যুদ্ধের কোনো
শেষ নেই

করোনা ভাইরাস গ্রুপের নতুন অতিথি কোভিড-১৯।
এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটি নীরবে এক শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আরেক শরীরে। বিশ্ব আজ লড়াই
করছে এই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই যুদ্ধটা আসলে কার বিরুদ্ধে? ভাইরাসের
সঙ্গে নাকি অন্য কারও সঙ্গে? তাছাড়া আরও একটি প্রশ্ন, এটাই কি আসল যুদ্ধ? নাকি আরও
কোনো যুদ্ধ আমাদের জন্য জন্য অপেক্ষা করে আছে আগামীর জন্য?
করোনা কোনো নতুন ভাইরাস নয়। কোভিড-১৯
করোনার একটি নতুন প্রজাতি বলা যায়। চীনের উহানে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ।
সেখানে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে এই ভাইরাস ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। চীনের বক্তব্য
অনুযায়ী উহানের সী-ফুড মার্কেট থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কেউ কেউ চীনের এই
দাবি মানতে চাইছেন না। কারও বক্তব্য এটি চীনের উহানের ভাইরাস ল্যাবোরেটোরিতে
তৈরি অর্থাৎ ম্যান-মেড। চীন গোটা বিশ্বে আধিপত্য কায়েম করতে এভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে নীরবে। কারও বক্তব্য ভাইরাসটি উহানের গবেষণাগারে
তৈরি এটা ঠিক, তবে চীন ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা ছড়ায়নি। দূর্ঘটনাবশত এটি ছড়িয়ে পড়ে।
চীনের বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ উঠছে যে তারা যদি ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারে সঠিক
সময়ে ঠিকঠাক তথ্য দিত তাহলে এই বিশ্ব মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যেত। অর্থাৎ নানাভাবে
চীনের দিকে একটি অভিযোগ উঠে আসছে। তাহলে কি যুদ্ধটা চীনের বিরুদ্ধে? একদিকে চীন,
উল্টোদিকে পুরো বিশ্ব? আপাতত সেরকমটা নয়। অভিযোগ যাই থাক, এই মুহূর্তে প্রতিটি
দেশ লড়াই করছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে। ভাইরাসটির সৃষ্টি রহস্য একটা সময় পরিস্কার হয়ে
যাবেই। তবে যুদ্ধটা কোনোভাবেই চীনের বিরুদ্ধে নয়।
করোনা গ্রুপের একাধিক ভাইরাসের সংক্রমণ
আমাদের ইতিমধ্যে ঘটেছে। বাদুড় থেকেই এই ভাইরাস প্রাণীদেহে সংক্রমিত হয়।
এইক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। চীন সেই কথা বলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সেই কথা
জানাচ্ছে। অর্থাৎ করোনা ভাইরাস মানুষের সৃষ্টি ভাইরাস নয়। প্রকৃতি থেকেই এসেছে।
তাহলে কি যুদ্ধটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে? প্রকৃতি কি মানুষের বিরুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা
করেছে?
Nature’s Revenge (প্রকৃতির প্রতিশোধ) বলে একটা কথা আছে। দিনের পর
দিন আমরা যেভাবে অত্যাচার করে চলেছি প্রকৃতির ওপর তাতে বিধ্বস্ত প্রকৃতি। দূষণ,
উষ্ণায়ন, হিমবাহের গলন, ওজোন স্তরের ফাটল প্রভৃতি ভয়াবহ বিষয়গুলি দিন দিন শঙ্কা
বাড়িয়ে তুলছিল। এ-সবের জন্য দায় আমাদেরই। আমরা নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার
করে যাবো আর প্রকৃতি সব চুপচাপ মেনে নেবে? প্রকৃতির কৃপায়
আমাদের অস্তিত্ব। তাকে বিপর্যস্ত করলে বদলা সে নেবেই। এখন হয়তো সেটাই ঘটছে। আর
একটি কথা, প্রকৃতি তার বিশৃঙ্ক্ষলা একদম পছন্দ করে না। তাই বিশৃঙ্ক্ষলা যখন চরম
আকার ধারন করে তখন নিজেকে পুনরায় সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য জেগে ওঠে সে। আর সেই
সময় পৃথিবীর বুকে নেমে আসে বিপর্যয়। যে বিপর্যয় এখন কোনঠাসা করে দিয়েছে গোটা
বিশ্বকে।
করোনা বিশ্ব মহামারী ডেকে এনেছে। লক্ষ লক্ষ
মানুষ আক্রান্ত। চলছে মৃত্যু মিছিল। বিশ্বের উন্নত শক্তিধর দেশগুলোও পর্যন্ত
অসহায় হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও করোনা প্রকোপ বাড়ছে ধীরে ধীরে। মৃত্যু মিছিল তো
আছেই। স্তব্ধ হয়ে গেছে জনজীবন। মানুষ গৃহবন্দী। বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত।
ইতিমধ্যেই অনাহার মাথাচাড়া দিচ্ছে। করোনার দাপট কবে শেষ হবে এখনও কেউ জানে না। যতদিন
না ভ্যাকসিন আবিস্কার হচ্ছে ততদিন এই নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সেই
ভ্যকসিন কবে আবিস্কার হবে, কবে মানুষ তার সুফল পাবে জানা নেই। আপাতত আমরা সংক্রমণ
কমার প্রতীক্ষায়। একদিন না একদিন কমবে ঠিকই তবে তা কত ক্ষতির মূল্যে জানা নেই। করোনা
পরবর্তী সময়ে আসছে আরও এক কঠিন লড়াই। বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয় চরম বিপদ ডেকে আনবে
মানুষের জীবনে। তবে আমরা আশাবাদী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই উন্নত সভ্যতা আর
রাষ্ট্রের সদিচ্ছা হয়তো বা চরম বিপর্যয় অনেকটা ঠেকাতে সম্ভব হবে।
সভ্যতার বিপর্যয়। কিন্তু কেমন আছে আমাদের
প্রকৃতি? এককথায় খুব ভালো আছে। একটু চোখ কান খোলা রাখলে আমরা বুঝতে পারি
অনেকটাই বদলে গেছে প্রকৃতি। বৈশাখের দগ্ধকারী তাপ যা বিগত কয়েক বছর আমাদের
বিপর্যস্ত করে আসছিল এবার তা যেন অনেকটাই কম। ডুমুরের ফুল হয়ে ওঠা কালবৈশাখী এবার
বেশ ভালোমতোই দেখা দিচ্ছে। রিপোর্ট বছলে প্রকৃতির দূষণ অনেকটাই কমে গেছে।
রাজধানী কলকাতার দূষণ ২০ শতাংশ কমেছে। ওজন স্তরের যে বিরাট ফাটল মানুষের মাথা
ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা নাকি অনেকটাই সেরে উঠেছে। গোলার্ধে হিমবাহ
আবারও জমতে শুরু করেথে। নদীর দূষণমাত্রা কমে গেছে। পবিত্রতা হারিয়ে যে গঙ্গা
দূষণের নদী হয়ে উঠেছিল সেখানেও এখন দেখা যাচ্ছে ডলফিনের লাফালাফি। পশুপাখিদের দেখা
যাচ্ছে মুক্ত মনে বিচরণ করতে। এমনকি রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে তাদের বিচরণ করতে।
আশ্চর্য আগে মানুষ চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশুপাখি দেখে মজা নিত। মানুষ আজ খাঁচাবন্দী।
পশুপাখিরা তাই বেরিয়ে পড়েছে সেই আজব চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করতে। গ্রামাঞ্চলে একটু
নজর করলে দেখা যায় সকাল সন্ধ্যা পাখির কিচিরমিচির, বিকেলে পাখির ঝাঁক, রাত্রে
ঝিঁঝির ডাক। ‘মোরা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি পাখির ডাকে জেগে’
সেই বিখ্যাত লাইন আবারও বাস্তবতা ফিরে পেয়েছে যেন। হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতি কিছুটা
হলেও যেন ফিরে পেয়েছে নিজের চেনা রূপ। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে প্রকৃতি। অনেক
অত্যাচার হয়েছে তার ওপর। দমবন্ধ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল তার। তাই মানুষকে গৃহবন্দী করে
দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সে বিশ্রাম নিচ্ছে আর চেষ্টা করছে নিজের ক্ষতগুলো যতটা পারা
যায় মেরামতি করার। ‘পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ’ কথাটা অনেকদিন ধরেই আমরা শুনে আসছি। সেই
অসুখ সারিয়ে সুস্থ হচ্ছে পৃথিবী। এ-বড়ো সুখের কথা। কিন্তু নিজেকে সারিয়ে তুলতে
গিয়ে মানুষকে এমন বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া---সেটা কি ঠিক? এতে কি আদৌ ভালো আছে
প্রকৃতি?
যেভাবে মানুষের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছিল তাতে
করে নিজেকে সারিয়ে তুলতে একটা বড়ো ধাক্কা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেননা এই ধাক্কাটা
না দিলে মানুষ কি এমন করে নিজেকে গুটিয়ে নিত? নিজেকে গৃহবন্দী করে প্রকৃতিকে থাকতে
দিত তার নিজের মতো করে? আর প্রকৃতি যদি ধাক্কা দেয় তার জন্য কিছু
ক্ষতি তো স্বীকার করতেই হবে মানুষকে। কিন্তু এমন মৃত্যু মিছিল প্রকৃতিও চায় না।
এতটা নির্দয় নয় প্রকৃতি। সৃষ্টি তার খুব প্রিয়। মানুষও সেই সৃষ্টির একজন। তার
প্রতি ভয়ংকর নির্দয় হতে পারে না প্রকৃতি। তাই জোর ধাক্কা দিলেও মানুষকে পুরোপুরি
বিপর্যস্ত কিংবা অসহায় করে দেয়নি। হাতে অস্ত্র দেয়নি ঠিকই কিন্তু নিজেকে রক্ষা
করার জন্য কিছু বর্ম মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে। নিজেকে রক্ষার ভার তুলে দিয়েছে যে
যার নিজের হাতে। করোনা অস্ত্রে প্রকৃতি আসলে মানুষকে কোনঠাসা করতে চেয়েছে।
মানুষের বিরুদ্ধে প্রকৃতির যুদ্ধ অর্থাৎ
সৃষ্টির বিরুদ্ধে স্রষ্টা। আর এই যুদ্ধে প্রকৃতির হাতিয়ার করোনা নামক একটি অতি
ক্ষুদ্র ভাইরাস। এই ভাইরাসের চরিত্র ইতিমধ্যেই আমরা অনেকটাই জেনেছি। একটু গভীরভাবে
বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারবো মারাত্মক হয়েও এটা পুরোপুরি আবার মারাত্মক নয়।
করোনা সংক্রমণ দ্রুত হয় কিন্তু এর মৃত্যু হার অনেক কম। করোনা সংক্রমণে প্রতিদিন
আমাদের দেশ কিংবা বিশ্বে যে মানুষ মারা গেছে তার থেকে কয়েকগুন বেশি মানুষ মারা যান
নানান রোগে। করোনা সংক্রমণ হলেই কেউ সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না। মানুষকে সময় দেয়
লড়াই করার। অর্থাৎ একেবারে অসহায় মৃত্যু নয়। সে সুযোগ দিচ্ছে, তুমি লড়াই করো।
পারলে জেতো। জিতছেও মানুষ। যদি করোনা আক্রান্ত হলেই নিশ্চিত মৃত্যু হত তাহলে আজ
বিশ্বের ছবিটা কতটা ভয়ংকর হত তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া করোনা এমনি এমনি কাউকে
আক্রমণ করে না। মানুষ কোনোভাবে তাকে নিজের শরীরে না আনলে সে আসে না। এখানেও
বাঁচার পথ রয়েছে। ঘরে থাকো, তুমি নিরাপদ। ঘরের বাইরে বেরোলে সামাজিক দূরত্ব মানো,
তুমি নিরাপদ। করোনা বায়ুবাহিত নয়। তা যদি হত তাহলে সেটা আরও মারাত্মক হত। করোনার
প্রতিষেধক নেই, এর চিকিৎসার নির্দিষ্ট ঔষধ নেই এটা ঠিক, কিন্তু কতগুলো
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আমরা করোনা সংক্রমণ এড়াতে পারি। নির্দিষ্ট সময় অন্তর
সাবান কিংবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোওয়া, মুখে মাস্ক পরা, বাইরে বেরোলে সামাজিক
দূরত্ব বজায় রাখা---এসব করলে করোনা সংক্রমণ রোখা সম্ভব। শুধু করোনা নয়, এই
সু-অভ্যাসগুলি যদি মানুষ জীবনের অঙ্গ করে নিতে পারে তাহলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি
পাবে। করোনা তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। যাদের সেই
ক্ষমতা বেশি করোনা তাদের আক্রমণ করলেও কাবু করতে পারে না। তাই শরীরের রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ালে মানুষের বিপদ কম। করোনা হয়তো একদিন বিদায় নেবে, তার
মানে এমন তো নয় পৃথিবী ভাইরাসমুক্ত হয়ে যাবে। অসংখ্য ভাইরাস রয়েছে। পাশাপাশি হানা
দেবে নতুন কোনো মারাত্মক ভাইরাস। কিন্তু আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
যদি ভালো হয় তাহলে সেইসব ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে পারব। এসব দেখে এটা
পরিস্কার প্রকৃতি বোধহয় আমাদের একেবারেই নিরস্ত্র করে দেয়নি। নিজেদের সুরক্ষার
জন্য কিছু ঢাল আমাদের দিয়েছে। সেটা হল নিজের চারদিকে একটি সুরক্ষার বলয় তৈরি করা।
আর একটা ব্যাপার না বললেই নয়। করোনা আক্রান্ত হলে, মারাত্মক কেসগুলি ছাড়া, সেরে
ওঠার জন্য বিশাল অর্থ খরচ হয় না। এমনকি নিজের বাড়িতে থেকেও এর চিকিৎসা সম্ভব।
করোনার চিকিৎসা যদি বিশাল খরচাবহুল হত, তাহলে কী হত সহজেই অনুমেয়। বিনা চিকিৎসায়
মারা যেত বহু মানুষ। এসব বিচার করে একটা জিনিস পরিস্কার, করোনার সংক্রমণ খুবই
ভয়ংকর ঠিকই কিন্তু কিছু কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা নিলে আমরা যেমন তার সংক্রমণ এড়াতে
পারি, তেমনি আক্রান্ত হলে একেবারে বিপর্যস্ত না হয়ে সেরে ওঠার সুযোগ রয়েছে। আমরা
যদি এই নিয়মকানুনগুলো ঠিকঠাক মেনে চলি, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াই,
তাহলে সুস্থ জীবন পাবো। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সেমিনারে ডাক্তারবাবুদের বলতে শুনেছি
মানুষ যদি কেবল হাত ধোওয়ার অভ্যাস ঠিকঠাক পালন করে তাহলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি
পাবে। আর করোনার এই আক্রমণ তো আমাদেরকে বাধ্য করেছে সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে।
করোনা একটা জিনিস দেখিয়ে দিয়েছে সে কোনো
ভেদাভেদ, উচ্চনীচ মানে না। সাধারণ বস্তিবাসী যেমন করোনা আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি
বাদ যায়নি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের মানুষ কিংবা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর মতো
মানুষ। আর সবার ক্ষেত্রেই একটাই বিধি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশ মেনে চলা।
করোনা বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনের স্বাভাবিক
ছন্দ। আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে হৈচৈ হুল্লোড় ছাড়াও আমরা বেঁচে থাকতে পারি। প্রকৃতির
ওপর অযথা অত্যাচার বন্ধ করতে পারি। চাইলেই আমরা দূষণ কমাতে পারি। এমন কিছু কাজকর্ম
আমরা রোজকার জীবনে করি যা প্রকৃতির পক্ষে ক্ষতিকর সেগুলো থেকে আমরা বিরত থাকতে
পারি। এমনকি কিছু কাজকর্ম বা অভ্যাস যা স্বাভাবিক সময়ে অসম্ভব মনে হত, এই সংকটের
সময়ে আমরা অনায়াশেই সেটা সম্ভব করছি। করোনা আমাদের দেখাচ্ছে রাজনৈতিক নোংরামি,
ধর্মীয় গোঁড়ামি, পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ ভুলেও বেঁচে থাকা যায়। করোনা কি
পরোক্ষভাবে আমাদের শেখাচ্ছে না একে-অপরের জন্য ভাবনার কথা?
আত্মকেন্দ্রিকতার ভাবনা ছেড়ে মানসিকভাবে একটা একতা গড়ে উঠেছে মানুষের মধ্যে। হয়তো
ক্ষণিক, তবুও তা কম কিসে? ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের
জন্য’-- সমাজের আশেপাশে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে
মানবতার সেই সুর। বিপর্যয়ের অন্ধকার ভেদ করে উঠে আসছে মহাজীবনের টুকরো টুকরো
আলো।
তাই বলে যা হচ্ছে তা কি ভালো হচ্ছে? মোটেও
নয়। একটা যুদ্ধ চলছে। আর যে কোনো যুদ্ধ মানেই মৃত্যু আর ধ্বংস অবধারিত। পাশাপাশি
যুদ্ধ আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিরাট ধাক্কা দেয়। সেই
ধাক্কা শুরু হয়েছে। এই বিপর্যয় কবে কাটবে জানা নেই। তবে এটা নিশ্চিত তার জন্য সময়
লাগবে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ‘Time is the best medicine for every pain of
the life.’ লিও টলস্টয় বলেছেন, “The strongest of all warriors are these two
— Time and Patience.” ঠিক তাই। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। তার জন্য আমাদের
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এটা ঠিক, বিশ্ব মহামারীর অবসানে আমাদের
সামনে আসবে এক নতুন পৃথিবী। সেই নতুন পৃথিবীতে গতানুগতিক ভাবনাচিন্তা আঁকড়ে বাঁচা যাবে
না। সাধারণ জীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনায় বদল আনতে হবে। করোনার এই
বিপর্যয় প্রকারান্তরে এক জীবন দর্শন। সেই দর্শন উপলব্ধি করতে হবে আমাদের। ব্যক্তি
জীবনে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক
ব্যবহারের হয়তো সবসময় প্রয়োজন হবে না। কিন্তু নিয়মিত হাত ধোওয়া, নিজেকে
পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, বাইরে থেকে ফিরলে ঘরে ঢোকার আগে নিজের এবং পোশাক-আশাকের
পরিস্কার করা প্রভৃতি ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো জীবনের অভ্যাসে পরিনত করতে হবে।
পাশাপাশি রাস্তাঘাটে থুতু, পানের পিক ফেলা, রাস্তাঘাট নোংরা করা এসব থেকে বিরত
থাকতে হবে। নিজের বাড়ির পরিবেশের পাশাপাশি এলাকার পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও
সচেতন হতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক
কসরৎ প্রভৃতির দিকে নজর দিতে হবে। সমাজকেও ভাবতে হবে তার সুস্থতার কথা। এলাকা
সুরক্ষিত, জীবানুমুক্ত এবং স্বাস্থ্যকর রাখার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। রাষ্ট্রকে ভাবতে
হবে স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির কথা। এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। চিকিৎসা
পরিষেবা ও পরিকাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে। ক্ষমতায়নের লোভ, যুদ্ধ মানসিকতা থেকে
সরে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। যুদ্ধের শেষ পরিণাম ধ্বংস। বুদ্ধিতে
পৃথিবীর সেরা জীব হয়েও যদি মানুষ নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করে তোলে
তাহলে তার থেকে বোকামি আর কী হতে পারে? এই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ের শেষ
কবে হবে কেউ জানে না। করোনা পরবর্তী সময়ে আরও এক লড়াই। বিশ্ব মহামারী আগামী সময়ে
যে ভয়ংকর সংকট নিয়ে আসছে তার বিরুদ্ধে লড়াই। যাকে বলে বেঁচে থাকার লড়াই। এই
মহামারী বিশ্ব-অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে তাতে করে বিশ্বের এক বিরাট
অংশের মানুষের জীবনে নেমে আসবে ঘোর সংকট। সেই সংকট মোকাবিলায় চলবে এক
দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ। সেই যুদ্ধেরও কবে শেষ হবে তা আগাম অনুমান করা সম্ভব নয়। আর
এসবের পাশাপাশি আরাও একটা লড়াই লড়তে হবে মানুষকে। সেটাই আসল লড়াই। প্রকৃতির ওপর
আমরা যে আচরণ করছি সেটা থেকে বেরিয়ে আসার লড়াই।
প্রকৃতির কথা ভাবতে হবে মানুষকে। যে প্রকৃতির
কারণে আমাদের অস্তিত্ব তাকে বিপর্যস্ত করে আমরা বাঁচতে পারবো না, এই চরম সত্যিটা
বুঝতে হবে। পাশাপাশি প্রকৃতির ওপর যে নিষ্ঠুর অত্যাচার তা বন্ধ করতে হবে। মনে
রাখতে হবে এই পৃথিবী একা আমাদের নয়। প্রকৃতি তার সকল সন্তানের জন্য তার আঁচল
বিছিয়ে রেখেছে। আমরা যদি সবার অধিকার কেড়ে নিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতায় কেবল
নিজেদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করব ভাবি, তাহলে প্রকৃতি এভাবেই মাঝে মাঝে তার বেছানো
আঁচলে টান মারবেই। তখন এলোমেলো হবে সবকিছু। তাই এই মানসিকতা বদলাতে হবেই।
সহাবস্থান ও সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আগামী পৃথিবীতে পরশুরামের কুঠার
ছেড়ে মানুষকে হতে হবে প্রকৃতির পূজারী। তা না হলে এমন বিপর্যয় ঘন ঘন আসবে।
এসব কথাগুলো বলা বা প্রত্যাশা করা অনেক সহজ
কিন্তু বাস্তব রূপায়ন বেশ কঠিন। এক ধাক্কায় মানুষের ভাবনাচিন্তার আমুল পরিবর্তন
এসে যাবে, এমন প্রত্যাশা করাটা বোকামি। কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথ নেই। যুদ্ধের
এই সবে শুরু। এই যুদ্ধটা প্রকৃতির সঙ্গে। বর্তমানের যুদ্ধ আমরা একদিন না একদিন
জিতবই। প্রকৃতিই আমাদের জিতিয়ে দেবে। কেননা প্রকৃতিও চায় না আমাদের পরাজয়। অর্থৈনাতিক
বিপর্যয়ও হয়তো আমরা একদিন কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। কিন্তু তারপর। আমরা কি বেরিয়ে
আসতে পারব আমাদের পুরোনো ধ্যান ধারনা থেকে? ব্যাপারটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এ-লড়াই
আসলে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। এ-লড়াই খুব কঠিন। ক্ষমতার দম্ভ আর আধিপত্য বিস্তারের
লোভ, যুদ্ধ মানসিকতা, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি থেকে কি বেরিয়ে আসতে পারবে মানুষ? অন্যদিকে
আমাদের ব্যক্তিজীবনে আমরা যেভাবে অসচেতনতার পরিচয় দিয়ে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করে
আসছি, সেটা থেকেও কি বেরিয়ে আসতে পারব? অনেক প্রশ্নচিহ্ন। উত্তরটা আশাব্যাঞ্জক নয়
মোটেই। তাই লড়াই চলবেই। কখনো মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, কখনও মানুষের সঙ্গে
মানুষের। আর ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আমরা আকাশ-কুসুম প্রত্যাশা নিয়ে মনে মনে ভাবব,
‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, প্রকৃতি আবার শান্ত হবে।’ আর ঝড় থেমে গেলে, প্রকৃতি শান্ত
হলে আমরা ফিরে যাব স্বমহিমায়। তারপর আবার ঝড় আসবে, অন্যরূপে, অন্য পথে।
এভাবেই পৃথিবীর বুকে বাজতে থাকবে যুদ্ধের দামামা। আদপে আমরা যদি না নিজেদের বদলাতে
পারি, তাহলে এই যুদ্ধের শেষ হবে না কোনোদিন।
২৯ এপ্রিল, ২০২০।
No comments:
Post a Comment