর দাম্ভিকতাকে ঘৃণা করি। আমি তাকে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু তার মৃত্যু আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। সে আমার উপর যেমন অত্যাচার করেছে আমি তেমনি করে তার ওপর অত্যাচার করতে চাই। সে যেভাবে আমাকে আঘাত করেছে, সেভাবে তাকে আঘাত করার যদি কোনো উপায় খুঁজে পেতাম তাহলে মরেও আমি শান্তি পেতাম।
    দেখো বাছা, তুমি খুব বোকার মতো কথা বলছ।
    বৃদ্ধ পেরিয়ার বলল, তোমার মা ঠিক কথা বলেছে। আমরা পরাজিত হয়েছি। আমাদের পরিণতিকে স্বীকার করে নিতে হবে। বিজয়ীদের সঙ্গে যা ভালো করা যায় আমরা তার ব্যবস্থা করছি। আমরা তাদের থেকে চালাক এবং আমরা যদি আমাদের দান ভালো খেলতে পারি তাহলে আমরাই উপরে চলে আসব। ফ্রান্সে ঘুন ধরে গিয়েছিলইহুদী এবং ধনদর্পীরা দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। কাগজ পড়ো তাহলে তুমি এসব জানতে পারবে।
    তুমি কি মনে করো আমি ওই কাগজের একটি কথাও বিশ্বাস করি? কেন তোমরা বুঝতে পারো না, ও এটা আনে এই কারণে যে এই কাগজটা জার্মানদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে? যারা এখানে লেখে, তারা সব বিশ্বাসঘাতক। হে ভগবান, জনতার হাতে তারা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হচ্ছে এটা দেখার জন্য যেন বেঁচে থাকতে পারি। তারা সবাই জার্মানিদের অর্থে কেনা হয়ে গেছে। বিশ্বাসঘাতক!’
    ম্যাডাম পেরিয়ার খুব কুপিত হন
    ওই ছেলেটার এত বিরুদ্ধাচারণ করার কারণ কী? সে তোমার ওপর অত্যাচার করেছিলহ্যাঁ, এটা ঠিক। সে তখন মদ্যপ ছিল। প্রথমবার কোনো মেয়ের জীবনে এটা ঘটেছে এমনটা তো নয় এবং এটা শেষবারও নয়। সে তোমার বাবাকে আঘাত করেছিল। শুয়োরের মতো রক্তাক্ত করেছিল। কিন্তু তোমার বাবা কি রাগ পুষে রেখেছেন?’
    এটা অত্যন্ত খারাপ ঘটনা। কিন্তু আমি ভুলে গেছি। মিঃ পেরিয়ার বললেন।
    অ্যানিট কর্কশ হাসিতে ফেটে পড়লতোমার যাজক হওয়া উচিত ছিল। সত্যিকার খ্রিস্টানের মতো তুমি তোমার আঘাতকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছ।
    তাতে অন্যায়টা কোথায়?’ ক্রুদ্ধভাবে বলে ম্যাডাম পেরিয়ার। ক্ষতিপূরণ করার জন্য যা যা করার তা কি সে করেনি? যদি সে না আনত, তাহলে তোমার বাবা কী করে সারা মাসের তামাক পেত? আমরা যে অনাহারে নেই, এটা তারই জন্য।
    যদি তোমাদের আত্মমর্যাদাবোধ থাকত, যদি তোমাদের মধ্যে শালীনতা থাকত, তাহলে তোমরা তার মুখের ওপর উপহার ছুঁড়ে মারতে।
    তুমিও তার দ্বারা সুবিধা পেয়েছ, তাই নয় কি?’
    কখনওই নয়।
    এটা মিথ্যে কথা এবং তুমি তা জানোও। তার আনা চিজ, মাখন, সার্ডিন খেতে তুমি অস্বীকার করেছো। কিন্তু জানো কি, তুমি যে সুপটা খেয়েছ তাতে আমি তার আনা মাংস দিয়েছিআজ রাতে যে স্যালাড তুমি খেয়েছ, তোমাকে শুকনো খেতে হয়নি, কারণ সে আমাকে তেলটা এনে দিয়েছিল।
    অ্যানিট গভীর দীর্ঘ্যশ্বাস ছাড়ল। সে হাত দিয়ে চোখ ঢাকল।
    আমি জানিআমি না করার চেষ্টা করিনি, কেননা এটা না খেয়ে পারিনি। কারণ আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম। হ্যাঁ, আমি জানি তার আনা মাংস সুপে ছিল এবং আমি তা খেয়েছি। আমি জানি তার আনা তেলে স্যালাড তৈরি হয়েছে। আমি এটাকে প্রত্যাখান করতে চেয়েছিলাম সেরকম তীব্র ইচ্ছাও আমার মনে ছিল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমি এগুলো খেয়েছি। আমার মধ্যেকার বুভুক্ষু পশুটা এটা খেয়েছে।
    যেমন তেমন হোক না কেন, তুমি খেয়েছিলে।
    লজ্জায়! হতাশায়! তাদের ট্যাঙ্ক, প্লেন ব্যবহার করে তারা প্রথমে আমাদের শক্তি ধ্বংস করেছে। এখন অনাহারে রেখে তারা আমাদের সাহসকে ধ্বংস করতে চাইছে।
    বাছা, এরকম নাটুকেপনা করে কোনো লাভ হবে না। শিক্ষিত হয়েও তোমার কোনো বুদ্ধি নেই। অতীত ভুলে যাও। এক বাবাকে তার সন্তান দাও। খামারবাড়ির জন্য একজন ভালো কর্মচারী যা দুজন ভাড়া করা মানুষের যোগ্য। এটাই বুদ্ধি।
    অ্যানিট ক্লান্তভাবে তার কাঁধে ঝাঁকুনি দিল এবং তারা কিছুক্ষণ নীরব থাকল।

    পরের দিন হান্স এল। অ্যানিট তার দিকে গোমড়া মুখ করে তাকাল। তবে তার সঙ্গে কথা বলল না, নড়লও না। হান্স হাসল।
    পালিয়ে না যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। হান্স বলল।
    আমার বাবা-মা আপনাকে আসতে বলে নিজেরা গ্রামে চলে গেছে। এটা আমার পক্ষে একপ্রকার ভালোই হল কেননা আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটি বিশেষ কথা আছে। বসুন।
    সে তার কোট ও হেলমেট খুলল এবং টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিল।
    আমার বাবা-মা চান আমি আপনাকে বিয়ে করি। আপনি খুব চালাক। উপহার দিয়ে, কথায় ভুলিয়ে আপনি তাদের বশ করে ফেলেছেন। আপনার আনা কাগজে যা থাকে তারা তা বিশ্বাস করে ফেলেছে। কিন্তু শুনে রাখুন, আমি কখনওই আপনাকে বিয়ে করব না। আমি ভাবতে পারছি না এটা সম্ভব হবে বলে কেননা আপনাকে আমি যেমন ঘৃণা করি তেমনটা আর কোনো মানুষকে করি না
    আমাকে জার্মানিতে কথা বলতে দাও। আমি কী বলতে চাইছি তুমি যথেষ্টই বোঝ।
    আমি পারি। আমি শিখেছিলাম, কেননা দু-বছর ধরে স্টুটগার্টে আমি দুটি ছোট্ট মেয়ের আয়া ছিলাম।
    হান্স জার্মানিতে কথা বলতে শুরু করল কিন্তু অ্যানিট ফরাসিতে কথাবার্তা চালিয়ে গেল।
    এটা কেবল এই নয় যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার তারিফ করি। তোমার স্বাতন্ত্র্য ও লালিত্যকে আমি সম্মান করি। তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমি বুঝতে পারি না। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি। আমি বুঝতে পারছি, যদি সম্ভবও হয়, তবুও তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও না। কিন্তু পিইরি তো মৃত।
    তার কথা বলবেন না। অ্যানিট প্রচণ্ডভাবে কাঁদতে লাগল। এটাই হতে পারত বাঁচার শেষ আশ্রয়।
    আমি কেবল তোমাকে এটা বলতে চাই যে, তার মৃত্যুতে তোমার কথা ভেবে আমি সত্যি দুঃখিত।
    জার্মান জেলাররা তাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করেছে।
    হতে পারে। সময়ে তার শোক তোমার অনেকটা কমে যাবে। তুমি কি জানো, ভালোবাসার মানুষ যখন মারা যায়, তখন মনে হয় তুমি এই দুঃখটা কিছুতে এড়াতে পারবে না। কিন্তু এটা এড়াতে হয়। তাই এটা ভালো নয় কি, একজনকে তোমার সন্তানের পিতা করা?’
    এমনকি যদি ধরে নিই, কোনোকিছুই না ঘটত, তাহলেও আপনি কি ভেবেছেন আমি কখনও ভুলতে পারব না যে আপনি একজন জার্মান আর আমি ফরাসী স্ত্রীলোক। যদি আপনি জার্মানদের মতো নির্বোধ না হন, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ওই শিশুটি আমার কাছে কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আপনি কি মনে করেন আমার কোনো বন্ধু নেই? এক জার্মান সৈনিকের সন্তানের মা হয়ে আমি তাদের মুখের দিকে তাকাব কী করে? আপনাকে আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, আমার দুর্ভাগ্যের মধ্যে আমাকে একাকী থাকতে দিন। চলে যান। ভগবানের দোহাই, আপনি চলে যান। আর কোনোদিন আসবেন না।
    কিন্তু সে আমার সন্তান। আমি তাকে চাই।
    আপনি!’ অ্যানিট বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। মদ্যপ অবস্থায় যে অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাকে নিজের বলে দাবি করেন কী করে!’
    তুমি বুঝতে পারছ না, আমি খুব খুশি, খুব গর্বিত যখন আমি জানতে পারলাম তুমি সন্তানের জন্ম দিতে চলেছ, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। এটা ছিল একটা চমক। আমি কি বলতে চাইছি তুমি বুঝতে পারছ না? যে শিশুটি জন্মাতে চলেছে, এই পৃথিবীতে সে আমার সব। আমি বুঝে উঠতে পারছি না কী করে এটা প্রকাশ করব এটা আমার হৃদয়ে এমন একটা অনুভূতির সৃষ্টি করেছে যা আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না।
    অ্যানিট গভীরভাবে তার দিকে তাকাল এবং তার চোখে একটা অদ্ভুত দ্যুতি খেলে গেলবলতে পারা যায়, এটা যেন একটা বিজয়ের হাসি। সে হাল্কা হাসল।
    আমি ভেবে পাচ্ছি না আমি আপনাদের জার্মানিদের নিষ্ঠুরতাকে বেশি ঘৃণা করব নাকি আপনার ভাবপ্রবণতাকে?’
    মনে হল হান্স মেয়েটির কথা শুনতে পেল না।
    আমি তার কথা সবসময় ভাবি।
    আপনি কি ভেবে নিয়েছেন ছেলে হবে?’
    আমি জানি ছেলে হবে। আমি চাই তাকে কোলে নিতে এবং তাকে হাঁটা শেখাতে। তারপর যখন সে বড়ো হবে, আমি যা যা জানি সব তাকে শেখাব। আমি তাকে ঘোড়ায় চড়া শেখাব, বন্দুক চালানো শেখাব। তোমাদের ছোটো নদীতে কি মাছ আছে? আমি তাকে মাছ ধরা শেখাব। আমি এই পৃথিবীর সব থেকে গর্বিত বাবা হতে চলেছি।
    অ্যানিট তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার মুখ ছিল স্থির ও কঠোর। একটা ভাবনা, ভয়ংকর ভাবনা আপনাথেকেই তার মনে সৃষ্টি হচ্ছিল। হান্স তার দিকে তাকিয়ে নরম হাসি হাসল।
    হতে পারে, তুমি যখন দেখবে আমি আমাদের ছেলেকে কতখানি ভালোবাসি, তখন তুমি আমায়ও ভালোবাসবে। প্রিয়তমা, আমি তোমার ভালো স্বামী হয়ে উঠব।
    অ্যানিট কিছু বলল না। সে কেবল তার দিকে গোমড়া মুখ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
    তুমি কি আমার সঙ্গে একটাও ভালো কথা বলতে পার না?’ হান্স বলল।
    অ্যানিটের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে নিজের দু-হাত শক্ত করে ধরল, অন্যেরা আমাকে ঘৃণা করতে পারে। কিন্তু আমি এমন কিছু করব না, যাতে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করি। আপনি আমার শত্রু এবং চিরকাল শত্রুই থাকবেন। আমি বেঁচে আছি কেবল ফ্রান্সের স্বাধীনতা দেখবার জন্য। স্বাধীনতা আসবে। হয়তো পরের বছর নয়, কিংবা তার পরের বছর, হতে পারে তিরিশ বছরেও আসবে না, তবে আসবে। বাকিরা তাদের যা ইচ্ছে করতে পারে কিন্তু আমি কখনওই আমার দেশের আক্রমণকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করব না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি এবং আপনি আমার গর্ভে যে সন্তান দিয়েছেন তাকেও ঘৃণা করি। হ্যাঁ, আমরা পরাজিত। শেষ পরিণতি আসার আগে আপনি দেখবেন আমরা জিততে পারিনি। এখন যান, আমি আমার মন স্থির করে নিয়েছি এবং ঈশ্বরের পৃথিবীতে কোনোকিছুই আমার মনকে পরিবর্তন করতে পারবে না।
    হান্স দু-এক মুহূর্ত নীরব থাকলতুমি কি ডাক্তারের ব্যবস্থা করেছ? আমি সমস্ত খরচ করব।
    আপনি কি চান আমরা আমাদের লজ্জা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দিই? যা কিছু প্রয়োজন আমার মা করবে।
    কিন্তু ধরো যদি কিছু দূর্ঘটনা ঘটে যায়?’
    দয়া করে আপনি আপনার নিজের চরকায় তেল দিন।
    সে দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। যখন সে তার পেছনের দরজা বন্ধ করল অ্যানিট দেখতে পেল, হান্স ছোটো রাস্তা ধরে বড়ো রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রোধের সঙ্গে সে অনুভব করল তার বলা কিছু কথা হান্সের হৃদয়ে এমন কিছু অনুভূতি সৃষ্টি করেছে যা সে আগে অনুভব করেনি।
    হে ভগবান, আমাকে শক্তি দাও। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল।
    হান্স যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তাদের অনেক দিনের কুকুরটি তার পেছনে ক্রুদ্ধভাবে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটল। হান্স কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করছে কুকুরটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কিন্তু কুকুরটা তার ডাকে সাড়া দেয়নি। যখনই সে তার পিঠে চাপড় দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সে দাঁত বের করে গরগর করতে করতে পিছিয়ে গেছে। এখন যখন কুকুরটা তার দিকে গেল, তার হতাশা আর বিরক্তি বাড়িয়ে দিল। হান্স তাকে হিংস্র ও নিষ্ঠুরভাবে লাথি মারলকুকুরটি একটি ঝোপের কাছে গিয়ে পড়ল এবং চিৎকার করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।
    পশু!’ অ্যানিট চিৎকার করে উঠল, মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা! তার জন্য প্রায় দুঃখিত হয়ে আমি যথেষ্টই দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলেছিলাম
    দরজার পাশে একটা আয়না ঝুলছিলঅ্যানিট আয়নায় নিজেকে দেখল। সে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু হাসির থেকে এটাকে বরং পৈশাচিক মুখবিকৃতি বলে মনে হল।

    এখন মার্চ মাস। সইসনস-এর সেনাবাহিনীতে কাজকর্ম বেড়ে গেছে। সেখানে পর্যবেক্ষণ হতে লাগল এবং জোর ট্রেনিং শুরু হল। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল। সন্দেহ ছিল না, তারা কোথাও যাচ্ছিল কিন্তু সাধারণ মানুষ অনুমান করতে পারল না কোথায়কেউ কেউ ভাবল তাদের ইংল্যান্ড আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হচ্ছে। অন্যদের মতে তাদের বলকানে পাঠানো হবে। আবার কেউ কেউ বলল তাদের ইউক্রেনে পাঠান হবে। হান্সও ব্যস্ত ছিল।
    দ্বিতীয় রবিবারের আগে পর্যন্ত সে খামারবাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেল না। এটি ছিল একটি ধূসর শীতার্ত দিন, তুষারপাত হয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন হঠাৎ ঝোড়ো দমকা বাতাসে তুষারপাত শুরু হয়ে যাবে। দেশটা ছিল বিবর্ণ ও প্রাণহীন।
    যখন সে ঘরে ঢুকল ম্যাডাম পেরিয়ার চিৎকার করে উঠল, তুমি! আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ।
    আমি আগে আসতে পারিনি। আমরা যে কোনোদিন চলে যাব। জানি না কখন।
    আজ সকালে বাচ্চাটি জন্মেছে। ছেলে হয়েছে।
    হান্সের হৃদপিণ্ডটা বুকের মধ্যে লাফিয়ে উঠল। সে বৃদ্ধ মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরল এবং তার দুই গালে চুমু খেল।
    রবিবারের সন্তান। সে খুব ভাগ্যবান হবে। এখন শ্যাম্পেনের বোতল খোলা যাক। অ্যানিট কেমন আছে?’
    যেমনটা আশা করা যায়, তেমন আছে তার সময়টা ভালো ছিল। গতকাল রাতে তার যন্ত্রণা উঠেছিলআজ ভোর পাঁচটায় সবকিছু মিটে গেল।
    বৃদ্ধ পেরিয়ার স্টোভের কাছে বসে পাইপ টানছিলছেলেটির উৎসাহ দেখে সে মৃদু হাসল বলল, কারও প্রথম সন্তান তার উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
    তার মাথায় অনেক চুল আছে এবং সে তোমার মতো সুন্দর। তোমার মতো নীল চোখ। ম্যাডাম পেরিয়ার বলল‘এত সুন্দর ছেলে আমি আগে দেখিনি। সে ঠিক তার বাবার মতো হয়েছে।
    হে ভগবান! আমি খুব খুশি। হান্স চিৎকার করে উঠল। পৃথিবীটা কত সুন্দর! আমি অ্যানিটকে দেখতে চাই।
    আমি জানি না সে তোমাকে দেখবে কি না। আমি প্রথমেই তাকে বিপর্যস্ত করতে চাই না।
    না না, আমার জন্য তাকে বিপর্যস্ত করবেন না। যদি সে আমাকে দেখতে না চায়, এটা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু আমি এক মুহূর্তের জন্য বাচ্চাটিকে দেখতে চাই।
    দেখছি আমি কী করতে পারি। আমি তাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।
    ম্যাডাম পেরিয়ার চলে গেল এবং তারা ভারী পায়ের শব্দ সিঁড়িতে শুনতে পেল। পরমুহূর্তে তাকে ঠকঠক করে নেমে আসতে শুনল। সে রান্না ঘরে দৌড়ে গেল।
    তারা এখানে নেই। অ্যানিট তার ঘরে নেই, বাচ্চাটিও নেই।
    পেরিয়ার ও হান্স চিৎকার করে উঠল এবং কী করবে ভেবে না পেয়ে তিনজনেই লাফাতে লাফাতে উপরতলায় গেল। শীতের বিকেলের কর্কশ আলো এসে পড়ছিল ঘরের বিবর্ণ আসবাবপত্র, লোহার বিছানা, সস্তা আলমারি, ড্রয়ারের সিন্দুক, একটা অন্ধকারময় আবর্জনায়ঘরের মধ্যে কেউ ছিল না।
    সে কোথায়?’ ম্যাডাম পেরিয়ার চিৎকার করে উঠলসে সরু রাস্তাটি দিয়ে দৌড়ে গেলদরজা খুলে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলঅ্যানিট, অ্যানিট। ওহ, কী পাগলামি!’
    হয়তো বসার ঘরে।
    তারা নীচতলার অব্যবহৃত বৈঠকখানায় গেল। দরজাটা খোলামাত্র একটা বরফ শীতল হাওয়া তাদের ছুঁয়ে গেল। তারা একটা মজুত ঘরের দরজা খুলল।
    সে বেরিয়ে গেছে। ভয়ংকর কিছু ঘটেছে!’
    সে কীভাবে বেরিয়ে গেল?’ হান্স উদ্বেগের সুরে জিজ্ঞাসা করল।
    বোকা, সামনের দরজা দিয়ে।
    পেরিয়ার এগিয়ে গেল এবং দেখল।
    ঠিক বলেছ। খিল খোলা রয়েছে।
    হা ভগবান, হা ভগবান! কী পাগলামি!’ ম্যাডাম পেরিয়ার চিৎকার করে উঠলতাকে মেরে ফেলবে।
    আমাদের অবশ্যই তাকে খুঁজতে হবে, হান্স বলল। যে পথ দিয়ে হান্স যাতায়াত করত, সহজাতভাবে সেই পথ ধরে সে রান্নাঘরের পেছনে দৌড়ে গেল এবং বাকিরা তাকে অনুসরণ করল। এই রাস্তা কোথায় গেছে?’
    ছোট্ট নদীর দিকে বৃদ্ধা স্ত্রীলোক হতবাকভাবে উত্তর দিল।
    হান্স ঘুরল। মনে হল যেন সে ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। ভয়ার্তভাবে সে বৃদ্ধা মহিলার দিকে চেয়ে রইল।
    আমার ভয় করছে। সে চিৎকার করে উঠল। আমার ভয় করছে।
    হান্স দরজা খুলল। যেইমাত্র না সে দরজা খুলল, অ্যানিট ঘরের মধ্যে ঢুকল। তার শরীরে রাতের পোশাক আর ছোট্ট রেশমের গাউন ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। এটা ছিল গোলাপী যার ওপর ছিল বিবর্ণ নীল ফউলের কাজ। তার মাথা থেকে ভেজা চুলগুলো এলোমেলোভাবে ঝুলছিল। তাকে মৃতের মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। ম্যাডাম পেরিয়ার দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।
    তুমি কোথায় গিয়েছিলে? বেচারা, বাছা আমার! তুমি ভিজে গেছ। এসব কী পাগলামি!’
    কিন্তু অ্যানিট তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। সে হান্সের দিকে তাকাল।
    আপনি একেবারে সঠিক সময়ে এসেছেন।
    বাচ্চাটি কোথায়?’ ম্যাডাম পেরিয়ার চিৎকার করে উঠল
    আমাকে এখুনি এটা করতে হল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, যদি দেরি করি তাহলে আমার সাহস থাকবে না।
    অ্যানিট তুমি কী করেছ?’
    আমি তাই করেছি যা আমার করার ছিল। আমি তাকে নদীতে নিয়ে গেছি এবং যতক্ষণ না মারা যায় জলে ডুবিয়ে রেখেছিলাম।
    আঘাতে মৃতপ্রায় প্রাণীরা যেমন করে চিৎকার করে ওঠে, হান্স সেভাবে চিৎকার করে উঠল। সে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল, মাতালের মতো টলতে টলতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। অ্যানিট চেয়ারের ওপর বসে পড়ল এবং দুই মুষ্ঠির ওপর কপাল রেখে গভীর কান্নায় ফেটে পড়ল।

No comments:

Post a Comment