আতিয়ুর চেয়ে
আছে অচেনা পথের দিকে....
টানা
নয় দিন গৃহবন্দী থাকার পর বেরোতে হল সেদিন। দিনটি
এপ্রিল মাসের প্রথম দিন। অন্যান্য বছর এই দিনটিতে বন্ধুবান্ধবদের বোকা বানানোর
নানারকম নতুন নতুন মেসেজে ভরে যেত ডিজিটাল ইনবক্স।
দিনটা এপ্রিলের প্রথম দিন জেনেও সেই মেসেজ খুলতাম আর বোকাও বনতাম বারবার।
সেই বোকা বনে যাওয়ার মধ্যে একটা মজাও ছিল। এ-বছর
গোটা বিশ্ব জুড়ে যে বিপর্যয় চলছে তাতে করে একে-অপরকে বোকা বানানোর সেই মানসিকতা
আর কারও নেই। অন্তত আমাকে কেউ একটাও সেরকম মেসেজ পাঠায়নি। তবুও শেষমেষ বোকা বনতে
হল।
বাজারের কাছাকাছি গিয়ে বেশ অবাক হলাম।
ঘড়ির কাঁটায় এখন সাড়ে এগারোটা। যে সময় এই জায়গাটা মানুষের ভীড়ে গমগম করত এখন সেই
এলাকা একেবারেই শুনশান। সূর্যদেব পৃথিবীর দিকে না তাকিয়ে থাকলে পরিবেশটা গভীর
রাত্রির সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। গোটা দেশে লকডাউন চলছে। এই সময় এমন পরিবেশ স্বাভাবিক।
কিন্তু এতদিন বাইরে বের হইনি। লকডাউনের পর প্রথম বাড়ির বাইরে পা দিয়ে নিজের প্রিয়
চেনা জায়গাটাকে এমন অচেনা দেখে প্রথমটা সত্যি বোকা বনে যাওয়ার মতোই অবস্থা।
যাই হোক, গৃহস্থলীর টুকিটাকি জিনিস কিনব বলে একটি
দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি। নিয়ম মেনে, নির্দেশিত মাপেরও অনেকটা দূরে। গুটিকতক
খরিদ্দার। তাও দোকানের গন্তব্যটা এখন অনেক দূর।
দাঁড়িয়ে আছি, একা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। সহসা
চোখে পড়ল আতিয়ুরকে। শহীদ স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই পরিচিত পোশাকে। লুঙ্গিটা
হাঁটুর ওপর ভাঁজ করে পরা। কাঁধে একটা গামছা ফেলা। শহীদ স্তম্ভের সামনে দিয়ে চলে
যাওয়া রাস্তার একবার এদিক একবার ওদিক তাকাচ্ছে আতিয়ুর। বিষাদমাখা শূন্য দুটি চোখে
অসম্ভব দুঃসাহসিক প্রত্যাশা। আতিয়ুর মিরাক্যাল শব্দটির অর্থ জানে না। কিন্তু এটা
জানে জীবনে কখনও কখনও এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যেটা বেশ অবিশ্বাস্য। আজও সেরকম একটি অপ্রত্যাশিত
ঘটনা ঘটার প্রত্যাশা নিয়ে উৎসুক দৃষ্টি মেলে রৌদ্র মাখছে আতিয়ুর।
আতিয়ুর ভ্যান চালায়। বেশ গরিব। স্ট্যান্ডের
চার পাঁচজন ভ্যানচালকের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক। এদের বাড়ির অনেক খবরও আমি
জানি। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি আবহাওয়া যাই হোক না কেন, খুব সমস্যা না হলে এরা ঠিক বাড়ি
পৌঁছে দেবেই। অর্থ নয়, সম্পর্কটাই এখানে একটা বড়ো ফ্যাক্টর। দীর্ঘদিনের যাতায়াতে
এদের সঙ্গে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের অনেক কথাই
বলে তারা।
আতিয়ুরকে সবাই চেনে। ওর একটা বৈশিষ্ট্য আছে।
ওই হল স্ট্যান্ডের সেই ভ্যানচালক যে রাত্রে সবার শেষে বাড়ি যায়। সাধারণত রাত নটা
সাড়ে নটার মধ্যে সমস্ত ভ্যানওয়ালারা বাড়ি চলে যায়। কিন্তু আতিয়ুর থাকে রাত্রি
এগারোটা পর্যন্ত। শেষ বাসটি মিনিট দশ পনেরো আগে ঢোকে। শেষ বাস যাওয়ার পর
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর বাড়ি যায় আতিয়ুর। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, প্রকৃতি খুব
বিরোধ না সাধলে আতিয়ুর থাকবেই। যদি শেষবেলায় কোনো যাত্রী পাওয়া যায়। রাতের
ভাড়ায় একটু বেশি টাকা পাওয়া যায়। জোর করে চাপ দিয়ে নয়, ওই সময় কোনো যাত্রী
থাকলে সে নিজে থেকেই একটু বাড়তি টাকা দেয়। বেশিরভাগ দিনই যাত্রী থাকে না। তবে
কোনো কোনোদিন জুটে যায়।
এখন রাত নয়, দিন। ঘড়ির কাঁটা দুপুর বারোটাকে
ছোঁওয়ার জন্য এগিয়ে চলেছে। আতিয়ুর দাঁড়িয়ে আছে। কাছেপিঠে তার ভ্যান নেই। কেমন
সন্দেহ হল। ভ্যান নেই তো লাকডাউনের সময় এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন রাস্তায়? বাজার-টাজার
করতে এসেছে বলে মনে হল না। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকতে সহসা দূরে একটি দোকানের
বারান্দার নীচে একটি ভ্যান দেখতে পেলাম। পলিথিনে প্রায় পুরোটা ঢাকা। সামান্য একটু
দেখা যাচ্ছে। এতদিন যাতায়াত করছি। আতিয়ুরের ভ্যান চিনতে আমার অসুবিধা হল না।
ভ্যানটা লুকিয়ে রেখে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে আতিয়ুর। সত্যিই আতিয়ুরের মতো লোকেরা
রাস্তা হারিয়ে এখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। আতিয়ুর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যদি দৈবাৎ
কোনো যাত্রী মিলে যায়। কিংবা যদি কারও ভ্যানে করে মাল বওয়ার দরকার হয়। দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে তার ঈশ্বরের কাছে হয়তো সে এরকমই একটি মিরাক্যালের প্রত্যাশা করছে। কিন্তু
রাস্তা শুনশান। দিনের বেলায়ও গভীর রাতের নিস্তব্ধতা। আমাদের মতো গুটিকত মানুষ
ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই। আতিয়ুর তাই দাঁড়িয়েই থাকে কেবল।
ভ্যান টেনে সংসার চলে আতিয়ুরের। এখন স্টান্ডে
টোটের সংখ্যা বেড়ে গেছে বেশ। ফলে জীবনযুদ্ধের প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়েছে। আগের
মতো যাত্রী হয় না। বেশকিছু চেনা পরিচিত, বাঁধাধরা যাত্রী আছে বলে তবু আতিয়ুরের
চলে যায় কোনোরকম। কিন্তু সেদিকেও ক্রমশ ভাঁটা পড়ছে। মানুষেরও রুচি বদলাচ্ছে।
তাছাড়া অযথা সময় নষ্ট করতে কে চায়। তাই ভ্যান ছেড়ে যাত্রীরা ক্রমশ টোটোর দিকে
ঝুঁকছে।
কয়েকদিন আগে বাড়ি ফেরার সময় নিজের এই দুঃখের
কথা বলছিল আতিয়ুর। বলছিল, স্যার ভ্যান টেনে আর বোধহয় সংসার চলবে না। একে তো বয়স
বাড়ছে। তার উপর টোটোর বাড়বাড়ন্ত। একটা টোটো না হলে নয়। কিন্তু টোটোর যা দাম!
এত টাকা পাব কোথায়?
একটা টোটো হলে আতিয়ুরের সংসারটা হয়তো কছুটা
মসৃন ভাবে চলতে পারে। কিন্তু এতগুলো টাকা জোগাড় করা তার পক্ষে বেশ সমস্যার।
ভ্যান টেনে সংসার চালানো তো শুধু নয়, মেয়েদের বিয়েও দিতে হয়েছে। আমি মনে মনে
আমার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম আতিয়ুর যেন একটা টোটো কিনতে পারে। কিন্তু
এখন মনে হচ্ছে আতিয়ুরের পক্ষে আর কখনও বোধহয় টোটো কেনা সম্ভব হবে না।
আতিয়ুর এখন তার ঈশ্বরের কাছে কী প্রার্থনা
করছে? সে কী চাইছে যা হয় হোক, এই লকডাউন নামক ভয়ংকর ব্যাপারটা উঠে
যাক? নাকি আল্লার কাছে প্রার্থনা করছে ভাইরাসের এই দাপট থেকে
মুক্ত হোক পৃথিবী। করোনা নামটার সঙ্গে হয়তো এতদিনে পরিচয় ঘটে গেছে আতিয়ুরের।
এটাও হয়তো জেনে গেছে এটি একটি ভাইরাস। কিন্তু ভাইরাস বস্তুটি কী সেটা মনে হয় সে
ভালোমতো বোঝে না। একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস সারা পৃথিবীকে থামিয়ে দিতে পারে এটা ভেবে
বোধহয় সে অবাক হয়। আমার মনে হয় এই ভাইরাস তার মাথায় জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। সে চায় তার
চেনা রাস্তাটা আবার ফিরে আসুক তার কাছে। লুঙ্গি পরে, কাঁধে গামছা দিয়ে বকবক করতে
করতে ছুটে চলবে তার ভ্যান। ছুটে চলবে তার সংসার আর জীবনের ছোটো ছোটো
স্বপ্নগুলো। আতিয়ুর পথে নেমে এখন সেই পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে।
জানি না এই বিপর্যয় থেকে কবে রক্ষা পাব আমরা।
কবে আবার স্বাভাবিক হবে সবকিছু। কিন্তু এটা নিশ্চিত আতিয়ুরের মাতো বহু মানুষ,
পথকে কেন্দ্র করে যাদের সংসারের পথচলা, তারা এখন একরাশ উদ্বেগ আর যন্ত্রণা নিয়ে
চেয়ে আছে হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যাওয়া জীবনের শুনশান পথের দিকে।
No comments:
Post a Comment