ঝিনুক
সৌরভকুমার ভূঞ্যা

বেশ বয়স
হয়েছে জনার্দনের। এখন আর কিছু কাজ করতে পারে না। ছেলে-বউমার
সংসারে অনেকটা পরগাছার মতো জীবন। ছেলের বউ তাকে একদম সহ্য করতে পারে না। এমনিতে কোনোদিনই ভালো চোখে দেখত না। আর কর্মহীন, অথর্ব হয়ে যাওয়ার পর তাকে চোখের বিষ মনে
করে। উঠতে বসতে গালাগাল, কটু কথা শোনায়। অসহায়
জনার্দনের চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এভাবেই চলছিল।
কিন্তু আজ দুপুরবেলা তাকে এমন কথা শোনায় যে তা সহ্যের বাইরে চলে যায়।
বাধ্য হয়ে মুখ খোলে। শান্ত গলাতেই কয়েকটা কথা বলেছিল।
কিন্তু তাতে ফল হয় মারাত্মক। গায়ে হাত তুলতেই শুধু বাকি রেখেছিল।
নাহলে আর যে যে ভাবে আঘাত করা যায় করতে বাকি রাখেনি। খুব কষ্ট পায়
জনার্দন। বিকেলে ছেলে মাঠ থেকে কাজ সেরে ফেরার পর এক ফাঁকে তাকে
কিছু কথা জানায়। ছেলে তখন কিছু বলেনি। চুপচাপ শুনে
বাজারে চলে গিয়েছিল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর স্ত্রীর কাছে বাবার প্রসঙ্গটা
তোলে। তাতে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। তার নামে
স্বামীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছে, এটা সে কোনোমতেই মেনে নিতে পারে না।
মাথায় যেন তার আগুন জ্বলে ওঠে। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে দাওয়ায়।
ঘরের
ভেতরের দরজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে জনার্দনের। দাওয়ার একটা
জীর্ণ খাটে শোয়। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ক্ষিপ্ত ছেলের বউ
ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে ওঠে, ‘এই বুড়ো ওঠ্। ছেলের কাছে আমার নামে নালিশ জানিয়ে এখন নাক ডাকিয়ে
ঘুমোনো হচ্ছে! তোর শোয়া
ঘোচাচ্ছি! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’ বলেই জোরে জোরে ধাক্কা মারে তাকে।
আচমকা ধাক্কায় ঘুম ছুটে যায় জনার্দনের।
ধড়ফড় করে
উঠে বসে জনার্দন। চোখে-মুখে এক অদ্ভুত ঘোর ঘোর ভাব। ঘোরটা একটু
কাটতে খেয়াল হয়, এটাতো ছেলের ঘর নয়! সে ঘরের দরজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে তার
জীবনে। এখন খোলা আকাশের নীচে এই বুড়ো বটতলাই তার আশ্রয়।
তাহলে ধাক্কাটা মারল কে? সহসা চোখ যায় পাশে। এখন মধ্যরাত।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবুও বুঝতে অসুবিধা হয় না কেউ একজন বসে আছে।
ভয়ে বুকটা ধড়াস করে ওঠে জনার্দনের। ভুত-প্রেতের ভয় তার নেই। চোর-টোর নয়
তো! পরক্ষণেই ভাবে, একটা ভিখিরির কাছে চোরের পাওয়ার মতো কিছু
নেই। তাহলে কি অন্য কোনো বদ মতলব আছে লোকটার?
ঘুম ছুটে
যায় জনার্দনের। ভীরু চোখে তাকায় লোকটির দিকে। আন্ধকারে
ঠিকঠাক বোঝা না গেলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না লোকটার বয়স বেশি নয়।
যুবকই মনে হয়। এত রাতে একটি যুবক এখানে কেন? একটু কাঁপা কাঁপা সুরে বলে, ‘কে?’
যুবকটি তার
কথার জবাব না দিয়ে উল্টে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে?’
‘আমি জনার্দন।’
‘এত রাতে গাছতলায় কেন?’
যুবকটির
গলা কিছুটা যেন গম্ভীর। তার কথাবার্তার ধরন দেখে একটু ঘাবড়ে যায় জনার্দন।
তার মনে হয় পুলিশের লোক। সামনে রাস্তা দিয়ে রাতের দিকে মাঝে মাঝে পুলিশের
গাড়ি দু-একবার টহল দেয়। কাঁপা কাঁপা সুরেই বলে, ‘আজ্ঞে, এখানে আমি ঘুমিয়েছিলাম।’
‘কেন, তোমার ঘর নেই?’
‘আছে...না, মানে নেই..।’
‘আছে... নেই! এ-আবার কী
কথা! চোর-ছ্যাঁচ্চোড় নও তো?’
চমকে ওঠে
জনার্দন। একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আমি ঠিকমতো চলতেই পারি না, চুরি করব কী করে?’
‘ঠিক মতো চলতে পারো না তো এই মাঝরাতে ঘর
ছেড়ে এই গাছতলায় এসেছ কেন?’
‘ঘরে থাকার জায়গা নেই।’
‘কেন?’
মনের মধ্যে
অনেক দুঃখ জমা আছে জনার্দনের। কাউকে সে কথা বলতে পারেনি। এখন ভাবে,
পুলিশকে বললে যদি কিছু সুরাহা হয়। নিজের ঘরে না যাওয়ার সুযোগ হোক, যদি কোথাও একটা
থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এই বুড়ো বয়সে কি গাছতলায় থাকা যায়? গড়গড় করে সে বলে যায় তার নিজের দুঃখের কথা।
‘তোমার ছেলেকে কেন বলোনি এসব কথা?’
জনার্দন
নিরুত্তর।
‘কী হল,
চুপ করে আছো কেন?’
লজ্জার কথা
বলতে ইচ্ছে করছিল না জনার্দনের। কিন্তু এখন না বলে আর উপায় নেই। একটা
দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বলে, ‘মনে
বিশ্বাস ছিল ছেলেটা আমাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। বোধহয় বউয়ের
ভয়ে চুপ করে থাকে। কিন্তু বুঝতে পারিনি সেও ভেতরে ভেতরে বদলে গেছে।
সংসারে একটা অকেজো লোকের ভরণ-পোষণের বাড়তি দায় সহ্য করার মতো মানসিকতা তারও নেই।
একদিন মারধর করে পথ দেখিয়ে দিল। তারপর থেকে পথই আমার সংসার আর এই বটতলা রাতের আশ্রয়।’
কিছুক্ষণ নীরবতা। গভীর
বিষণ্ণতায় অন্ধকারটাও সহসা আরও গাঢ় মনে হয়। জনার্দনের বুক চিরে একটা
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। প্রায় একইসঙ্গে যুবকটিও দীর্ঘ্যশ্বাস ছাড়ে। তার মতো
এক হতভাগা বৃদ্ধের দুঃখে একজন পুলিশকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখে জনার্দন একটু অবাক না
হয়ে পারে না। জিজ্ঞেস করে ফেলে, ‘আপনি এখানে?’
‘কেন?’
‘মানে
আপনি তো ডিউটিত বেরিয়েছেন। রাস্তা
ছেড়ে হঠাৎ এই জায়গায়? আপনার গাড়িও
তো নেই দেখছি।’
‘রাস্তা,
গাড়ি, ডিউটি এসব কী বলছ?’
‘আপনি তো রাতে
টহল দিতে বেরিয়েছেন?’
‘টহল!’
‘আপনি
পুলিশের লোক নন?’
‘পুলিশ!’ অন্ধকার
কাঁপিয়ে খুব জোরে হেসে ওঠে যুবকটি। হাসতে হাসতেই বলে, ‘তুমি
আমাকে পুলিশ ঠাউরেছ নাকি?’
‘আপনি পুলিশ নন?’
‘মাথা খারাপ!’
‘তাহলে এত রাতে আপনি এই গাছলতায় কেন?’
যুবকটি
সহসা কিছু বলতে পারে না। জনার্দন শুনতে পায় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। এরপর
যুবকটির বিষণ্ণ কন্ঠ ভেসে আসে, ‘ওরা রাখল না বাড়িতে। এখানে রেখে গেল।’
‘রেখে গেল!’ জনার্দন
কিছুটা বিভ্রান্ত। ‘ওরা কারা? রেখে গেল
মানে?’
সে কথার
সহসা জবাব নিয়ে যুবকটি কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে, ‘তোমার কাছে দেশলাই আছে?’
বিড়ির নেশাটা
জনার্দনের অনেক দিনের। ভিখিরি হয়ে গেলেও নেশাটা পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি। এখন
একটা বিড়িতে দু-তিনবার চালিয়ে নেয়। বলে, ‘আছে। তবে বিড়ি নেই।’
‘বিড়ির দরকার নেই। তুমি একটা কাঁঠি জ্বালাও।’
যুবকের
কথামতো একটা কাঁঠি জ্বালায় জনার্দন। ক্ষীণ আলোয় গাঢ় অন্ধকারটা একটু পাতলা হয়।
কিন্তু সামনের যুবকটির দিকে তাকিয়ে ভীষণ চমকে ওঠে। এতটাই চমক খায় যে হাত থেকে
কাঁঠিটা পড়ে নিভে যায়। তার হাত-পা যেন কাঁপতে থাকে। চেষ্টা করে কথা বলার কিন্তু
শব্দগুলো যেন গলায় আটকে থাকে।
যুবকটি
বিষণ্ণ হেসে বলে, ‘তুমি ঠিকই
ধরেছ।’
জনার্দন
অবিশ্বাস মাখা কাঁপা কাঁপা সুরে বলে, ‘তোমার এই অবস্থা কেন?’
যুবকটি
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বিষণ্ণ গলায় বলে তার করুণ কাহিনি।
অংশুমান
এলাকার স্বচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। সরকারি চাকরি করে। ঘরে সুন্দরী
স্ত্রী। বিয়ের ছয়-সাত বছর পরও তাদের কোনো সন্তান হয়নি।
অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি। ডাক্তারের একই কথা,
কোনো সমস্যা নেই। এদিকে যত সময় গড়াচ্ছিল ততই স্বামী-স্ত্রী দুজনের মন-মেজাজা
খারাপ হতে থাকে। ডাক্তারের পাশাপাশি শুরু হয় নানান টোটকা।
কিন্তু কাজ আর হচ্ছিল না।
যাই হোক, কার্তিক
সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সন্তানহীন দম্পত্তি কিংবা পুত্র সন্তানহীন দম্পত্তির বাড়িতে
রাতে লুকিয়ে কার্তিক ঠাকুর রাখার একটা পুরনো রেওয়াজ আছে। গত দু-বছর
এলাকার ছেলে ছোকরারা অংশুমানের বাড়িতে কার্তিক রেখেছিল। দু-বছরই তারা
বেশ ঘটা করে পুজো করে। ঠাকুরের আশীর্বাদ হোক কিংবা চিকিৎসক, টোটকার
কামাল, মাস ছয়েক আগে তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। আগামীকাল
কার্তিক পুজো। আবেগের বশে হোক, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ছেলে ছোকরারা আজ রাতে
অংশুমানের বাড়িতে কার্তিক রেখে আসে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ঘরের সামনে কার্তিক দেখে
এবার আর একদম খুশি হয় না অংশুমান। ঝামেলা এড়াতে রাত একটু বাড়তে লুকিয়ে এই বটতলায় ফেলে
গেছে।
জনার্দন
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ওরা
তোমার পুজো না করে ফেলে যেতে পারল!’
‘আর পুজো! যা গাল দিল!’
‘তোমাকে গাল দিল!’
‘আমাকে সরাসরি দেয়নি।
যারা আমাকে রেখে এসেছিল তাদেরকেই দিচ্ছিল। কিন্তু কারণটা তো আমি,
আর শুনলামও কেবল আমি। যা সব ভাষা বলছিল মনে হল যেন নরকে পৌঁছে গেছি।
গালাগালির চোটে নিজের পরিচয়টাই ভুলতে বসেছিলাম।’
‘ওরা তোমার সঙ্গে এমনটা করতে পারল! পুজো না করুক, তাবলে এভাবে গাছতলায় ফেলে যাবে!’
‘ওদের সংসারে আমার তো আর প্রয়োজন নেই, তাই
ওই ঘরে আর আমার জায়গা নেই।’
শেষ কথাটা
বুকে ধাক্কা মারে জনার্দনের। এ-তো তারই কথা! চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের সংসারের ছবি। তার বুক চিরে
একটা গভীর দীর্ঘ্যশ্বাস বেরিয়ে আসে। সহসা মনের মধ্যে জমে থাকা সুপ্ত ক্রোধ আর
অভিমান তাকে আঘাত করতে থাকে। ক্ষোভের সঙ্গে বলে, ‘আমি না হয় সাধারণ মানুষ।
কিন্তু তুমি তো ভগবান। তোমার তো অনেক শক্তি। তোমার সঙ্গে
যেমন খারাপ ব্যবহার করেছে, তেমনি করে একটা কঠিন অভিশাপ দিয়ে দাও না ওদেরকে। বুঝবে বাছাধন। যেমন কর্ম তেমন ফল।’
মৃদু হেসে
কার্তিক বলে, ‘তুমি পেরেছ দিতে?’
চমকে ওঠে
জনার্দন। বুকের মধ্যে কিছু একটা যেন তাকে নাড়া দেয়।
চোখটা ছলছল করে ওঠে। কার্তিক বলে, ‘ছাড়ো এসব। একটু জায়গা দাও দেখি।
রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিই। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।’
শুয়ে পড়ে
জনার্দন। কিন্তু ঘুম আসে না। তার সমস্ত ভাবনাচিন্তা কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে
থাকে।
No comments:
Post a Comment