বাড়িয়ে দাও
তোমার হাত...

ডাঃ সুধীর দেহারিয়া। ডাক্তার হিসেবে বেশ নাম
যশ। দেশের করোনা যুদ্ধের তিনিও একজন সৈনিক। তিনি কি
কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলেন জীবনে এমন দিন আসবে? বাড়ি ফিরলেন কিন্তু ঘরে ঢোকা হল
না। ফিরে যেতে হল উঠোন ছুঁয়ে। দূর থেকে দেখলেন স্ত্রী-সন্তানদের। নিজের
সংসারেও কি তবে তিনি ব্রাত্য আজ?
ডাঃ শিফা এম-মহম্মদও কোনোদিন কি ভেবেছিলেন
জীবনে এমনদিন আসবে? ২৩ বছরের যুবতী শিফা। পেশায় সার্জেন।
করোনা যুদ্ধের তিনিও একজন সৈনিক। মার্চ মাসে তার বিয়ের সব
ঠিকঠাক। কিন্তু তিনি বা তার পরিবারের কেউ কি কোনোদিন
ভেবেছিলেন দিনটা নীরবেই চলে যাবে? শরীরে বিয়ের পোশাক উঠল না, অনুষ্ঠান হল না,
শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হল না। উপরি হিসেবে জুটল বন্ধুদের ব্যাঙ্গ আর বিদ্রূপ। ব্রাত্যের
তকমা কি লেগে গেল তারও গায়ে?
রোজকার ডিউটি শেষে বাসায় ফেরেন ডাঃ সঞ্জীবনী
পাণিগ্রাহী। ৩৬ বছরের এই মহিলা পেশায় মনোবিদ। সেদিন
বাড়ি ফিরে তিনি চমকে উঠলেন। প্রতিবেশীরা আটকে দিয়েছে
গেট। তাকে ঢুকতে দেবে না। রোজকার চেনা মানুষগুলো
আজ কেমন অচেনা। মনের ডাক্তার নিজেই বেশ অবাক হয়ে যান। ‘মন’
শব্দটা তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অবাক হয়ে ভাবেন তিনি কি
তবে আজ সমাজের চোখে অস্পৃশ্য হয়ে গেলেন? করোনা নামক ভাইরাস কি তবে সমাজে
অস্পৃশ্যতার জন্ম দিচ্ছে?
করোনা গ্রুপের নবতম ভাইরাস কোভিড-১৯। এই অতি
ক্ষুদ্র ভাইরাস বিশ্ব বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের দুশোর বেশি
দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়েছে।
ইতিমধ্যেই দুই লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বিশ্বের তাবড় তাবড় উন্নত
দেশগুলির অবস্থা বিপর্যস্ত। বাতাসে কান পাতলে শোনা
যাচ্ছে আতঙ্ক আর হাহাকারের সুর। করোনার কোনা টিকা নেই। চিকিৎসার
নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই। তবুও চিকিৎসকেরা হাল
ছেড়ে দিয়ে বসে নেই। সীমাবদ্ধ ক্ষমতাকে সম্বল করে, অত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়
প্রত্যয় নিয়ে তারা লড়াই করে চলেছেন। দুনিয়া জুড়ে মৃত্যু মিছিল দেখা যাচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু সেরে উঠেছেন তার থেকেও কয়েক গুন মানুষ।
করোনার কারণে আমাদের দেশে লকডাউন চলছে।
গৃহবন্দী মানুষ। কিন্তু এই ভয়ংকর সংকটের সময়ে নিজেদের
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে লড়াই করে যাচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, পুলিশকর্মী, দমকলকর্মী,
সাফাইকর্মী প্রমুখরা। ডাক্তার, নার্স সহ বিভিন্ন চিকিৎসা কর্মীরা একেবারে
যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রোগের মোকাবিলা করছেন। তারা হলেন Front-Line
Warrior. আমরা ঘরে বসে আছি যাতে ভাইরাস আমাদের শরীরে কোনোভাবে প্রবেশ করতে না
পারে। আমরা জানি না আমাদের আশেপাশে আদৌ ভাইরাসটি উপস্থিত
আছে কি না। কিন্তু ওইসব চিকিৎসক নার্সরা সরাসরি ভাইরাসের সঙ্গে
আছেন। প্রতি পদে পদে তাদের কতখানি ঝুঁকি সেটা সহজে অনুমেয়।
দিনরাত এক করে, সংসার পরিজন থেকে দূরে তারা লড়াই করছেন। তারা কেবল ডাক্তার বা নার্স
নন, তারা যোদ্ধা। তারা হলেন সমাজের প্রকৃত নায়ক।
প্রথম দফার লকডাউন চালু হওয়ার দুদিন আগে
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশব্যাপী পালিত হয়েছিল জনতা কার্ফু। প্রধানমন্ত্রী
সেদিন দেশবাশীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, ওইদিন বিকাল পাঁচায় শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে,
হাতে তালি দিয়ে এই করোনা যুদ্ধের অসম সাহসী সৈনিকদের সম্মাননা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন
করতে। দেশের সকল প্রান্তের বেশিরভাগ মানুষ সেদিন
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করেছিলেন। এরপর আমরা দেখি ডাক্তার
নার্সদের নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথাবার্তা, মন্তব্য মিডিয়ার পাতায় ঘোরাফেরা করতে
থাকে। এখনও সেসব বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে
দেশময় যে টুকরো টুকরো ছবি উঠে আসছে তা দেখে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি
আমরা আমাদের প্রকৃত যোদ্ধাদের সম্মান দিচ্ছি? হয়তো বিক্ষিপ্ত ঘটনা, তবুও এটা ঠিক
সমাজের কোথাও কোথাও ডাক্তার নার্সরা যেন অস্পৃশ্য হয়ে উঠেছেন। আমরাই তাদের সঙ্গে
তেমন আচরণ করছি। করোনা মোকাবিলায় ডাক্তার-নার্সদের লড়াইকে সম্মান জানিয়ে অনেকেই তাদের
ঈশ্বর আখ্যায় আখ্যায়িত করছেন। তাহলে কি বলব ঈশ্বরও আজ
অস্পৃশ্য?
করোনার এখনও প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি। এর বিরুদ্ধে
লড়াই করার নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই। আমাদের দেশের চিকিৎসা
পরিকাঠামো উন্নত দেশগুলির তুলনায় যথেষ্টই কম। এছাড়াও নানাবিধ সমস্যা
রয়েছে। বহুবিধ প্রতিকূলতা সঙ্গে নিয়ে এই রোগের বিরুদ্ধে
লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার নার্সরা। প্রতি মুহূর্তে
সংক্রমণের আশঙ্কা। ইতিমধ্যেই অনেক ডাক্তার কিংবা নার্স
সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এটা দেখে বুঝতে অসুবিধা
হয় না কত ঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। তারা তা করছেনও। তাদের
যোদ্ধা কিংবা ঈশ্বর যাই বলি, মোদ্দা কথা হল দেশ তাদের দিকে তাকিয়ে।
সারা দেশে এখন চিকিৎসকদের নিয়ে অনেক ভালো
ভালো কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আলো থাকলে অন্ধকার থাকবে না
এমনটা তো হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি দেশের
বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসক নার্সরা আক্রান্ত হচ্ছেন, হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। তাদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ কি? তারা যেহেতু হাসপাতালে রোগীর দেখাশোনা করছেন তাই তাদের
শরীরে করোনা ভাইরাস আছে। তাদের মাধ্যমে এই ভাইরাস
ছড়িয়ে যাওয়ার ভয়। তাই কোথাও তাদের নিজদের বাসায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কোথাও
বাড়িওয়ালা তাদের বলছেন হাসপাতালে থাকতে, কখনও বা আবার বাড়ি খালি করার নির্দেশ
দিচ্ছেন।
গত ২৩ মার্চ রোজকার ডিউটি শেষ করে ডাঃ
সঞ্জিবনী পানিগ্রাহী যখন বাসায় ফেরেন তার আবাসনের প্রতিবেশীরা গেট আগলে দাঁড়ায়। তারা
তাকে আবাসনে ঢুকতে দিতে চান না। কারণ করোনা সংক্রমনের
ভয়। অথচ এই মানুষগুলো অসুবিধায় পড়লে তার কাছে ছুটে আসে
সাহায্যের জন্য। আশ্চর্যের বিষয় ডাঃ সঞ্জীবনী মনোবিদ। তিনি
করোনা পেশেন্টের চিকিৎসা করেননি। সে কথা বলার পরও তারা
তাকে ঢুকতে দিতে রাজি হন না। এতখানি আতঙ্ক মানুষের
মনে। হতবাক সঞ্জীবনী বলেন, “মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করছে।
আমি সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি যেন হঠাৎ করে অস্পৃশ্য হয়ে গেছি।”
একজন মনোবিদের মনে হচ্ছে তিনি যেন মানুষের চোখে অস্পৃশ্য (untouchable) হয়ে
গেছেন।
হায়দ্রাবাদের এক জুনিয়র ডাক্তারের কথা শুনলে
চমকে উঠতে হয়। তার বাড়িওয়ালা তাদের ‘নোংরা’ (dirty) বলে উল্লেখ করেন। তাদের বাড়ি
খালি করে দিতে বলেন। ডাক্তারের কথায়, “They asked us to vacate without any
notice. Most of the doctors are now on the streets and have nowhere to go.” এর
থেকে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! চেন্নাইয়ের এক নার্স লতা কুমারী। আগে
তিনি কাজ থেকে ফিরলে বাড়িওয়ালি তার সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। কিন্তু এখন তার দিকে
ফিরেও তাকান না। উল্টে তাকে পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছেন বাড়ি ছাড়ার কথা।
ডাঃ লাভলীন মঙ্গলা। নয়ডার মেট্রো হসপিটাল
এ্যান্ড ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ডাক্তার। এরকম সামাজিক অত্যাচারের শিকার তিনিও।
অত্যন্ত হতাশ গলায় তাঁর বক্তব্য, “সামাজিক বৈষম্যের এমন খবর দেখে সত্যিই হতাশ
লাগছে। এসব আমি আগে কখনও দেখিনি। ভাইরাস আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা করতে গিয়ে
আমরাও তো আমাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছি।” একেবারে সত্যি কথা। নিজেদের
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের সেবা করছেন আর মানুষ তাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন
করে দিতে চাইছেন।
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও ডাক্তার নার্সদের ওপর
আক্রমণ, তাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখার ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজ্যে করোনা
আক্রান্তের চিকিৎসার প্রধান হাসপাতাল বেলেঘাটা আইডি। এই হাসপাতালের এক জুনিয়র
ডাক্তার অর্ঘ্যদীপ গাঙ্গুলি। একদিন ডিউটি সেরে বাসায় ফিরতে গিয়ে রাস্তায় আটকে
পড়েন। পরপর সাতজন ট্যাক্সি ডাইভার তাকে গাড়িতে নেন না কারণ তিনি ওই হাসপাতালে কাজ
করেন। তাঁর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “It seemed that the people in the
country have found yet another reason to ostracize and abuse its medical
personal who are at the frontline of this battle against Covid-19.”
কলকাতার এক নার্স দুই সন্তান ও বয়স্কা মাকে
নিয়ে ভাড়াবাড়িতে থাকেন। তাকে বাড়িওয়ালা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে
বলেন। শুধু মুখে বলা নয়, সঙ্গে দুজন মানুষকে সঙ্গে এনে একপ্রকার ভয় দেখান তিনি।
নার্স জানান তিনি করোনা রোগীদের দেখাশোনা করছেন না। তাতে সন্তুষ্ট হন না
বাড়িওয়ালা। তার বক্তব্য, হাসপাতালে করোনো রোগী নিশ্চয়ই আছে। তিনি জেনেছেন করোনা
ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় আর আশপাশের মানুষকে আক্রান্ত করে। এই কারণে সারা পৃথিবীতে
হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাই তিনি কোনোমতেই তাকে থাকতে দিতে
রাজি হন না।
আটচল্লিশ বছরের কাজরি হালদার কলকাতা মেডিক্যাল
কলেজ ও হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। তার স্বামীকে প্রতিবেশীরা বলে দেন তার স্ত্রীকে
তিন মাস বাসায় না ফিরে ওই হাসপাতাল বা অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে নিতে। বাধ্য
হয়ে কাজরিকে তাই করতে হয়। এইভাবে নানা প্রান্তে হেনস্থা ও অবমাননার ঘটনা ঘটতে
থাকে। বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তার অ্যাসোশিয়েশন FORDA (Federation Of
Resident Doctors Association) নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের
কাছে আবেদন জানান।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কানেও
ব্যাপারটা যায়। ২৫ মার্চ এক বক্তব্যে তিনি দেশবাসীকে আবেদন জানিয়ে বলেন, “যদি আপনারা
দেখেন কোনো চিকিৎসা কর্মীর ওপর কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটছে, তাহলে সেখানে গিয়ে
মানুষকে বোঝান তারা যা করছেন ভুল করছেন।” সেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও বলেন, “এই
সংকটের সময়ে হাসপাতালে সাদা কোট পরা প্রতটি মানুষই হলেন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি
স্বরূপ। এই মানুষেরা মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের জীবন রক্ষা করছেন। এই করতে দিয়ে তারা
নিজেদের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।”
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কথাই সত্য। যে কোনো
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রই এই সত্য বুঝতে পারবেন। দেশে করোনা প্রকোপ দিন দিন
বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাও। ডাক্তার-নার্সদের ওপর
চাপ ক্রমশ বাড়ছে। ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত। অনেকেই আক্রান্তের
সম্ভাবনায় আইসোলেশনে চলে গেছেন কিংবা কোয়ারেন্টাইনে। সময় যত এগোবে, রোগীর সংখ্যা
যত বৃদ্ধি পাবে, এদের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষদের উচিৎ
তাদের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতার বার্তা দিয়ে তাদের মানসিক জোর বাড়ানো। কিন্তু
তা না করে যদি তাদের অস্পৃশ্যের চোখে দেখা হয়, তাদের নানাভাবে হেনস্থা করা হয় তাহলে
আখেরে কিন্তু সমস্যা আমাদেরই। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে করোনা নামক এই মারণ
ভাইরাসের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন একমাত্র এই ডাক্তার নার্সরাই। তাই
তাদের যদি অস্পৃশ্য বলে দূরে সরিয়ে দিই, সমাজ-বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করি তাতে
বিপদটা সকলেরই। ডাক্তার নার্সদের দূরে সরিয়ে রাখলে করোনা আসবে না এমন কোনো
গ্যারেন্টি নেই। কিন্তু এটা নিশ্চিত করোনা আক্রান্ত হলে ওইসব ডাক্তার নার্স ছাড়া
কোনো গতি নেই। শুধুমাত্র পেশাগত কর্তব্য পালন নয়, করোনা মোকাবিলায় দেশের
অসংখ্য ডাক্তার, নার্সরা ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন। আমাদের উচিৎ সেইসব মানুষদের
পাশে থাকা।
না, ডাঃ সুধীর দাহেরিয়াকে কেউ বাড়ি থেকে
তাড়িয়ে দেয়নি। ডাঃ সুধীর দাহেরিয়া মধ্যপ্রদেশের ভূপালের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক
ছিলেন। হাসপাতালে পাঁচদিন ডিউটি দেওয়ার পর গত ৩০ মার্চ তিনি বাড়ি আসেন স্ত্রী
সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে। করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর অন্যতম শর্ত হল সামাজিক দূরত্ব
বজায় রাখা। সে সময় করোনা সেভাবে মাথাচাড়া দেয়নি ভূপালে। তাসত্ত্বেও তিনি সামাজিক
দূরত্ব পালন করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া ছবিতে দেখা যায় বাড়ির গেটের বাইরে
একটি উঁচু জায়গায়া বসে তিনি চা খাচ্ছেন। শরীরে তখনও হাসপাতালের পোশাক। আর বাড়ির
গেটের ভেতর স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। চা খেতে খেতে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
এই সময় প্রতিবেশী একজন ছবিটি তোলেন। ওদিন সামান্য দেখা করে তিনি আবারও ডিউটিতে
ফিরে যান। ডাঃ সুধীরের এই ব্যাপারটা পোস্ট হওয়ার পর বহু মানুষ তার এই অ্যাটিটুডের
প্রশংসা করেন। চারুদত্ত আচার্য নামে যিনি এই ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট
করেছিলেন তিনি তার বিবরণের শেষে একটা অসাধারণ লাইন লেখেন, “ইয়ে হো তা হ্যা সৈনিক
কা এন্ট্রি।” সত্যি সত্যি তিনি একজন সৈনিক। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ
চৌহানও তার প্রশংসা করেন টুইটারে লেখেন, “Meet Mr. Sudhir Deharia, who’s the CHMO
of Bhopal district. On Monday, he reached residence after 5 days, sat outdoors
the home and drank tea, took care of the household and returned to the hospital
from outdoors. My finest needs to Dr. Deharia and 1000’s of thousands and
thousands of Corona Warriors like these. We are pleased with you.”
সত্যি এমন ত্যাগগে কুর্ণিশ জানাতে হয়। ডাঃ
শিফা এম মহম্মদও কি কম বড়ো ত্যাগ স্বীকার করেছেন! কেরালার মেয়ে শিফা। গত ২৯ মার্চ
তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল দুবাইয়ের ব্যবসায়ী আনুস মহম্মদের সঙ্গে। এদিকে দেশের সঙ্গে
সঙ্গে কেরালাতেও তখন বাড়ছে করোনা রোগী। উল্লেখ্য আমাদের দেশে কেরালাতেই প্রথম
করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। যাই হোক, রাজ্যের এই সংকটময় অবস্থায় মানুষের পাশে
দাঁড়ানো কর্তব্য বলে মনে করেন শিফা। সেই মতো বাবা-মা, হবু স্বামীকে জানিয়ে দেন তিনি
এখন বিয়ে করবেন না। সবাই তার সিদ্ধান্তে মত দেন। বাবা মুক্কম মুহম্মদ পরে জানান, “প্রত্যেক
মেয়ের জীবনে বিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু আমার মেয়ে তার ব্যক্তিগত স্বর্থ
দূরে সরিয়ে রেখে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাগত অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সে
যখন বিয়ে বন্ধের কথা বলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাতে সম্মত হই।” কান্নুরের প্রিয়ারাম
মেডিক্যাল কলেজের আইসোলেশন ওয়ার্ডে তার দায়িত্ব পড়ে। যেদিন শরীরে ওঠার কথা বিয়ের
পোশাক, সেদিন তার জায়গায় তিনি তুলে নেন পিপিই। তার এমন সিদ্ধান্তে তার কিছু বন্ধু
বান্ধব তাকে বিদ্রূপও করেন। তবে সেটা তিনি গায়ে মাখেননি। কেননা, তিনি মনে করেন
মানবতা যখন বিপন্ন তখন ব্যক্তি স্বার্থগুলো দূরে সারিয়ে রাখতে হয়। তার এমন
সিদ্ধান্তে চারিদিকে প্রশংসার ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু শিফার ছোট্ট জবাব, “Marriage can wait but
my patients who are struggling for their lives in the isolation ward.” মাত্র ২৩ বছরের এক মেয়ের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কতখানি বিরাট ব্যাপার
তা একটু গভীরভাবে অনুধাবন না করলে আমরা বুঝতে পারব না। অথচ সেই শিফার সলজ্জ জবাব, “আমি
বিরাট কিছু করে ফেলিনি। আমি কেবল আমার কর্তব্য করেছি। আমার মতো এমন অনেকে আছে
যারাও তাদের বিয়ে বন্ধ রেখেছে।”
কেরালার মেয়ে রেশমা মোহন দাস। ৩২ বছরের রেশমা
কেরালার একটি করোনা হাসপাতালের মূলত আইসিইউ বিভাগে কাজ করতেন। গত ২৩ মার্চ তার
শরীরে করোনা উপসর্গ দেখা দেয় এবং পরের দিন রিপোর্ট আসে তিনি করোনা আক্রান্ত
হয়েছেন। প্রসঙ্গত বলার, ভারতবর্ষের করোনা মোকাবিলায় এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি
বয়সের যে মানুষটি (এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত) সেরে উঠেছেন তিনি হলেন থমাস
আব্রাহাম (৯৩)। তাঁকে এবং তার স্ত্রী মারিয়াম্মা (৮৮)-কে আইসিইউতে দেখাশোনা করতেন
রেশমা। ১২ মার্চ থেকে তিনি এই দুজনের দেখভাল করছিলেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে ভেঙে
পড়েননি রেশমা। চিকিৎসা চলাকালীন বন্ধুদের হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ করে লেখেন, “I
will leave this room within a week after defeating you [the novel coronavirus].” শেষমেষ করোনাকে হারিয়ে
তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু সুস্থ ফিরে ঘরে বসে থাকতে চান না তিনি। আবারও
ফিরে যেতে চান তার পেশাগত জীবনে, মানুষের সেবায়। চিকিৎসকরা তাকে এখনও ১৪ দিন
বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু রেশমা জানান, সাতদিন পরেই তিনি কাজে যোগ
দিতে চান। কতখানি মানসিক জোর থাকলে এমন ভাবনা ভাব সম্ভব তা সহজে অনুমেয়। একি কেবল
পেশাগত দায়বদ্ধতা? নাকি তার বাইরে অন্য কিছু?
মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় আমরা দেখতে
পাই বিভিন্ন দেশ বিদেশের চিকিৎসক নার্সদের ছবি। যে ছবিগুলো দেখে আমরা চমকে উঠি।
জীবনের ঝুঁকি তো রয়েছেই, পাশাপাশি সংসার পরিজন বিচ্ছিন্ন হয়ে কী পরিমান পরিশ্রম
তারা দিনের পর দিন করে চলেছেন তা ভাবলেই চমকে উঠতে হয়। আমাদের দেশের এই মারাত্মক
গরমের সময়ে পিপিই পরে একটানা কাজ করাটা কতটা কষ্টকর তা আমাদের পক্ষে অনুভব করা
সম্ভব নয়। এত ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার করে তারা কাজ করে চেলেছেন।
সারা দেশের অসংখ্য ডাক্তার, নার্স,
চিকিৎসাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থ-সুখের কথা ভুলে দিনরাত এক করে লড়াই করে চলেছেন।
এমন এক লড়াই যার কোনো আগাম প্রস্তুতি নেই। হাতে সেভাবে কোনো অস্ত্র নেই। ভয়ংকর
এক চাপের মধ্যে রয়েছেন তারাও। সেই অবস্থায় আমাদের উচিৎ অন্তত মানসিকভাবে তাদের
সঙ্গে থাকা। কিন্তু দেশের বিভন্ন প্রান্তে তাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক ভাবে
নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। সেটা শুধু লজ্জার নয়, ভয়েরও। কোথাও তাদের সঙ্গে অস্পৃশ্যের
মতো আচরণ করা হচ্ছে, নিজের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কাউকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য
করা হচ্ছে, কোথাও তাদের ওপর ইঁট পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।
যাদের হাতে আমাদের জীবনের চাবিকাঁঠি, তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার প্রকারান্তরে
নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু আমরা সেটা বুঝছি না। তাই তো তাদের সুরক্ষায়
শেষমেষ দেশের সরকারকে নতুন করে আইন প্রণয়ন করার কথা ভাবতে হচ্ছে। এদের ওপর কোনো
অন্যায় হলে শাস্তি স্বরূপ জেল জরিমানা হবে।
কিন্তু আইন দিয়ে কি সবকিছুর সমাধান করা যায়?
তাই যদি যেত তাহলে সমাজে এত অন্যায় হত না। আইন থাকবে। কিন্তু তার থেকেও বেশি করে
দরকার গনসচেতনতা। কোনা বিষয়ে নিজেদের মতো করে সবকিছু ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্তে না
এসে, ঠিকঠাক করে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। কোনো সমস্যা হলে তার উপযুক্ত সমাধানের
পথ খুঁজতে হবে। এই মহামারী যেমন আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আগামী দিনেও নেবে,
তেমনি করে আমাদের শিখিয়ে যাবে অনেক কিছু। আগামীর নতুন পৃথিবীতে ভালোভাবে বাঁচতে
হলে আমাদের চিরাচরিত ভাবধারার পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে সমস্যা নিজেদেরই। তাই
ব্রাত্যজনের দলে তাদের না ফেলে, তাদের পাশে আরও বেশি বেশি করে দাঁড়াতে হবে আমাদের,
সেটা আমাদের সকলের প্রয়েজনে।
২৫ এপ্রিল, ২০২০।
২৫ এপ্রিল, ২০২০।