Saturday, May 9, 2020

নারীকথা-২

সামান্য ঝাড়ুদার থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি
পরিবেশ বন্ধু কিঙ্করী দেবী
সৌরভকুমার ভূঞ্যা
 
পেশায় তিনি ছিলেন ঝাড়ুদার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে জঞ্জাল সাফ করে শিক্ষার আলোক-বঞ্চিত নিরক্ষর এই গ্রাম্য মহিলা তার সীমাবদ্ধতার গণ্ডী ছাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক অসম লড়াইয়ে যাতে করে সমাজ থেকে অপরাধ নামক জঞ্জাল কিছুটা অত্যন্ত দূর করা যায় পদে পদে বাধা এসেছে প্রাণ সংশয় হয়েছে হার মানেননি তিনি, পালিয়ে আসেনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে অবশেষে সাফল্যের জয়মাল্য গলায় পরে প্রমাণ করে দিয়েছেন লক্ষ্য যদি মহৎ হয় আর সঙ্গে যদি থাকে জেদ, হার-না-মানা মানসিকতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা তাহলে সাফল্য একদিন না একদিন ধরা দিতে বাধ্য এই দুঃসাহসিক প্রয়াস তাঁকে ইতিহাসে সম্মানের স্থান দিয়েছে বর্তমানে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনায় হয়তো সেভাবে উঠে আসে না তাঁর নাম, তাই বলে তাঁর কৃতিত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না পরিবেশ বন্ধু এই মহৎ-প্রাণা মহিলা হলেন কিঙ্করী দেবী
    ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে হিমাচল প্রদেশের ঘাতোন গ্রামে এক গরিব দলিত পরিবারে তার জন্ম তাঁর বাবা কালিয়া রাম ছিলেন সামান্য কৃষক আর্থিক অনটন ও এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবের কারণে কিঙ্করী দেবী পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি জীবনের প্রায় শেষদিকে এসে তিনি কেবল নিজের নামটুকু সই করতে শিখেছিলেন অভাবে কারণে শৈশবে তিনি অপরের বাড়িতে কাজ করতেন মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় শানু রামের সঙ্গে শানু পেশায় ছিল শ্রমিক কিঙ্করী দেবীর বয়স যখন বাইশ বছর তখন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে শানু রাম মারা যায় শুরু হয় কিঙ্করীর জীবন যুদ্ধের আর এক নতুন অধ্যায় স্বামীহারা, অসহায় বিধবা সংসার প্রতিপালনের জন্য ঝাড়ুদারের কাজ করতে শুরু করেন এক্ষেত্রে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই হতে পারত তাঁর জীবন কিন্তু তা হয়নি, কেননা তাঁর ভাবনা ছিল সাধারণের থেকে একটু আলাদা
    কিঙ্করী দেখেন খনি মালিকদের অনিয়ন্ত্রিত খনন ও মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ি এলাকা তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জল সরবরাহ ব্যবস্থা, ধ্বংস হচ্ছে চাষযোগ্য জমি এসব দেখে তিনি স্থির থাকতে পারেন না শপথ নেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রথমে তিনি স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ শুরু করেন কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না তখন তিনি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন People’s Action for People in Need নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় সিমলা হাইকোর্টে তিনি ৪৮ জন খনি শ্রমিকের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন সময় এগোতে থাকে কিন্তু মামলার কোনো অগ্রগতি হয় না এর প্রতিবাদে হাইকোর্টের সামনে ১৯ দিন অনশনে বসেন তিনি ব্যাপারটা রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সাড়া ফেলে দেয় ফলস্বরূপ তাঁর দায়ের করা মামলার বিচার শুরু হয় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে সিমলা হাইকোর্ট রাজ্যে খনন কার্যের ওপর স্থিতাবস্থা (Stay Order) জারি করেন এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় বিস্ফোরণের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাজারি করেন খনি মালিকরা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে যান এই সময় কিঙ্করী দেবীকে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে সময় কাটাতে হয়েছে অবশেষে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্ট তার পক্ষে রায় দেন
    এক অতি সাধারণ, তথাকথিত অশিক্ষিত মহিলার এই লড়াই মুগ্ধ করেছিল আমেরিকার তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনকে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বেজিং-এ বসেছিল আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলন (International Women Conference) হিলারি ক্লিনটনের উদ্যোগে কিঙ্করী দেবী শুধু এখানে আমন্ত্রিতই হননি, প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে ওই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদবোধন করার গৌরব লাভ করেন বন ও পরিবেশ রক্ষায় তার বিশেষ অবদানের জন্য ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাকে ঝাঁসি রানি ন্যাশন্যাল সম্মানে সম্মানিত করেন
    পরিবেশের লড়াইয়ের পাশাপাশি নিজের জেলায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন আসলে তিনি চাননি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে অন্যান্যদের অবস্থা তার মতো হোক তার নিজের কথায়, “পড়াশোনা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু আমি চাইনি পড়াশোনার অভাবে আমাকে যে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তা অন্যদেরকে ভোগ করতে হোক।” দীর্ঘ তিন বছর তিনি লড়াই চালিয়ে যান অবশেষে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য সরকার তাঁর এলাকায় একটি ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করেন ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর দীর্ঘ্য রোগভোগের পর তিনি মারা যান
    মানুষ যতই বিজ্ঞানকে করায়ত্ব করুক না কেন, একথা বাস্তব পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হবে যা বর্তমানে এক ভয়ংকর বার্তা নিয়ে হাজির তাই শুধু সরাকরি নয়, সচেতনতা দরকার সাধারণ মানুষের মধ্যেও, যেমনটা আমরা দেখতে পাই কিঙ্করী দেবীর মধ্যে নিরক্ষর, অল্প বয়সে বিধবা, অত্যন্ত গরিব একজন মহিলা সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে নিয়ে পরিবেশ রক্ষায় একপ্রকার নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ঠ নয় তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন একেবারে সাধারণ সমাজের চোখে তথাকথিত অস্পৃশ্য মহিলারাও অনেক বৃহৎ কাজ করতে পারেন কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবেশ বন্ধু হিসাবে অন্যান্যদের নাম যতটা শোনা যায় সেভাবে শোনা যায় না কিঙ্করী দেবীর নাম অনেকে তো তাঁর নামটাই জানেন না এটা আমাদের লজ্জা। আজকের সময়ে এইরকম মহৎ-প্রাণা মানুষদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করার দরকার আছে


তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া

No comments:

Post a Comment