শিক্ষার
রাহুকাল

শতাব্দীর
এই সংকটময় সময়ে কেমন অবস্থা আমাদের রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার? কেমন আছে ছাত্রসমাজ?
করোনা মোকাবিলায় গত ২৪ মার্চ ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদী। পরবর্তীকালে আরও তিন-দফায় তা বেড়ে হয় আগামী ৩১ মে
পর্যন্ত। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশে লকডাউন ঘোষণার আগে, গত ১৪
মার্চ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধের ঘোষণা করেন। প্রথমে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে করেন ১৪
এপ্রিল। শেষ ঘোষণায় বলা হয়েছে আপাতত জুনের ১০ তারিখ পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। পরবর্তীকালে সেই ছুটি বাড়িয়ে পুরো জুন মাস পর্যন্ত
করা হয়েছে। স্কুল বন্ধের পাশাপাশি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বাকি পরীক্ষাও স্থগিত
করে দেওয়া হয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অন্যান্য বোর্ডের
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি জয়েন্টের
ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, আইআইটি প্রভৃতি পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে যায়।
এককথায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থার গতি হঠাৎ করে রুদ্ধ হয়ে যায়। এক ভয়ংকর
সংকটময় পরিস্থিতি। UNESCO-এর
হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশের প্রায় ৩২ কোটি ছাত্রছাত্রী সমস্যায়। এর মধ্যে নবম
থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি।
কোনোরূপ
আগাম ইঙ্গিত ছাড়া হঠাৎ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরীক্ষা প্রভৃতি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়
বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে ছাত্রসমাজ। বিরাট সংকটের মুখোমুখি তারা। মার্চের এই
সময়টা যে কোনো শিক্ষা বোর্ডের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। মাধ্যমিকের
ফলাফল আটকে গেছে। প্রথম দফার খাতা নির্দিষ্ট সময়ে জমা দেওয়া হয়ে গেলেও
দ্বিতীয় দফার খাতা সবেমাত্র জমা পড়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাই সম্পূর্ণ হয়নি। একই অবস্থা অন্যান্য বোর্ডগুলির ক্ষেত্রেও।
এইসমস্ত বোর্ডের ফলাফল প্রকাশে যে দেরি হবে সেটা পরিস্কার। কিন্তু তার
থেকেও যে প্রশ্নটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল সেটা হল পরীক্ষাগুলি কবে হবে, কীভাবে হবে? একরাশ দুশ্চিন্তা আর বিভ্রান্তির মধ্যে
রয়েছে ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকেরা। সম্প্রতি
বাকি পরীক্ষাগুলির তারিখ ঘোষণা হয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাকদের একটা দুশ্চিন্তা
কেটেছে ঠিকই কিন্তু বর্তমানে যে হারে করোনা সংক্রমণ আমাদের দেশ তথা রাজ্যে বৃদ্ধি
পাচ্ছে তাতে করে খুব একটা স্বস্তিতে নেই তারা।
এইসময়টা
অন্যান্য বোর্ডের বার্ষিক ফলাফল প্রকাশ ও নতুন সেশনের ভর্তির সময়।
ফলাফল প্রকাশ আটকে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দিয়ে অবস্থা
কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সারাবছর পড়াশোনার শেষে যে মূল্যায়ন
সেটার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীরা। যদিও এই সংকটময় সময়ে
এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। পাশাপাশি ওইসব স্কুলগুলো নতুন সেশনে ছাত্রছাত্রীদের
ভর্তি করাতে সমস্যা হয়েছে। অনলাইন মাধ্যমে কিছু কিছু প্রচেষ্টা হলেও সেখানেও
অনেকের সমস্যা রয়েছে। যদিও
পরবর্তী সময়ে এই সমস্যা কিছুটা কেটেছে। ছাত্রছাত্রীদের পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করে
দেওয়া হলেও তাদের কাছে নতুন ক্লাসের বই নেই যাতে করে তারা অন্তত ঘরে বলে পড়াশোনা
চালিয়ে যেতে পারে। তবে আশার কথা এটাই যে এই লকডাউনের মধ্যেও অনেক স্কুল নিজেরা
দায়িত্ব নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে বইখাতা পৌঁছে দিয়েছে।
জয়েন্ট
মেইনস, অ্যাডভান্স, নিট, ল, এগ্রিকালচার প্রভৃতি পরীক্ষা বন্ধ থাকার কারণে বিরাট
সমস্যার মুখে ছাত্রছাত্রীরা। একেবারে তালগোল পাকানো অবস্থা তাদের।
কেননা এইসব পরীক্ষার জন্য তাদের একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। এখন একে তো
দীর্ঘ বিরতি তার ওপর মহামারী আতঙ্ক, সেই সঙ্গে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ---সবমিলিয়ে
পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে একটা ভয়ংকর মানসিক চাপ সঙ্গী করে তাদের বসতে হবে।
একটি বিশাল
অংশের ছাত্রছাত্রী বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যায় প্রত্যেক
বছর। কিন্তু মহামারী বিপর্যয়ের ফলে সেটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বহু ছেলেমেয়ে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে। আগামী সময়ে বিদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে বহু বিধিনিষেধ
আরোপ হবে এটা নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিশ্ব বিদ্যালয়গুলিতে চাপ
বাড়বে। ফলে প্রতিযোগিতাও বাড়বে।
করোনা
বিপর্যয়ের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এর ফলে বহু মানুষ চাকরি
হারাবেন। পাশাপাশি চাকরির ক্ষেত্রও হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে
বহু ছেলেমেয়ে পড়াশোনা শেষ করেও চাকরির সুযোগ পাবে না। যারা পড়াশোনা
করছে, তারাও আগামীর ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যার মুখে পড়বে। একটা দিশাহীন ভবিষ্যৎ তাদের হতাশার দিকে ঠেলে দেবে।
এসব তো বড়ো বড়ো সমস্যা। এই নিয়ে আলোচনা সরিয়ে বরং দেথা যাক এই লকডাউন এবং
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে কী অবস্থা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও ছাত্রছাত্রীদের।
আপাতত
জুনের ৩০ তারিখ পর্যন্ত স্কুল বন্ধ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাজ্যের সরকারি শিক্ষা
ব্যবস্থার প্রায় সাড়ে তিন মাস নষ্ট। তবে এর মধ্যে গ্রীষ্মের ছুটি আছে।
সেই অর্থে কিছুটা সময় বাঁচোয়া। তবে এরকমও শোনা যচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসের আগে এই
সমস্যা মেটার নয়। আর স্কুল যদি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত না খোলে তাহলে ছমাস
নষ্ট। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে পুরো শিক্ষাবর্ষটাই নষ্ট।
কেননা জানুয়ারিতে স্কুল শুরু হলেও প্রথম মাসটা নানা কারণে পড়াশোনার অনেক বিঘ্ন
ঘটে। আর সেপ্টেম্বরের পর পুজো। পুজোর ছুটির
পর স্কুল খুলতে না খুলতেই পরীক্ষা। মোদ্দা কথা, স্কুল খুলতে যত দেরি হবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা
অনেকটাই বিঘ্নিত হবে।
দীর্ঘদিন
স্কুল বঞ্চিত হয়ে থাকার অভ্যাস নেই ছাত্রছাত্রীদের। স্কুলে পাঠদান
না থাকায় তাদের পড়াশোনা ব্যহত হচ্ছে। হঠাৎ করে কোনো আগাম কোনো ইঙ্গিত ছাড়া স্কুল বন্ধ
হয়ে যাওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের কোনো হোমওয়ার্ক দিতে পারেননি।
অধিকাংশ ছেলেমেয়ে প্রাইভেট টিউশনিতে যায়। লকডাউনের কারণে প্রাইভেট
টিউশন, কোচিং সেন্টারও বন্ধ। সেটাও ছেলেমেয়েদের কাছে একটি বিরাট সমস্যা।
স্কুল
বন্ধের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে মিড ডে মিল। ২০১৯ সালের হিসেব
অনুযায়ী সারা দেশের প্রায় বারো কোটি ছাত্রছাত্রী মিড ডে মিলের আওতায়।
তাই কয়েক কোটি ছাত্রছাত্রী মিডডে মিল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটাও একটি
বিরাট সমস্যা। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলিতে মিড ডে মিল
একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রত্যন্ত
গ্রামাঞ্চলের স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি একটি বিরাট অংশের
ছাত্রছাত্রী বাড়ি থেকে ভাত না খেয়েই স্কুলে আসে। মিড ডে মিল
তাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝতে পারি। মিড ডে মিল বন্ধ
আছে বলে ছাত্রছাত্রীদের চাল আলু দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা মিড ডে মিলের
বিকল্প কখনওই নয়।
একে তো
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ। তার উপর বাইরে বেরোনোর উপায় নেই।
এর ফলে নানাবিধ মানসিক চাপের শিকার ছেলেমেয়েরা। স্কুলে একটা
নির্দিষ্ট সময় কাটানো, পাঠদান, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গ, খেলোধুলা এসব বন্ধ।
এইসব ব্যাপারগুলি ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। ওদিকে বাবা-মায়েরাও প্রায় গৃহবন্দী। দিনের পর দিন
এইভাবে পুরো পরিবার একসঙ্গে কাটানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। করোনা
মহামারীর কারণে বাড়ির বড়োরাও মানসিক সমস্যায় রয়েছেন। কাজকর্ম বন্ধ,
দোকনপাট বন্ধ। একটি বিরাট অংশের মানুষের রোজগার বন্ধ।
এটা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রাখছে। তার প্রভাব অনেকক্ষেত্রে
পড়ছে ছেলেমেয়েদর ওপরও। পুরো পরিবার টানা একসাথে কাটানোয় অনেকক্ষেত্রে
ভালোর থেকে খারাপ ফলও দেখা যাচ্ছে। দেখা যাবে অনেক ছেলেমেয়ে হয়তো অজান্তেই মানসিক
অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। স্কুলে এলে যে মানসিক রিফ্রেশমেন্ট পাওয়া যেত সেটাও
তারা পাচ্ছে না।
টানা বাড়ি
থাকতে থাকতে অনেক খারাপ অভ্যাসও তৈরি হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। এর মধ্যে
অন্যতম হল টিভি ও মোবাইল আসক্তি। যাদের বাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ আছে তারা কোনোভাবে
পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেক ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা স্কুল ও টিউশান নির্ভর।
তাদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটছে। গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে শিক্ষার
কোনো কালচার নেই। সেইসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা কতখানি নিজেদের পড়াশোনার মধ্যে
রাখতে পেরেছে সেটাই সন্দেহের। আমাদের দেশ কিংবা রাজ্যের শিক্ষার হার যাই হাক না
কেন, এটাই বাস্তব একটা বিরাট অংশের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার
জন্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা থাকা দরকার তা নেই। বিশেষ করে
একটু উঁচু ক্লাসের ক্ষেত্রে। একটি হিসাব বলছে আমাদের দেশের ৭৭.৪ শতাংশ বাবা-মায়ের
সন্তানদের পড়ানোর মতো পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই। বাকি যাদের
দক্ষতা আছে তারাও কি তাদের সন্তানদের ঠিকমতো পড়াশোনা করাতে পারছেন? এইসব বাবা-মায়েদের অনেকেই আর্থিক বিপর্যয়ের
শিকার। ফলে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মতো যে মানসিকতা
থাকা দরকার এদের সেটা নেই। ফলে ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকের
পড়ানোর অভ্যাস নেই। অনেকে পড়ানোর ঠিকঠাক কৌশল জানেন না।
এটা তাদের কোনো দোষ নয়। সবাই সবকিছু ঠিকঠাক পারবেন এমনটা আশা করা ঠিক নয়।
তাই হঠাৎ করে সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। ফলে
ছেলেমেয়েরা সমস্যায় রয়েছে।
দীর্ঘদিন
ঘরবন্দি ছেলেমেয়েরা। নিয়মিত পাঠদানের ব্যাপার নেই। ফলে নিজে থেকে
নতুন নতুন অধ্যায় পড়ার ব্যাপারটা অনেক ছাত্রছাত্রী করে না। তাছাড়া কিছু
কিছু বিষয় আছে নিজে থেকে সমস্যা হয়। এসব কারণে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে তারা।
যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার ব্যাপারে সিরিয়াস নয় অর্থাৎ যাদের আমরা ফাঁকিবাজ
বলি, তারা এই সময় পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে পড়াশোনার ব্যাপারে
তাদের আগ্রহ এবং সিরিয়াসনেস দুটোই কমছে। তাছাড়া ঘরের বাইরে
বেরোনোর উপায় নেই। খেলাধুলো, আড্ডা, ঘোরাঘুরি এসব বন্ধ।
মানসিক রিফ্রেশমেন্ট যদি না থাকে, তবে পড়াশোনা ব্যাপারটা অনেক সময় বোঝা হয়ে ওঠে।
পড়াশোনার প্রতি তখন আগ্রহ কমতে থাকে। ব্যাপারটা কারও কারও ক্ষেত্রে বিরক্তিকর হয় উঠছে।
ফলে দেখা যাবে, যখন স্কুল শুরু হবে পুনরায় তখন অনেক ছেলেমেয়ে খাপ খাওয়াতে পারবে না।
ক্লাসে তারা আরও খারাপ পারফর্ম করবে। স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারাবে। স্কুলছুটের
সংখ্যা যদি বাড়ে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
পূর্বেই
বলেছি শিক্ষা হল আলো। এমনিতেই বিপর্যস্ত অবস্থা। এরপর যদি
শিক্ষা পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে তাহলে আগামী সময়ে আরও বড়ো দূর্যোগ নেমে আসবে।
রাষ্ট্র পরিচালকরা সেটা বোঝেন। তাই এই ঘোর সংকটের সময়েও যাতে শিক্ষা ব্যবস্থা
কোনোরকমে চালিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য তারা ভাবছেন। কিছু বিকল্প
ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি স্কুলগুলো অনলাইনে পাঠদানের ব্যবস্থা
করেছে। কিন্তু সবাই পারছেন এমন নয়। তাদের
ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিছু নামী সরকারি স্কুলও সেই পদ্ধতিতে চেষ্টা করছে।
আমাদের
রাজ্যের স্কুলগুলির যে পরিকাঠামো তাতে অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া,
অর্থাৎ পাঠদানের ব্যাপার, আপাতত প্রায় অসম্ভব। তাই কিছু
বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রথমত দূরদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষাদান।
দূরদর্শনে বিভিন্ন শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে পাঠাদন করছেন। প্রয়োজনে
ছাত্রছাত্রীদেরও ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করারও সুযোগ রয়েছে।
রাজ্য সরকারের বাংলা শিক্ষা পোর্টাল মাধ্যম রয়েছে। এখানে প্রতিটি
ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ের একাধিক করে মোডাল অ্যাকটিভিট টাস্ক দেওয়া আছে।
সেই সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিসুয়্যাল ক্লিপিংস। সরকারি
নিরেদেশ বলা হয়েছে ছাত্রাছাত্রীরা বাংলা শিক্ষা পোর্টালে ঢুকে মোডাল অ্যাকটিভিটি
টাস্ক ডাউনলোড করে সেগুলো বাড়িতে রেডি করবে। কোনো বিষয়ে
সমস্যায় পড়লে প্রয়োজনে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে তারা মোডাল
অ্যাকটিভিটি টাস্কগুলো রেডি করবে। শিক্ষকদেরও নির্দেশ দেওয়া আছে বাংলা পোর্টাল
ব্যবহারে ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে। ফোন কিংবা
মেসেজের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। বিদ্যালয় চালু
হলে তারা সেগুলো শিক্ষকদের কাছে জমা দেবে। শিক্ষকরা তার মূল্যায়ন
করবে। এসব করতে গেলে
ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হবে। পুরো বই বিমুখ হয়ে
থাকতে পারবে না। পাশাপাশি ভিডিও ক্লিপিংস দেখেও তারা পড়াশোনা চালাতে পারে।
কিছু কিছু স্কুল মোডাল অ্যাকটিভিটি টাস্ক প্রিন্ট আউট নিয়ে জেরক্স করে অভিভাবকদের
মধ্যমে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। অনেক স্কুল
হোয়াটস-অ্যাপ গ্রুপ করে তাতে প্রশ্নোত্তর, ভিডিও, অডিও প্রভৃতি মাধ্যমে
শিক্ষাদান চালানোর চেষ্টা করছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের সমস্যার কথা গ্রুপে লিখে জানালে
শিক্ষক-শিক্ষিকারা তার সমাধান করে দিচ্ছেন। কখনও ফোনে যোগাযোগ
করে সাহায্য করছেন। অনক শিক্ষক শিক্ষিকা ফেসবুক কিংবা ইউডিউব মাধ্যম ব্যবহার
করে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে
হয়তো আরও কিছু অন্য মাধ্যম ব্বহৃত হচ্ছে। মোট কথা, সরকারের থেকে
শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-শিক্ষিকার একটা অংশের মধ্যে একটি প্রয়াস রয়েছে
কোনোভাবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার। এ-বিষয়ে
কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত যে
প্রয়াসই নেওয়া হোক না কেন, এসব স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক সরাসরি পাঠদানের বিকল্প নয়
একদমই। পাঠদান পুরো বন্ধ যাতে না হয়, কোনোরকমে যাতে সেটা চালিয়ে
যাওয়া যায়, এটা তারই প্রয়াস। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পদ্ধতিতে যে সামান্য ফল তা কি
সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁচোচ্ছে?
প্রথমেই যে
কথা বলার, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
একটা ভালো অংশ অন-লাইনে মাধ্যমে অভ্যস্ত নয়। শুনতে খারাপ
লাগলেও এটাই বাস্তব। অনেকেই বাংলা শিক্ষা পোর্টালই ঠিকঠাক ব্যবহার করতে
পারেন না। সেক্ষেত্রে এই মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানে তারা অসমর্থ।
দ্বিতীয়ত, লাকডাউনের কারণে সবাই গৃহবন্দী। তাই ছাত্র-শিক্ষক
যোগাযোগ একটা সমস্যার। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অনেকের বাড়িতে টিভিই নেই।
অনলাইনে পড়াশোনা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এটা ঠিক, আমাদের দেশের
একটি বিরাট অংশের মানুষের হাতে মোবাইল আছে। কিন্তু স্মার্ট ফোন
অনেকের নেই। আর বহু মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারই করতে জানেন না।
হিসাব বলছে সারা ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারা মানুষের সংখ্যা ২০.১ শতাংশ।
শহরাঞ্চলে এই হার ৪২ শতাংশ। বাংলা শিক্ষা পোর্টালে গিয়ে এডুকেশান্যাল ভিভিও
দেখে পড়াশোনা করা অনেক ছাত্রছাত্রীর পক্ষে অসম্ভব। যাদের পক্ষে
সম্ভব তাদের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। এই লকডাউনের সময়ে একটা বিশাল অংশের মানুষ ইন্টারনেট
ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত রয়েছেন। ফলে বর্তমানে ইন্টারনেটের ব্রাউজিং স্পিড এতটাই
খারাপ যে বাংলা শিক্ষা পোর্টালই অনেক সময় খুলছে না। ভিভিও
ডাউনলোড করা কিংবা দেখা অনেক পরের ব্যাপার। আর যদি সরকারি
স্কুলগুলোতে অনলাইন পাঠদান চালুও করা হত, তাহলেও একটি বিরাট অংশের ছেলেমেয়ে সে
সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এমনকি Model Activity Task ডাউনলোড করাও অনেকের
পক্ষে সম্ভব নয়। আর সমস্ত স্কুলের পক্ষে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছে সেগুলো
জেরক্স করে পাঠানো সম্ভবই নয়। কেননা লাকডাউনের কারণে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ।
স্কুল বন্ধ। পূর্বে বলেছি
সমস্ত ছেলেমেয়ে কিংবা তাদের বাড়ির লোক পড়াশোনার ব্যাপার নিয়ে সিরিয়াস নয়।
তাই কারও কারও সুযোগ থাকলেও দেখা যায় সে আগ্রহ দেখায় না। তাই এটা
পরিস্কার বিকল্প কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু সমস্ত ছেলেমেয়ের কাছে সেই
প্রয়াসের ফল ঠিকঠাক পৌঁচোচ্ছে না। আবারও যেটা বলার, এইসব বিকল্প মাধ্যম ব্যবহার করে
শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে কিছুটা সচল রাখার চেষ্টা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটা তুলনায়
অত্যন্ত নগন্য। কেননা হাতে কলমে শিক্ষাদান আর এভাবে শিক্ষাদানের মধ্যে
অনেক পার্থক্য। তারপর কোনোরূপ মানসিক প্রস্তুটি ছাড়া হঠাৎ করে এমন
শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়া, বহু ছেলেমেয়ের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
অনেকেই বিভ্রান্ত। কিন্তু কিছু করারও নেই। পরিস্থিতি
আমাদের এমন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে যা সামলে উঠতে সময় লাগবে।
সমস্যা
প্রাইভেট টিউশান এবং কোচিং সেন্টারগুলিতেও। লকডাউনের কারণে একদিকে
যেমন কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ আছে তেমনি করে প্রাইভেট টিউশনও।
বহু শিক্ষিত বেকার মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। এটাই জীবিকা
অর্জনের একমাত্র অনেকের। তারা চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছেন। সেই সঙ্গে ভুগছে ছাত্রছাত্রীরাও। বহু
ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে কিংবা প্রাইভেট টিউটারের কাছে পড়তে যায়।
একদিকে স্কুল বন্ধ। ওদিকে এই বিকল্প শিক্ষাদানের ব্যাপারগুলোও বন্ধ।
ফলে সবদিক দিয়েই চূড়ান্ত সমস্যায় ছাত্রছাত্রীরা।
সবমিলিয়ে
দেখা যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা একটি বিরাট সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এই সমস্যার
একটাই সমাধান স্কুলে পাঠদান চালু হওয়া। কিন্তু কবে স্কুল খুলবে তা এখনও নিশ্চিত নয়।
যদি জুলাইতে হয় তাহলে হাতে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে। ঘাটতিগুলো
সামাল দেওয়া যাবে। স্কুল যত
দেরিতে খুলবে সমস্যা তত বাড়বে। রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার ওপর নির্ভর
করছে বিদ্যালয়গুলি চালু হওয়ার ব্যাপার। কিন্তু স্কুল চালু হয়ে গেলেই যে সব সমস্যার সমাধান
হয়ে যাবে এমনটা নয়। নিশ্চিত হিসাবে বলা না গেলেও এটা পরিস্কার আগামী বেশ কয়েক
মাস আমাদের সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে চলতে হবে। বিদ্যালয়ে
সেটা কী করে মানা সম্ভব হবে? সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রতিটি ক্লাসে গড়ে ষাট জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী
থাকে। প্রতিটি বেঞ্চে গড়ে পাঁচজন ছাত্রছাত্রী। এভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে
ক্লাস কীভাবে করা সম্ভব সেটাই একটা বড়ো প্রশ্ন। এই দূরত্ব বজায় রেখে এক ক্লাসে
এতজন ছাত্রছাত্রী বসানোর পরিকাঠামো অনেক স্কুলের নেই। এটা একটা বড়ো সমস্যা। তবে
একটা জিনিস বিশ্বাস করি সব সমস্যার সমাধান আছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকলের
বিকল্প পথ ঠিক বেরিয়ে আসবে। মোট কথা শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
জানি না,
আগামী সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন সাধিত হবে। কীভাবে চলবে
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু এটা পরিস্কার, লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীদের
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। এই বিপর্যয়
কীভাবে এবং কতদিনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
তবে এটা স্পষ্ট, এই যে বিপর্যয়ের রেশ অনেকদূর যাবে। সবমিলিয়ে একটা
কথা বলার বর্তমানে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার রাহুকাল চলছে।
জুন ৪, ২০২০।
No comments:
Post a Comment