ক্ষুধার মৃত্যু
সৌরভকুমার ভূঞ্যা
‘এত
শোরগোল কিসের?’
‘একটি
হাতি মারা গেছে।’
‘ও!’
‘তার
পেটে একটা বাচ্চাও ছিল।’
‘আচ্ছা।
তার মানে গর্ভিনী হাতি। তাতেই বা শোরগোলের কি আছে?
‘হাতিটাকে মেরে ফেলা হয়েছে!’
‘তার
জন্য এত উত্তেজনা! তুমি কোন গ্রহের মানুষ হে! মেরে ফেলা হয়েছে! হাতি মেরে ফেলার
ঘটনা নতুন আবিস্কার করলে নাকি?’
‘হাতিটাকে
অত্যন্ত আমানবিক, বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
‘অমানবিক!
বর্বরোচিতভাবে! কে করেছে?’
‘কে
করেছে! এখন তো আমারই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে আপনি কোন গ্রহের? এই
পৃথিবীর তো?’

গত ২৭ মে
একটি হাতি মারা যায়। কেরলের সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যানে থাকত হাতিটি। খাওয়ারের
খোঁজে সে ঢুকে পড়েছিল মল্লিপুরম জেলার একটি গ্রামে। কিছু মানুষ আনারশে বারুদ
মিশিয়ে তাকে খেতে দেয়। বেচারা হাতিটি সেটি খাওয়ার পর মুখে বারুদ ফেটে যায়। পেটের
মধ্যে দুটি অসহায় জীব---একটি ক্ষুধা, অপরটি তার সন্তান। ক্ষুধা মেটেনি। তার জায়গায়
জোটে ভয়ংকর যন্ত্রণা। অবলা জীব। কাকে বলবে তার যন্ত্রণার কথা? কার কাছে ছুটে যাবে?
তাকে গ্রাস করে অসহ্য যন্ত্রণা আর নিদারুণ অসহায়ত্ব। কোথায় গেলে পাওয়া যাবে একটু
উপশম? হাতিটা ছুটে যায় ভেলিয়ার নদীর কাছে। নেমে পড়ে তার জলে। শুঁড় আর মুখ ডুবিয়ে
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একটু উপশমের আশায়। তছাড়া নিজের অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো দেখে থাকবে জল
আগুন নিভিয়ে দেয়। তার মুখের ভেতরও তখন আগুন জ্বলছে। একটা বারুদের, অন্যটা
যন্ত্রণার। সে হয়তো ভেবেছিল নদীর এই জল তার আগুনটাকে নিভিয়ে দিতে পারবে। বেঁচে
যাবে সে। বাঁচতে যে তাকে হবেই। নিজের জন্য না হলেও নিজের সন্তানের জন্য। পেটের
মধ্যে রয়েছে ছোট্ট শিশু। তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে। হাজার হোক সে তো মা। আর
সব মা চায় তা গর্ভের সন্তানকে সুন্দর এই পৃথিবীর আলো দেখাতে। জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
হয়তো সেই কথা সে ভাবছিল। সত্যি কী ভেবেছিল আমরা জানি না। কিন্তু মোহন কৃষ্ণনের
তেমন মনে হয়েছিল। মোহন কৃষ্ণণ বনবিভাগের Rapid Response Team-এর একজন অফিসার। তার
ফেসবুক পোস্ট দেখে এই হত্যার কথা আমরা জানতে পারি। যেখানে তিনি লেখেন, “ও সবাইকে বিশ্বাস করেছিল। আনারস খাওয়ার পরে
যখন তার মুখে বিস্ফোরণ হল ও নিশ্চয়ই শিউরে উঠেছিল, নিজেকে নিয়ে নয়, বরং ওর শরীরে
বেড়ে ওঠা প্রাণ, যে আরও ১৮ থেকে ২০ মাস পরে ভুমিষ্ঠ হত তাকে নিয়ে।” কিন্তু শেষমেষ নিজেকে
বাঁচাতে পারেনি হাতিটি। বারুদ ফেটে যাওয়ায় মুখে ও গলায় ক্ষত হয়ে যায়। তার ফলে
দীর্ঘদিন কিছু ক্ষেতে পারেনি সে। শেষমেষ অনাহারেই মারা যায় সে।
এরমক
বর্বরোচিত ঘটনায় নিন্দা, প্রতিবাদ স্বাভাবিক। দেশ জুড়ে সর্বস্তরের মানুষ
প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। তারা দোষীদের শাস্তি দাবি করছেন। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী
পিনারাই বিজয়ন টুইট করে জানিয়েছেন দোষীদের শাস্তি হবেই। দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত
করে দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। এই লেখার সময়
পর্যন্ত তিনজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। হয়তো শেষমেষ আসল
অপরাধী ধরা পড়বে। আশা করা যায় দোষীরা শাস্তি পাবে। ওই গর্ভিনী হাতি ন্যায় বিচার
পাবে।
হে হস্তিনী
মাতা, তোমাকে সাবাশ। ক্ষুধার লড়াইয়ে তুমি শহীদের মৃত্যু বরণ করেছ। তোমার
আত্মবলিদান বৃথা যায়নি। তোমার যন্ত্রণাময়, অভিমানী মৃত্যু দিয়ে তুমি জাগিয়ে দিতে
পেরেছ সমাজের একটা বিরাট অংশকে। তোমার এই নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত হত্যা সমর্থন করি
না। তবুও দুএকটি কথা তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে।
তুমি তো
সাইলেন্ট ভ্যালির জাতীয় উদ্যানের বাসিন্দা। তোমার উদ্যান ছেড়ে কেন তুমি গ্রামে
গিয়েছিলে? বুঝতে পারছি তোমার পেটে ক্ষুধা ছিল। সঙ্গে ছিল আগামীর সন্তান। পেটের
দায়েই তুমি ছুটে গিয়েছিলে। কিন্তু তোমার জানা দরকার ক্ষুধার জন্য তুমি এক জায়গা
থেকে অন্য জায়গায় হয়তো যেতে পারো কিন্তু তার জন্য তোমাকে খারাপ অবস্থার মানসিক
প্রস্তুতি রাখতে হবে। তুমি জানো না এখন বিশ্ব মহামারী চলছে। তোমার মতোই কত
মানুষ অনাহারের শিকার। ক্ষুধাই এইসব মানুষগুলোকে বাধ্য করেছিল নিজের বাসস্থান
ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে। এখন তাদের অনেকের সম্বল বলতে কেবল অনাহার আর অসহায়ত্ব।
তোমার মতো তাদের অনেকে ফিরতে পারেনি নিজের ঘরে। পথেই শেষ হয়ে গেছে পথচলা। কেউ বা
শিকার হয়েছে মানুষের চরম নিষ্ঠুরতার। লোগেশ সুব্রাহ্মনিয়াম, গঙ্গাস্মার মতো
পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পেরিয়ে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। তাদের
সেই দুঃসাহস আর জেদ জয়ী হতে পারেনি। ক্ষুধা তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিহারের এক
স্টেশনে চাদরে ঢাকা একটি হতভাগ্য মায়ের নিথর দেহ। তার ছোট্ট অবুঝ ন্যাংটো সন্তান
চাদরটা টেনে বারবার মায়ের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মায়ের ঘুম ভাঙেনি। ক্ষুধায় কাতর মা চলে গেছেন শান্তির
চিরঘুমে। ছত্তিশগড়ের বারো বছরের আদিবাসী কিশোরী জামালো মাদাকামি হেঁটে প্রায়
বাড়ি ফিরে এসেছিল। কিন্তু ক্ষুধার কাছে হার মেনে বাড়ির সামান্য দূরে চিরঘুমে শায়িত
হয়েছে। এরকম আরো কত মানুষ হারিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। এদের মৃত্যুর মধ্যে কোনো ‘অস্বাভাবিকতা’ নেই, নেই কোনো ‘নিষ্ঠুরতা’।
কেননা এরা ‘ভাইরাসে’র শিকার। যে ভাইরাসের নাম ‘ক্ষুধা’।
মোহন কৃষ্ণণ লিখেছে ‘ও সবাইকে বিশ্বাস করেছিল।’ সত্যি কি তাই? সত্যি কি তুমি
বিশ্বাস করেছিলে সবাইকে? যদি করে থাকো তাহলে বলব পুরোপুরি বিশ্বাস করা তোমার
ঠিক হয়নি। যেখানে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না সেখানে পশু হয়ে মানুষকে
বিশ্বাস করাটা তোমার বোকামি। একেবারে এই সময়ের দুটো ঘটনার কথা তোমায় বলি।
পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে আসা ঝাড়খথণ্ডের শ্রমিক ফুলদেব ভূঞ্যা সাইকেলে করে ফিরতে
চেয়েছিল বাড়ি। পৌঁছোতে চেয়েছিল স্ত্রী সন্তানের কাছে। কিন্তু দূর্গাপুরের কাছে
কিছু গ্রামবাসী বাইরের লোক হওয়ায় তাকে তাড়া করে। তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে দূর্ঘটনায়
প্রাণ যায় তার। সোনারপুরের বুবাই রায় তার প্রতিবন্ধী ছেলে আকাশকে নিয়ে ফারাক্কা
থেকেই পায়ে হেঁটে ফিরছিল রেললাইন ধরে। যেটুকু খাওয়ার ছিল আগেই শেষ হয়ে গেছে।
শেষমেষ জলটাও ফুরিয়ে যায়। এদিকে ছেলে পিপাসায় কাতর। ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছুক্ষণ হয়তো রাখা
যায় তাতে তৃষ্ণা মেটে না বরং আরও বাড়ে। অসহায় বাবা পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে যায়
ছেলের জন্য সামান্য একটু জল আনতে। কিন্তু...! বুবাই বাইরের
লোক। হলই বা মানুষ, এলাকার তো নয়। জল মেলে না। জোটে নির্মম প্রহার। বুবাই চোর
ডাকাত নয়। বাঘ ভাল্লুক কিংবা কোনো হিংস্র পশুও নয়। সে একজন সাধারণ মানুষ। একজন
পিতা। ছেলের জন্যই তার ছুটে যাওয়া। কিন্তু মানুষ তাকে বিশ্বাস করেনি। ভাগ্য ভালা
পুলিশ এবং প্রশাসন শেষমেষ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ৩২ বছরের
নিকিতা। তোমার মতো তার পেটেও সাত মাসের সন্তান। তোমার মতোই সেই পেটেও রয়েছে
ক্ষুধা। তাই নিয়ে শত শত মাইল পথ হেঁটেছে নিকিতা। জানি না অনাহার তার কাছে হার
মেনেছে কি না!
এরকম আরও
কত দৃষ্টান্ত আছে। এই মানুষগুলোর একটাই অপরাধ, ক্ষুধা। ক্ষুধা নামক ব্যাপরটা না
থাকলে তাদের এমন নির্মম পরিণতি হত না। যেখানে ক্ষুধার জন্য মানুষের এমন নির্মম
পরিণতি, সেখানে তুমি একটা অবলা পশু মাত্র। তোমার কেন ক্ষুধা থাকবে? থাকলেও কেন
তুমি নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাবে? এটা তোমার অপরাধ। সেই অপরাধের শাস্তি
পেয়েছ তুমি।
আবারও
বলছি, তোমার এই নির্মম মৃত্যুকে সমর্থন করি না। তবুও বলব, একদিক দিয়ে দেখতে গেলে
তোমার ভাগ্য অনেক ভালো। বুঝতে পারছি না তোমাকে ‘ভাগ্যবতী’ বলাটা ঠিক হবে কি না! তোমার মৃত্যুতে নড়েচড়ে উঠেছে
সমাজ। প্রতিবাদ হচ্ছে চারিদিকে। জানি না তুমি ন্যায়বিচার পাবে কি না। কিন্তু
যেটুকু হচ্ছে তাও কী কম! সবার কপালে তাও কি জোটে! এতদিন
কেবল বনের পশু হয়ে ছিলে। মরে গিয়ে তুমি মানুষের সমাজে একটা জায়গা করে নিয়েছ। সত্যি
বলতে কী মরে গিয়ে তুমি প্রবলভাবে বেঁচে উঠেছ। এও বা কম কীসে! কত হতভাগ্য মানুষ
নীরবে হারিয়ে গেছে। কত মানুষ চরম দূর্দশার শিকার হয়েছে। কিন্তু তারা কেবল হারিয়েই
গেছে। তোমার মতো তারা ফিরে আসতে পারেনি।
৬ জুন, ২০২০।
No comments:
Post a Comment