Thursday, April 30, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-১৪

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত...

সময় বড়ো অদ্ভুত। কখন যে কী ঘটে যায় তা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। কেউ কি কখনও ভাবতে পেরেছিল জীবনের গতি আচমকাই এমন থমকে যাবে? স্তব্ধ হয়ে যাবে পৃথিবী? মানুষ হয়ে যাবে গৃহবন্দী? বদলে যাবে জীবনের সমস্ত হিসেব নিকেশ? করোনা নামে একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস তছনচ করে দেবে সবকিছু?
    ডাঃ সুধীর দেহারিয়া। ডাক্তার হিসেবে বেশ নাম যশ দেশের করোনা যুদ্ধের তিনিও একজন সৈনিক তিনি কি কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলেন জীবনে এমন দিন আসবে? বাড়ি ফিরলেন কিন্তু ঘরে ঢোকা হল না। ফিরে যেতে হল উঠোন ছুঁয়ে। দূর থেকে দেখলেন স্ত্রী-সন্তানদের নিজের সংসারেও কি তবে তিনি ব্রাত্য আজ?
    ডাঃ শিফা এম-মহম্মদও কোনোদিন কি ভেবেছিলেন জীবনে এমনদিন আসবে? ২৩ বছরের যুবতী শিফা পেশায় সার্জেন করোনা যুদ্ধের তিনিও একজন সৈনিক মার্চ মাসে তার বিয়ের সব ঠিকঠাক কিন্তু তিনি বা তার পরিবারের কেউ কি কোনোদিন ভেবেছিলেন দিনটা নীরবেই চলে যাবে? শরীরে বিয়ের পোশাক উঠল না, অনুষ্ঠান হল না, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হল না। উপরি হিসেবে জুটল বন্ধুদের ব্যাঙ্গ আর বিদ্রূপ ব্রাত্যের তকমা কি লেগে গেল তারও গায়ে?
    রোজকার ডিউটি শেষে বাসায় ফেরেন ডাঃ সঞ্জীবনী পাণিগ্রাহী ৩৬ বছরের এই মহিলা পেশায় মনোবিদ সেদিন বাড়ি ফিরে তিনি চমকে উঠলেন প্রতিবেশীরা আটকে দিয়েছে গেট তাকে ঢুকতে দেবে না রোজকার চেনা মানুষগুলো আজ কেমন অচেনা মনের ডাক্তার নিজেই বেশ অবাক হয়ে যান ‘মন’ শব্দটা তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে অবাক হয়ে ভাবেন তিনি কি তবে আজ সমাজের চোখে অস্পৃশ্য হয়ে গেলেন? করোনা নামক ভাইরাস কি তবে সমাজে অস্পৃশ্যতার জন্ম দিচ্ছে?
    করোনা গ্রুপের নবতম ভাইরাস কোভিড-১৯। এই অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস বিশ্ব বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে বিশ্বের দুশোর বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই দুই লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় উন্নত দেশগুলির অবস্থা বিপর্যস্ত বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আতঙ্ক আর হাহাকারের সুর করোনার কোনা টিকা নেই চিকিৎসার নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই তবুও চিকিৎসকেরা হাল ছেড়ে দিয়ে বসে নেই সীমাবদ্ধ ক্ষমতাকে সম্বল করে, অত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তারা লড়াই করে চলেছেন। দুনিয়া জুড়ে মৃত্যু মিছিল দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেরে উঠেছেন তার থেকেও কয়েক গুন মানুষ
    করোনার কারণে আমাদের দেশে লকডাউন চলছে গৃহবন্দী মানুষ কিন্তু এই ভয়ংকর সংকটের সময়ে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে লড়াই করে যাচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, পুলিশকর্মী, দমকলকর্মী, সাফাইকর্মী প্রমুখরা। ডাক্তার, নার্স সহ বিভিন্ন চিকিৎসা কর্মীরা একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রোগের মোকাবিলা করছেন তারা হলেন Front-Line Warrior. আমরা ঘরে বসে আছি যাতে ভাইরাস আমাদের শরীরে কোনোভাবে প্রবেশ করতে না পারে আমরা জানি না আমাদের আশেপাশে আদৌ ভাইরাসটি উপস্থিত আছে কি না কিন্তু ওইসব চিকিৎসক নার্সরা সরাসরি ভাইরাসের সঙ্গে আছেন প্রতি পদে পদে তাদের কতখানি ঝুঁকি সেটা সহজে অনুমেয় দিনরাত এক করে, সংসার পরিজন থেকে দূরে তারা লড়াই করছেন তারা কেবল ডাক্তার বা নার্স নন, তারা যোদ্ধা তারা হলেন সমাজের প্রকৃত নায়ক
    প্রথম দফার লকডাউন চালু হওয়ার দুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশব্যাপী পালিত হয়েছিল জনতা কার্ফু প্রধানমন্ত্রী সেদিন দেশবাশীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, ওইদিন বিকাল পাঁচায় শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে, হাতে তালি দিয়ে এই করোনা যুদ্ধের অসম সাহসী সৈনিকদের সম্মাননা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে দেশের সকল প্রান্তের বেশিরভাগ মানুষ সেদিন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করেছিলেন এরপর আমরা দেখি ডাক্তার নার্সদের নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথাবার্তা, মন্তব্য মিডিয়ার পাতায় ঘোরাফেরা করতে থাকে এখনও সেসব বন্ধ হয়ে গেছে তা নয় কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশময় যে টুকরো টুকরো ছবি উঠে আসছে তা দেখে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি আমরা আমাদের প্রকৃত যোদ্ধাদের সম্মান দিচ্ছি? হয়তো বিক্ষিপ্ত ঘটনা, তবুও এটা ঠিক সমাজের কোথাও কোথাও ডাক্তার নার্সরা যেন অস্পৃশ্য হয়ে উঠেছেন। আমরাই তাদের সঙ্গে তেমন আচরণ করছি। করোনা মোকাবিলায় ডাক্তার-নার্সদের লড়াইকে সম্মান জানিয়ে অনেকেই তাদের ঈশ্বর আখ্যায় আখ্যায়িত করছেন তাহলে কি বলব ঈশ্বরও আজ অস্পৃশ্য?
    করোনার এখনও প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই আমাদের দেশের চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নত দেশগুলির তুলনায় যথেষ্টই কম এছাড়াও নানাবিধ সমস্যা রয়েছে বহুবিধ প্রতিকূলতা সঙ্গে নিয়ে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার নার্সরা প্রতি মুহূর্তে সংক্রমণের আশঙ্কা ইতিমধ্যেই অনেক ডাক্তার কিংবা নার্স সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এটা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না কত ঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজ করতে হয় তারা তা করছেনও তাদের যোদ্ধা কিংবা ঈশ্বর যাই বলি, মোদ্দা কথা হল দেশ তাদের দিকে তাকিয়ে
    সারা দেশে এখন চিকিৎসকদের নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা শোনা যাচ্ছে কিন্তু আলো থাকলে অন্ধকার থাকবে না এমনটা তো হতে পারে না সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসক নার্সরা আক্রান্ত হচ্ছেন, হেনস্থার শিকার হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কি? তারা যেহেতু হাসপাতালে রোগীর দেখাশোনা করছেন তাই তাদের শরীরে করোনা ভাইরাস আছে তাদের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার ভয়। তাই কোথাও তাদের নিজদের বাসায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কোথাও বাড়িওয়ালা তাদের বলছেন হাসপাতালে থাকতে, কখনও বা আবার বাড়ি খালি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
    গত ২৩ মার্চ রোজকার ডিউটি শেষ করে ডাঃ সঞ্জিবনী পানিগ্রাহী যখন বাসায় ফেরেন তার আবাসনের প্রতিবেশীরা গেট আগলে দাঁড়ায় তারা তাকে আবাসনে ঢুকতে দিতে চান না কারণ করোনা সংক্রমনের ভয় অথচ এই মানুষগুলো অসুবিধায় পড়লে তার কাছে ছুটে আসে সাহায্যের জন্য আশ্চর্যের বিষয় ডাঃ সঞ্জীবনী মনোবিদ তিনি করোনা পেশেন্টের চিকিৎসা করেননি সে কথা বলার পরও তারা তাকে ঢুকতে দিতে রাজি হন না এতখানি আতঙ্ক মানুষের মনে হতবাক সঞ্জীবনী বলেন, “মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করছে। আমি সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি যেন হঠাৎ করে অস্পৃশ্য হয়ে গেছি।” একজন মনোবিদের মনে হচ্ছে তিনি যেন মানুষের চোখে অস্পৃশ্য (untouchable) হয়ে গেছেন।
    হায়দ্রাবাদের এক জুনিয়র ডাক্তারের কথা শুনলে চমকে উঠতে হয়। তার বাড়িওয়ালা তাদের ‘নোংরা’ (dirty) বলে উল্লেখ করেন। তাদের বাড়ি খালি করে দিতে বলেন। ডাক্তারের কথায়, “They asked us to vacate without any notice. Most of the doctors are now on the streets and have nowhere to go.” এর থেকে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! চেন্নাইয়ের এক নার্স লতা কুমারী। আগে তিনি কাজ থেকে ফিরলে বাড়িওয়ালি তার সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। কিন্তু এখন তার দিকে ফিরেও তাকান না। উল্টে তাকে পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছেন বাড়ি ছাড়ার কথা।
    ডাঃ লাভলীন মঙ্গলা। নয়ডার মেট্রো হসপিটাল এ্যান্ড ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ডাক্তার। এরকম সামাজিক অত্যাচারের শিকার তিনিও। অত্যন্ত হতাশ গলায় তাঁর বক্তব্য, “সামাজিক বৈষম্যের এমন খবর দেখে সত্যিই হতাশ লাগছে। এসব আমি আগে কখনও দেখিনি। ভাইরাস আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা করতে গিয়ে আমরাও তো আমাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছি।” একেবারে সত্যি কথা। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের সেবা করছেন আর মানুষ তাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছেন।
    আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও ডাক্তার নার্সদের ওপর আক্রমণ, তাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখার ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজ্যে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসার প্রধান হাসপাতাল বেলেঘাটা আইডি। এই হাসপাতালের এক জুনিয়র ডাক্তার অর্ঘ্যদীপ গাঙ্গুলি। একদিন ডিউটি সেরে বাসায় ফিরতে গিয়ে রাস্তায় আটকে পড়েন। পরপর সাতজন ট্যাক্সি ডাইভার তাকে গাড়িতে নেন না কারণ তিনি ওই হাসপাতালে কাজ করেন। তাঁর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “It seemed that the people in the country have found yet another reason to ostracize and abuse its medical personal who are at the frontline of this battle against Covid-19.”
    কলকাতার এক নার্স দুই সন্তান ও বয়স্কা মাকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে থাকেন। তাকে বাড়িওয়ালা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে বলেন। শুধু মুখে বলা নয়, সঙ্গে দুজন মানুষকে সঙ্গে এনে একপ্রকার ভয় দেখান তিনি। নার্স জানান তিনি করোনা রোগীদের দেখাশোনা করছেন না। তাতে সন্তুষ্ট হন না বাড়িওয়ালা। তার বক্তব্য, হাসপাতালে করোনো রোগী নিশ্চয়ই আছে। তিনি জেনেছেন করোনা ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় আর আশপাশের মানুষকে আক্রান্ত করে। এই কারণে সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাই তিনি কোনোমতেই তাকে থাকতে দিতে রাজি হন না।
    আটচল্লিশ বছরের কাজরি হালদার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। তার স্বামীকে প্রতিবেশীরা বলে দেন তার স্ত্রীকে তিন মাস বাসায় না ফিরে ওই হাসপাতাল বা অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে নিতে। বাধ্য হয়ে কাজরিকে তাই করতে হয়। এইভাবে নানা প্রান্তে হেনস্থা ও অবমাননার ঘটনা ঘটতে থাকে। বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তার অ্যাসোশিয়েশন FORDA (Federation Of Resident Doctors Association) নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে আবেদন জানান।
    প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কানেও ব্যাপারটা যায়। ২৫ মার্চ এক বক্তব্যে তিনি দেশবাসীকে আবেদন জানিয়ে বলেন, “যদি আপনারা দেখেন কোনো চিকিৎসা কর্মীর ওপর কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটছে, তাহলে সেখানে গিয়ে মানুষকে বোঝান তারা যা করছেন ভুল করছেন।” সেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও বলেন, “এই সংকটের সময়ে হাসপাতালে সাদা কোট পরা প্রতটি মানুষই হলেন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি স্বরূপ। এই মানুষেরা মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের জীবন রক্ষা করছেন। এই করতে দিয়ে তারা নিজেদের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।”
    প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কথাই সত্য। যে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই এই সত্য বুঝতে পারবেন। দেশে করোনা প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাও ডাক্তার-নার্সদের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে। ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত। অনেকেই আক্রান্তের সম্ভাবনায় আইসোলেশনে চলে গেছেন কিংবা কোয়ারেন্টাইনে। সময় যত এগোবে, রোগীর সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, এদের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষদের উচিৎ তাদের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতার বার্তা দিয়ে তাদের মানসিক জোর বাড়ানো। কিন্তু তা না করে যদি তাদের অস্পৃশ্যের চোখে দেখা হয়, তাদের নানাভাবে হেনস্থা করা হয় তাহলে আখেরে কিন্তু সমস্যা আমাদেরই। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে করোনা নামক এই মারণ ভাইরাসের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন একমাত্র এই ডাক্তার নার্সরাই। তাই তাদের যদি অস্পৃশ্য বলে দূরে সরিয়ে দিই, সমাজ-বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করি তাতে বিপদটা সকলেরই। ডাক্তার নার্সদের দূরে সরিয়ে রাখলে করোনা আসবে না এমন কোনো গ্যারেন্টি নেই। কিন্তু এটা নিশ্চিত করোনা আক্রান্ত হলে ওইসব ডাক্তার নার্স ছাড়া কোনো গতি নেই। শুধুমাত্র পেশাগত কর্তব্য পালন নয়, করোনা মোকাবিলায় দেশের অসংখ্য ডাক্তার, নার্সরা ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন। আমাদের উচিৎ সেইসব মানুষদের পাশে থাকা।
    না, ডাঃ সুধীর দাহেরিয়াকে কেউ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়নি। ডাঃ সুধীর দাহেরিয়া মধ্যপ্রদেশের ভূপালের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ছিলেন। হাসপাতালে পাঁচদিন ডিউটি দেওয়ার পর গত ৩০ মার্চ তিনি বাড়ি আসেন স্ত্রী সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে। করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর অন্যতম শর্ত হল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সে সময় করোনা সেভাবে মাথাচাড়া দেয়নি ভূপালে। তাসত্ত্বেও তিনি সামাজিক দূরত্ব পালন করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া ছবিতে দেখা যায় বাড়ির গেটের বাইরে একটি উঁচু জায়গায়া বসে তিনি চা খাচ্ছেন। শরীরে তখনও হাসপাতালের পোশাক। আর বাড়ির গেটের ভেতর স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। চা খেতে খেতে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এই সময় প্রতিবেশী একজন ছবিটি তোলেন। ওদিন সামান্য দেখা করে তিনি আবারও ডিউটিতে ফিরে যান। ডাঃ সুধীরের এই ব্যাপারটা পোস্ট হওয়ার পর বহু মানুষ তার এই অ্যাটিটুডের প্রশংসা করেন। চারুদত্ত আচার্য নামে যিনি এই ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন তিনি তার বিবরণের শেষে একটা অসাধারণ লাইন লেখেন, “ইয়ে হো তা হ্যা সৈনিক কা এন্ট্রি।” সত্যি সত্যি তিনি একজন সৈনিক। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহানও তার প্রশংসা করেন টুইটারে লেখেন, “Meet Mr. Sudhir Deharia, who’s the CHMO of Bhopal district. On Monday, he reached residence after 5 days, sat outdoors the home and drank tea, took care of the household and returned to the hospital from outdoors. My finest needs to Dr. Deharia and 1000’s of thousands and thousands of Corona Warriors like these. We are pleased with you.”
    সত্যি এমন ত্যাগগে কুর্ণিশ জানাতে হয়। ডাঃ শিফা এম মহম্মদও কি কম বড়ো ত্যাগ স্বীকার করেছেন! কেরালার মেয়ে শিফা। গত ২৯ মার্চ তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল দুবাইয়ের ব্যবসায়ী আনুস মহম্মদের সঙ্গে। এদিকে দেশের সঙ্গে সঙ্গে কেরালাতেও তখন বাড়ছে করোনা রোগী। উল্লেখ্য আমাদের দেশে কেরালাতেই প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। যাই হোক, রাজ্যের এই সংকটময় অবস্থায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য বলে মনে করেন শিফা। সেই মতো বাবা-মা, হবু স্বামীকে জানিয়ে দেন তিনি এখন বিয়ে করবেন না। সবাই তার সিদ্ধান্তে মত দেন। বাবা মুক্কম মুহম্মদ পরে জানান, “প্রত্যেক মেয়ের জীবনে বিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু আমার মেয়ে তার ব্যক্তিগত স্বর্থ দূরে সরিয়ে রেখে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাগত অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সে যখন বিয়ে বন্ধের কথা বলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাতে সম্মত হই।” কান্নুরের প্রিয়ারাম মেডিক্যাল কলেজের আইসোলেশন ওয়ার্ডে তার দায়িত্ব পড়ে। যেদিন শরীরে ওঠার কথা বিয়ের পোশাক, সেদিন তার জায়গায় তিনি তুলে নেন পিপিই। তার এমন সিদ্ধান্তে তার কিছু বন্ধু বান্ধব তাকে বিদ্রূপও করেন। তবে সেটা তিনি গায়ে মাখেননি। কেননা, তিনি মনে করেন মানবতা যখন বিপন্ন তখন ব্যক্তি স্বার্থগুলো দূরে সারিয়ে রাখতে হয়। তার এমন সিদ্ধান্তে চারিদিকে প্রশংসার ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু শিফার ছোট্ট জবাব, “Marriage can wait but my patients who are struggling for their lives in the isolation ward.” মাত্র ২৩ বছরের এক মেয়ের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কতখানি বিরাট ব্যাপার তা একটু গভীরভাবে অনুধাবন না করলে আমরা বুঝতে পারব না। অথচ সেই শিফার সলজ্জ জবাব, “আমি বিরাট কিছু করে ফেলিনি। আমি কেবল আমার কর্তব্য করেছি। আমার মতো এমন অনেকে আছে যারাও তাদের বিয়ে বন্ধ রেখেছে।”
    কেরালার মেয়ে রেশমা মোহন দাস। ৩২ বছরের রেশমা কেরালার একটি করোনা হাসপাতালের মূলত আইসিইউ বিভাগে কাজ করতেন। গত ২৩ মার্চ তার শরীরে করোনা উপসর্গ দেখা দেয় এবং পরের দিন রিপোর্ট আসে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। প্রসঙ্গত বলার, ভারতবর্ষের করোনা মোকাবিলায় এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বয়সের যে মানুষটি (এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত) সেরে উঠেছেন তিনি হলেন থমাস আব্রাহাম (৯৩)। তাঁকে এবং তার স্ত্রী মারিয়াম্মা (৮৮)-কে আইসিইউতে দেখাশোনা করতেন রেশমা। ১২ মার্চ থেকে তিনি এই দুজনের দেখভাল করছিলেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে ভেঙে পড়েননি রেশমা। চিকিৎসা চলাকালীন বন্ধুদের হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ করে লেখেন, “I will leave this room within a week after defeating you [the novel coronavirus].শেষমেষ করোনাকে হারিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু সুস্থ ফিরে ঘরে বসে থাকতে চান না তিনি। আবারও ফিরে যেতে চান তার পেশাগত জীবনে, মানুষের সেবায়। চিকিৎসকরা তাকে এখনও ১৪ দিন বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু রেশমা জানান, সাতদিন পরেই তিনি কাজে যোগ দিতে চান। কতখানি মানসিক জোর থাকলে এমন ভাবনা ভাব সম্ভব তা সহজে অনুমেয়। একি কেবল পেশাগত দায়বদ্ধতা? নাকি তার বাইরে অন্য কিছু?
    মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন দেশ বিদেশের চিকিৎসক নার্সদের ছবি। যে ছবিগুলো দেখে আমরা চমকে উঠি। জীবনের ঝুঁকি তো রয়েছেই, পাশাপাশি সংসার পরিজন বিচ্ছিন্ন হয়ে কী পরিমান পরিশ্রম তারা দিনের পর দিন করে চলেছেন তা ভাবলেই চমকে উঠতে হয়। আমাদের দেশের এই মারাত্মক গরমের সময়ে পিপিই পরে একটানা কাজ করাটা কতটা কষ্টকর তা আমাদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। এত ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার করে তারা কাজ করে চেলেছেন।
    সারা দেশের অসংখ্য ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থ-সুখের কথা ভুলে দিনরাত এক করে লড়াই করে চলেছেন। এমন এক লড়াই যার কোনো আগাম প্রস্তুতি নেই। হাতে সেভাবে কোনো অস্ত্র নেই। ভয়ংকর এক চাপের মধ্যে রয়েছেন তারাও। সেই অবস্থায় আমাদের উচিৎ অন্তত মানসিকভাবে তাদের সঙ্গে থাকা। কিন্তু দেশের বিভন্ন প্রান্তে তাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক ভাবে নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। সেটা শুধু লজ্জার নয়, ভয়েরও। কোথাও তাদের সঙ্গে অস্পৃশ্যের মতো আচরণ করা হচ্ছে, নিজের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কাউকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, কোথাও তাদের ওপর ইঁট পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। যাদের হাতে আমাদের জীবনের চাবিকাঁঠি, তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার প্রকারান্তরে নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু আমরা সেটা বুঝছি না। তাই তো তাদের সুরক্ষায় শেষমেষ দেশের সরকারকে নতুন করে আইন প্রণয়ন করার কথা ভাবতে হচ্ছে। এদের ওপর কোনো অন্যায় হলে শাস্তি স্বরূপ জেল জরিমানা হবে।
    কিন্তু আইন দিয়ে কি সবকিছুর সমাধান করা যায়? তাই যদি যেত তাহলে সমাজে এত অন্যায় হত না। আইন থাকবে। কিন্তু তার থেকেও বেশি করে দরকার গনসচেতনতা। কোনা বিষয়ে নিজেদের মতো করে সবকিছু ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্তে না এসে, ঠিকঠাক করে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। কোনো সমস্যা হলে তার উপযুক্ত সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এই মহামারী যেমন আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আগামী দিনেও নেবে, তেমনি করে আমাদের শিখিয়ে যাবে অনেক কিছু। আগামীর নতুন পৃথিবীতে ভালোভাবে বাঁচতে হলে আমাদের চিরাচরিত ভাবধারার পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে সমস্যা নিজেদেরই। তাই ব্রাত্যজনের দলে তাদের না ফেলে, তাদের পাশে আরও বেশি বেশি করে দাঁড়াতে হবে আমাদের, সেটা আমাদের সকলের প্রয়েজনে।

২৫ এপ্রিল, ২০২০।

Friday, April 24, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-১৩


অচেনা স্কুলে একদিন...

টোটো থেকে নেমে মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ সবে সকাল নটা তবুও চারদিক একেবারে নির্জন কোনো মানুষের দেখা নেই সামনের চেনা বাড়িটাকে কেমন অচেনা মনে হল বেশ বিবর্ণ কেমন যেন মনমরা, বিষণ্ণ গেটে ঢুকে রোজকার অভ্যাস মতো প্রথমেই চোখ গেল পাশে স্নিগ্ধ সবুজের সমারোহ যা মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলত সবসময় আজ তেমনটা অনুভব করতে পারলাম না ভোররাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে সূর্যের সাথে এখনও চলছে মেঘেদের লুকোচুরি খেলা বৈশাখী বৃষ্টি আর নরম আলোয় গাছের পাতায় পাতায় সবুজের আলো তবুও মনে হল গাছগুলো যেন অনেকটাই প্রাণহীন একরাশ বিষণ্ণতা এসে গ্রাস করল মনে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম অদ্ভুত শূন্যতার দিকে
    দীর্ঘ আঠাশ দিন পর আজ আবার স্কুলে এলাম আর বিগত আটত্রিশ দিনে এই নিয়ে তৃতীয়বার নয় নয় করে চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে শিক্ষকতা জীবনে পেশাগত জীবনে এমন দীর্ঘ বিরতি এই প্রথম এটা ঠিক বছরে পুজোর একটা বড়ো ছুটি থাকে বিগত কয়েক বছর মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে গ্রীষ্মের ছুটিও বর্ধিত হচ্ছিল কিন্তু এমন দীর্ঘ বিরতি এই প্রথম কেননা প্রকৃত বিরতি তো আটাশ দিনের নয়, আটত্রিশ দিনের।
    স্কুলের সামনের রাস্তাটা বেশ অপরিস্কার ভোরের বৃষ্টি তার ধুলোর আস্তরণ অনেকটা ঢেকে দিতে পারলেও ঝরাপাতারা তখনও লিখে রেখেছে নিঃশব্দের যাপনকথা পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ যে অসুখ বদলে দিয়েছে স্কুলের চেনা রূপ পথ ভালো নেই গাছও ভালো নেই তাই পথের ধুলো আর ঝরাপাতা নীরবে একে-অপরের সাথে ভাগ করে নিচ্ছে গভীর বিষাদের যন্ত্রণা
    পথ ও পাতার বিষণ্ণ চুপকথা পাশে রেখে এগিয়ে যাই পুরোনো বিল্ডিং-এর জীর্ণ সিঁড়িটা যেন বুড়িয়ে গেছে অনেকটাই প্রতিটি ধাপের ধুলোর আস্তরণে নিস্তব্ধতার ছবি সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলা আমার ঘর দীর্ঘ আঠাশ দিন পর তালা খোলা দরজার আংটায় হাত রাখতে গিয়ে সহসা থমকে যাই একটা ভয় চেপে ধরে মনে যে মানুষটি এতদিন এই দরজার তালা খুলে এসেছে, আজ তার হাতের প্রতি একটা অবিশ্বাস জেগে ওঠে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করি একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগে অনেকদিন দরজা জানালা খোলা হয়নি আলো পড়েনি এ-ঘরে ঘরের মেঝেতেও ধুলোর আস্তরণ আমার চেয়ার টেবিলটা মোটামুটি সাফ-সুতরো ব্যগটা পাশে রেখে চেয়ারে বসতে গিয়ে থমকে গেলাম আবারও প্রতিদিন আমার ঘরে ঢোকার আগেই যে মানুষটি খুব যত্ন করে চেয়ার টেবিল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে, আজ মনে মনে তার প্রতি জেগে ওঠে অদ্ভুত সন্দেহ আর অবিশ্বাস বেরিয়ে আসি এগিয়ে যাই বেসিনের দিকে সাবান চাওয়ার আছিলায় জিজ্ঞেস করে নিই, সে হাত পরিস্কার করেছে কিনা স্কুলে এসে আগে ভালো করে সাবানে হাত ধুয়েছে জানার পর মনে মনে আশ্বস্ত হই সদ্য স্যানিটাইজার মাখা হাত তবুও রাখি জলের ধারার নীচে নিজেকে লুকোনোর নিখুঁত অভিনয় সাবান দিয়ে পুনরায় হাত পরিস্কার করতে করতে আসলে মনের মধ্যে জমে থাকা ভাইরাসটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু সন্দেহ এমন এক ভাইরাস যা সাবান স্যানিটাইজার কি বিদায় করতে পারে? নাহলে হাত ধুয়ে নিজের এতদিনের চেনা সেই ঘরে ঢুকতে কেন অস্বস্তি করবে? এতদিন ব্যবহার করে আসা চেয়ারটায় বসতে কেন দ্বিধা জাগবে মনে? কেন বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে---সত্যি ও এসে হাত ধুয়েছে তো? কিংবা ঠিকঠাক হাত ধুয়েছে তো? অদৃশ্য মারণ ভাইরাস কোথায় কোথায় আছে জানি না কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভাইরাসের উপস্থিতি এখন সর্বক্ষণ টের পাই মাত্র কদিনেই এতটাই বদলে গেছি! এ-বদল কি কেবল আমার একার? আমার চারপাশে যারা আছে তারাও কি বদলে যায়নি? তাদের সন্দেহের চোখ আমার দিকে কি নেই?
    ভাইরাস বিশ্বজুড়ে এখন একটাই শব্দ--ভাইরাস কোভিড-১৯ নামধারী অতি ক্ষুদ্র কিন্তু ভয়ানক এই দানব তাণ্ডব চালাচ্ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে। স্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী। রুদ্ধ হয়ে গেছে জীবনের ধারা সভ্যতা আজ মুখোমুখি গভীর সংকটের মানুষ ভালো নেই একদম যুদ্ধ চললে মানুষ কি ভালো থাকতে পারে? যুদ্ধই বটে বিশ্বযুদ্ধ এ-এক অদ্ভুত ভয়ংকর যুদ্ধ যেখানে আমরা সবাই সৈনিক সবাই লড়াই করছি শত্রু অদৃশ্য কিন্তু সে এতটাই ভয়ানক যে বিজ্ঞানকে আজ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কঠিন পরীক্ষায় বিশ্বের অস্ত্র ভাণ্ডারের ভয়ংকর ভয়ংকর অস্ত্রগুলো জেগে আছে অর্থহীন উপহাসে নিরস্ত্র হাতে নির্বাসনই এখন বাঁচার একমাত্র পথ সে কারণে মানুষ আজ গৃহবন্দী থমকে গেছে তার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ, চেনা সব ছবি যে বিদ্যালয় এখন কচি-কাঁচাদের কলরোলে মুখরিত হয়ে থাকার কথা, সেখানে এখন শ্মশানের নীরবতা যে ঘরগুলো গমগম করত ছাত্র-শিক্ষকের পঠন-পাঠনে, সেগুলো তালাবন্ধ অনেকদিন সেখানে ছাত্র-শিক্ষক নেই, পাঠদান নেই, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ নেই, শিক্ষকের শাষণ নেই—আছে কেবল একরাশ অন্ধকার আর নিষ্ঠুর নিস্তব্ধতা যে ঘরে ঢুকলে মনের মধ্যে জেগে উঠত অদ্ভুত এক প্রশান্তি, সেখানে ঢুকতে আজ মনের মধ্যে জেগে উঠছে অস্বস্তি আর ভয় সবুজের সমারোহে ঘেরা যে বিদ্যালয়ের আশ্রমিক পরিবেশ নিয়ে অনেক গর্ব করেছি, অনেক প্রশংসা শুনেছি; আজ সেই পরিবেশের সবকিছুই আছে শুধু আশ্রম শব্দটা কেমন বেমানান হয়ে গেছে বিদ্যালয় হল মন্দির নামের শেষেও বাণী মন্দির কিন্তু এ-মন্দির আজ শূন্য এখানকার ঈশ্বরেরা এখন গৃহবন্দী, পূজারীরাও তাই শ্মশান-শূন্যতা নিয়ে মন্দিরের কঙ্কাল নীরবে ফেলে চলেছে চাপা দীর্ঘ্যশ্বাস
    আজ কিছুক্ষণের জন্য হলেও নীরবতার মুক্তি ঘটে তার তবে ছাত্রছাত্রীরা নয়, এসেছে তাদের বাবা-মায়েরা অনেকেই এসেছেন তবুও সেভাবে নীরবতা কাটল কী? সারি দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে এমন দূরত্বে যে হাত বাড়ালেও সামনের জনকে স্পর্শ করা যায় না সকলের মুখ ঢাকা, মাস্ক কিংবা কাপড়ে পরিচিত অনেককে সহসা চেনাই যায় না সবাই ধীর পায়ে আসছে, কাজ মিটিয়ে চলে যাচ্ছে কোনো তাড়াহুড়ো নেই অপেক্ষার জন্য কারও বিরক্তি নেই, অভিযোগ নেই ব্যতিক্রমী দু-একজন বাদে বাক্য বিনিময়ের মুহূর্ত নেই সে তাগিদও নেই উভয়পক্ষের বাচ্চাদের মিড ডে মিলের বরাদ্দ নিয়ে চলে যেতে পারলেই যেন তারা বাঁচে আমরাও যেন কোনারকমে দিয়ে দিতে পারলে স্বস্তি পাই সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মানছি আমরা, নিঃসন্দেহে কিন্তু সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে আমি কি ভয় পাচ্ছি না? ওর শরীরে ভাইরাস নেই তো? কোনো কারণে দূরত্বের ব্যবধান কমে গেলে কি আঁতকে উঠছি না মনে মনে? এই ভয়টা কি বিপরীত পক্ষের মনেও কাজ করছে না আমার সম্বন্ধে? অজান্তেই কি আমরা একে-অপরকে সন্দেহ করছি? মনের মধ্যে সন্দেহের ভাইরাস এই ভাইরাস খুব বিপজ্জনক করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হয়তো একদিন আবিস্কার হবে কিন্তু চোখের সামনে এমন ভয়ানক বিশ্ব মহামারী কিংবা অতিমারী দেখার পর আমরা কি আমাদের মনের মধ্যেকার ভাইরাসটাকে তাড়াতে পারব খুব তাড়াতাড়ি? বিভিন্ন গবেষণা বলছে আগামী কয়েক বছর আমাদের এরকমই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এভাবে সেশ্যাল ডিসটেন্সিং মান্য করতে হবে কত বছর? সঠিক হিসাব কেউ জানে না যত বছরই হোক না কেন, এভাবে ডিসটেন্সিং মেনটেন করতে করতে সত্যি সত্যি আমাদের মধ্যে সোশ্যাল ডিসটেন্স তৈরি হয়ে যাবে নাতো? আজকের এই যে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং-এর কথা বলা হচ্ছে, অনেকের মতে এটা আসলে ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে তবে একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে ফিজিক্যাল  নয়  আমরা আসলে সোশ্যাল ডিসটেন্সিংই মান্য করছি আর আগামী সময়ে সেটা হয়তো আরও প্রকট হবে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনটেন করে আমরা হয়তো ভালো থাকব কিন্তু একে অপরের থেকে দূরে সবে যাবো না তো? মাঝে মাঝে এই প্রশ্নগুলো মনের মাঝে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়হয়তো এসব প্রশ্নগুলো অবান্তর হয়তো এ-আমার দুর্বল, ভীতু মনের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু আমরা সবাই চাই, যে নতুন পৃথিবী আসছে আগামীর জন্য সে পৃথিবী হোক সমস্ত ভাইরাস মুক্ত
    কাজ চলছে প্রায় নীরবে সময় বয়ে যাচ্ছে সহসা দেখি দু-একটি ছাত্রছাত্রী লাইনের কাছাকাছি গেটের কাছাকাছিও দু-একজনকে ঢুকতে দেখলাম এমনিতে লকডাউনে ঘরের বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই। তার ওপর সরকারি নির্দেশ আছে ওদের কোনোমতেই স্কুলে আসা যাবে না। বকাঝকা করে বাড়ি চলে যেতে বলে সবাইকে গেটের বাইরে পাঠিয়ে দিই তারা যায় তো একটু পরে আবারও দু-একজন ঢুকে পড়ে আবারও তাদের বিদায় করি কোনো কোনো অভিভাবক নিজেই তার ছেলে কিংবা মেয়েটিকে সঙ্গে করে এনেছেন তাদের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করি সবমিলিয়ে আমরা জনা চারেক স্কুলের গেট পাহারা দেওয়ার মতো লোক কোথায়? তাছাড়া শুধু গেট আগলে কি সবাইকে আটকানো যায়? ফাঁক ফোকরের তো অভাব নেই যাই হোক, এইভাবে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ঢুকে পড়া এবং তাদের বিদায় করার পর্ব বেশ কয়েকবার চলে বাড়ি চলে যেতে বললেও কাউকে কাউকে দেখা যায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে
    অনেকটা সময় পার হয়ে যায় হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠি একসঙ্গে প্রায় পাঁচ সাতজন ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়েছে স্কুলের ভেতর আরও আশ্চর্যের ব্যাপার তিনটে মেয়ের পরনে স্কুলের ইউনিফরম দুটো ছেলে শুধু স্কুল ইউনিফরমই পরে আসেনি পিঠে ব্যাগও রয়েছে। মিড ডে মিলের বরাদ্দের পাশাপাশি সমস্ত শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব বিষয়ের এক সেট করে প্রশ্ন দিচ্ছিলাম বাবা-মায়েদের হাতে। সেই প্রশ্ন নেওয়া বাহানায় তারা একেবারে সাজসজ্জা সহ হাজির। আগে স্কুলে কোনো ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত হলে, ইউনিফরম না পরলে বকাঝকা করতাম আর আজ বকাঝকা করছি তার ঠিক বিপরিত কারণে সময়ের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি একেবারে গেটের বাইরে বার করে দিই রাস্তায় না দাঁড়িয়ে বাড়ি চলে যেতে বলি কিন্তু তাদের যেন যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই ফিরে আসতে গিয়ে একটা ভাবনা ভেবে চমকে উঠি
    বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য আর ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমরা ওরা না থাকলে বিদ্যালয়ের কোনো মূল্য নেই আমাদেরও কোনো ভূমিকা নেই বিদ্যালয়ে ওদের অধিকার সবার আগে অথচ এখন ওদের এখানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই স্কুল চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের গেট বন্ধ থাকে যাতে ছেলেমেয়েরা কোনোভাবে বিদ্যালয়ের বাইরে যেতে না পারে আর আজ, আমি নিজেই তাদের জোর করে বের করে দিচ্ছি সেই গেট দিয়ে নিয়ম নির্দেশিকার কথা ওরা জানে কিনা জানি না ওরা শুধু জানে এই বিদ্যালয় ওদের বিদ্যালয়ের গেট খোলা থাকলে এখানে ঢোকার অধিকার ওদের আছে দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস স্কুলে আসতে পারেনি ওরা তাই আজ স্কুল খোলা থাকার খবরে ছুটে এসেছে ইউনিফরম না পরলে স্কুলে ঢোকা যায় না তাই হয়তো কেউ কেউ একেবারে সাজসজ্জা করেই এসেছে গেটের বাইরে গেলে যাদের কপালে বকুনি জুটত, আজ গেটে ঢোকার কারণে সেই শাস্তি হচ্ছে হয়তো একটু অবাক ওরা, বিভ্রান্তও নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় তারা হয়তো সেই কথাই বলছে ফিরে আসতে গিয়ে তাই থমকে দাঁড়ালাম
    গত ১৪ মার্চ রাজ্য সরকার স্কুল বন্ধের ঘোষণা করেন। ওই দিন ঘোষণার কিছু আগে করোনা সচেতনতার বার্তা দিতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সেমিনার করেছিলাম সেদিন সিরিয়াস হয়ে ওদের অনেক কথা বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু সেভাবে ভয় ছিল না মনে। একটা বিশ্বাস কাজ করছিল মনে, আমাদের দেশে তেমন কিছু হবে না কিন্তু এতদিনে সমস্ত ভাবনাচিন্তা একেবারে বদলে গেছে বিশ্ব বিপর্যয় দেখছি। দেখছি আমাদের দেশ কিংবা রাজ্যের চেহারা। আর এসব দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে চেপে বসেছে একটা আতঙ্ক শুধু নিজের নিরাপত্তা নয়, অন্যের নিরাপত্তার জন্যও আমাদের সরকারি স্বাস্থ্যবিধি কোনোভাবে অমান্য করা উচিৎ নয়। ওদের এইভাবে বাইরে আসা ঠিক হয়নি। দাঁড়িয়েছিল ওরা। ওদেরকে পুনরায় বোঝাই সমস্ত নিয়মকানুন মানতে বলি। যত কষ্ট হোক বাড়িতে থাকার কথা বলি। চুপচাপ শুনে যায় ওরা।
    কথা ফিরে আসব এমন সময় একজন সহসা বলে, ‘স্যার স্কুল খুলবে না? আমরা স্কুলে আসব না?’ দেখলাম বাচ্চা একটি মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে তার মুখটা কেমন বিষণ্ণ তার চোখে-মুখে কোনো উচ্ছলতা নেই কেমন যেন বিমর্ষ, বিষণ্ণ জিজ্ঞাসা নয়, তার প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠেছে একটা ব্যাথাতুর আকুতি ওরা ছুটি পেতে ভালোবাসে তাই বলে এত দীর্ঘ নয়। বুঝতে পারি ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছে ওরা এতো ছুটি নয়, একপ্রকার নির্বাসন
    ওরা স্কুলে আসতেই অভ্যস্ত বিদ্যালয় ওদের কাছে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, ওদের মুক্তির আকাশ এখানে কেবল পাঠদান নেই, আছে হৈ-হুল্লোড়, বন্ধুদের সাথে মজা, দুষ্টুমি; টিফিনের মিড-ডে মিল, গেটের পাশের ফুচকা, আচার, মশলা মুড়ি; খেলার মাঠ—ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি, স্কিপিং কিংবা দৌড়োদৌড়ি...আরও কতকিছু ছোটোখাটো তবুও বেশ মধুর পাশাপাশি একসাথে স্কুল আসা, বিশেষ করে স্কুল শেষে হৈ-হুল্লোড় করে একসাথে বাড়ি ফেরার মজাই আলাদা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে স্কুলের গেট ওদের জন্য বন্ধ অনেকদিন বন্ধুদের সাথে দেখা, গল্পগুজব সবকিছু বন্ধ ওরা চঞ্চল, ভালোবাসে ছুটতে বিদ্যালয় বঞ্চিত এমন বন্দী জীবন ওদের কাছে অসহনীয় একদম ভালো নেই ওরা এটা হয়তো সবার অজান্তে ওদের মনে বিরাট চাপ সৃষ্টি করে চলেছে যে চাপ থেকে মুক্ত হওয়া বেশ কঠিন
    করোনার বিপর্যয়ের কথা ওরাও কমবেশি জেনে গেছে মহামারী কিংবা অতিমারী ব্যাপারটা সম্পর্কে সঠিক ধারনা হয়তে ওদের নেই কিন্তু এটা ওরা বুঝতে পারছে করোনা নামক ভাইরাসটি খুব ভয়ংকর বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত চলছে মৃত্যু মিছিল এসব জানে ওরা সেই সঙ্গে সঙ্গে জীবনে প্রথমবার দেখছে এতদিন স্কুল বন্ধ থাকা এটা জানে না কবে স্কুল খুলবে হয়তো এমনও ভাবছে আদৌ স্কুল খুলবে তো? পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না তো? হারিয়ে যাবে না তো স্কুল জীবনের আনন্দের দিনগুলি---স্কুলের প্রেয়ার হল, স্যার ম্যাডামের ক্লাস, দুপুরের মিড ডে মিল, খেলার মাঠ? ফিরে পাবে তো প্রিয় বন্ধুবান্ধব, রোজকার মজা আর আনন্দের মুহুর্তগুলো?
    ওরা স্কুলে ফিরতে চায় ওরা ফিরে পেতে চায় ওদের স্বাভাবিক স্কুল জীবন কিন্তু সময় বড়ো খারাপ এখন পৃথিবীর এই গভীর অসুখ কবে সারবে জানা নেই অদৃশ্য শত্রু কোথায় লুকিয়ে আছে কেউ জানে না যতদিন না পরিস্থিতি অনুকূল হয় ততদিন স্কুলের গেট ওদের জন্য বন্ধ থাকবে তাই আপাতত ওদের ঘরেই থাকতে হবে আগে জীবন, তারপর অন্য সবকিছু একটা ক্ষত বিক্ষত মন নিয়েও বেঁচে থাকা যায় কিন্তু জীবনটা যদি না থাকে! তাই স্কুলে দরজা এখনই খোলা হবে না তাদের জন্য
    আকাশে মেঘ আবারও জড়ো হচ্ছিল একটু একটু করে। দেখতে দেখতে ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় গোটা আকাশ। কাজকর্ম শেষ করে সবে উঠেছি এমন সময় জোর বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিচ্ছিল স্কুলের খোলা বারান্দা। হয়তো ফেরার আগে সে মুছে দিয়ে গেল ধুলোর বুকে এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা বিষণ্ণ অধ্যায়। মেঘলা বিকেলে যখন গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম পুনরায় তখন আশেপাশে কেউ নেই। সেই আগের মতো শূন্যতা। বৃষ্টিভেজা বিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে আগের মতো। একদম একা।
    এতো কেবল একটি স্কুলে কথা নয়। সমস্ত স্কুলেরই আজ এই ছবি। বড়ো বিষণ্ণ এই ছবি। কিন্তু সময় বদলাবে নিশ্চয়ই বদলাবে কোনো অন্ধকারই চিরস্থায়ী নয় অনন্তকাল ধরে কোনো ঝড় চলতে পারে না একদিন ঝড় থেমে যাবে শান্ত হবে প্রকৃতি পৃথিবীর বুকে অন্ধকার কেটে আসবে নতুন আলো যে আলোয় বিষণ্ণ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এখনকার স্কুলগুলো আবারও জেগে উঠবে প্রাণের মূর্ছনায় সেদিনের প্রত্যাশায় বিদ্যালয়গুলিও আকুল প্রতীক্ষায়

২১ এপ্রিল, ২০২০।