Friday, April 24, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-১৩


অচেনা স্কুলে একদিন...

টোটো থেকে নেমে মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ সবে সকাল নটা তবুও চারদিক একেবারে নির্জন কোনো মানুষের দেখা নেই সামনের চেনা বাড়িটাকে কেমন অচেনা মনে হল বেশ বিবর্ণ কেমন যেন মনমরা, বিষণ্ণ গেটে ঢুকে রোজকার অভ্যাস মতো প্রথমেই চোখ গেল পাশে স্নিগ্ধ সবুজের সমারোহ যা মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলত সবসময় আজ তেমনটা অনুভব করতে পারলাম না ভোররাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে সূর্যের সাথে এখনও চলছে মেঘেদের লুকোচুরি খেলা বৈশাখী বৃষ্টি আর নরম আলোয় গাছের পাতায় পাতায় সবুজের আলো তবুও মনে হল গাছগুলো যেন অনেকটাই প্রাণহীন একরাশ বিষণ্ণতা এসে গ্রাস করল মনে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম অদ্ভুত শূন্যতার দিকে
    দীর্ঘ আঠাশ দিন পর আজ আবার স্কুলে এলাম আর বিগত আটত্রিশ দিনে এই নিয়ে তৃতীয়বার নয় নয় করে চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে শিক্ষকতা জীবনে পেশাগত জীবনে এমন দীর্ঘ বিরতি এই প্রথম এটা ঠিক বছরে পুজোর একটা বড়ো ছুটি থাকে বিগত কয়েক বছর মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে গ্রীষ্মের ছুটিও বর্ধিত হচ্ছিল কিন্তু এমন দীর্ঘ বিরতি এই প্রথম কেননা প্রকৃত বিরতি তো আটাশ দিনের নয়, আটত্রিশ দিনের।
    স্কুলের সামনের রাস্তাটা বেশ অপরিস্কার ভোরের বৃষ্টি তার ধুলোর আস্তরণ অনেকটা ঢেকে দিতে পারলেও ঝরাপাতারা তখনও লিখে রেখেছে নিঃশব্দের যাপনকথা পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ যে অসুখ বদলে দিয়েছে স্কুলের চেনা রূপ পথ ভালো নেই গাছও ভালো নেই তাই পথের ধুলো আর ঝরাপাতা নীরবে একে-অপরের সাথে ভাগ করে নিচ্ছে গভীর বিষাদের যন্ত্রণা
    পথ ও পাতার বিষণ্ণ চুপকথা পাশে রেখে এগিয়ে যাই পুরোনো বিল্ডিং-এর জীর্ণ সিঁড়িটা যেন বুড়িয়ে গেছে অনেকটাই প্রতিটি ধাপের ধুলোর আস্তরণে নিস্তব্ধতার ছবি সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলা আমার ঘর দীর্ঘ আঠাশ দিন পর তালা খোলা দরজার আংটায় হাত রাখতে গিয়ে সহসা থমকে যাই একটা ভয় চেপে ধরে মনে যে মানুষটি এতদিন এই দরজার তালা খুলে এসেছে, আজ তার হাতের প্রতি একটা অবিশ্বাস জেগে ওঠে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করি একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগে অনেকদিন দরজা জানালা খোলা হয়নি আলো পড়েনি এ-ঘরে ঘরের মেঝেতেও ধুলোর আস্তরণ আমার চেয়ার টেবিলটা মোটামুটি সাফ-সুতরো ব্যগটা পাশে রেখে চেয়ারে বসতে গিয়ে থমকে গেলাম আবারও প্রতিদিন আমার ঘরে ঢোকার আগেই যে মানুষটি খুব যত্ন করে চেয়ার টেবিল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে, আজ মনে মনে তার প্রতি জেগে ওঠে অদ্ভুত সন্দেহ আর অবিশ্বাস বেরিয়ে আসি এগিয়ে যাই বেসিনের দিকে সাবান চাওয়ার আছিলায় জিজ্ঞেস করে নিই, সে হাত পরিস্কার করেছে কিনা স্কুলে এসে আগে ভালো করে সাবানে হাত ধুয়েছে জানার পর মনে মনে আশ্বস্ত হই সদ্য স্যানিটাইজার মাখা হাত তবুও রাখি জলের ধারার নীচে নিজেকে লুকোনোর নিখুঁত অভিনয় সাবান দিয়ে পুনরায় হাত পরিস্কার করতে করতে আসলে মনের মধ্যে জমে থাকা ভাইরাসটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু সন্দেহ এমন এক ভাইরাস যা সাবান স্যানিটাইজার কি বিদায় করতে পারে? নাহলে হাত ধুয়ে নিজের এতদিনের চেনা সেই ঘরে ঢুকতে কেন অস্বস্তি করবে? এতদিন ব্যবহার করে আসা চেয়ারটায় বসতে কেন দ্বিধা জাগবে মনে? কেন বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে---সত্যি ও এসে হাত ধুয়েছে তো? কিংবা ঠিকঠাক হাত ধুয়েছে তো? অদৃশ্য মারণ ভাইরাস কোথায় কোথায় আছে জানি না কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভাইরাসের উপস্থিতি এখন সর্বক্ষণ টের পাই মাত্র কদিনেই এতটাই বদলে গেছি! এ-বদল কি কেবল আমার একার? আমার চারপাশে যারা আছে তারাও কি বদলে যায়নি? তাদের সন্দেহের চোখ আমার দিকে কি নেই?
    ভাইরাস বিশ্বজুড়ে এখন একটাই শব্দ--ভাইরাস কোভিড-১৯ নামধারী অতি ক্ষুদ্র কিন্তু ভয়ানক এই দানব তাণ্ডব চালাচ্ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে। স্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী। রুদ্ধ হয়ে গেছে জীবনের ধারা সভ্যতা আজ মুখোমুখি গভীর সংকটের মানুষ ভালো নেই একদম যুদ্ধ চললে মানুষ কি ভালো থাকতে পারে? যুদ্ধই বটে বিশ্বযুদ্ধ এ-এক অদ্ভুত ভয়ংকর যুদ্ধ যেখানে আমরা সবাই সৈনিক সবাই লড়াই করছি শত্রু অদৃশ্য কিন্তু সে এতটাই ভয়ানক যে বিজ্ঞানকে আজ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কঠিন পরীক্ষায় বিশ্বের অস্ত্র ভাণ্ডারের ভয়ংকর ভয়ংকর অস্ত্রগুলো জেগে আছে অর্থহীন উপহাসে নিরস্ত্র হাতে নির্বাসনই এখন বাঁচার একমাত্র পথ সে কারণে মানুষ আজ গৃহবন্দী থমকে গেছে তার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ, চেনা সব ছবি যে বিদ্যালয় এখন কচি-কাঁচাদের কলরোলে মুখরিত হয়ে থাকার কথা, সেখানে এখন শ্মশানের নীরবতা যে ঘরগুলো গমগম করত ছাত্র-শিক্ষকের পঠন-পাঠনে, সেগুলো তালাবন্ধ অনেকদিন সেখানে ছাত্র-শিক্ষক নেই, পাঠদান নেই, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ নেই, শিক্ষকের শাষণ নেই—আছে কেবল একরাশ অন্ধকার আর নিষ্ঠুর নিস্তব্ধতা যে ঘরে ঢুকলে মনের মধ্যে জেগে উঠত অদ্ভুত এক প্রশান্তি, সেখানে ঢুকতে আজ মনের মধ্যে জেগে উঠছে অস্বস্তি আর ভয় সবুজের সমারোহে ঘেরা যে বিদ্যালয়ের আশ্রমিক পরিবেশ নিয়ে অনেক গর্ব করেছি, অনেক প্রশংসা শুনেছি; আজ সেই পরিবেশের সবকিছুই আছে শুধু আশ্রম শব্দটা কেমন বেমানান হয়ে গেছে বিদ্যালয় হল মন্দির নামের শেষেও বাণী মন্দির কিন্তু এ-মন্দির আজ শূন্য এখানকার ঈশ্বরেরা এখন গৃহবন্দী, পূজারীরাও তাই শ্মশান-শূন্যতা নিয়ে মন্দিরের কঙ্কাল নীরবে ফেলে চলেছে চাপা দীর্ঘ্যশ্বাস
    আজ কিছুক্ষণের জন্য হলেও নীরবতার মুক্তি ঘটে তার তবে ছাত্রছাত্রীরা নয়, এসেছে তাদের বাবা-মায়েরা অনেকেই এসেছেন তবুও সেভাবে নীরবতা কাটল কী? সারি দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে এমন দূরত্বে যে হাত বাড়ালেও সামনের জনকে স্পর্শ করা যায় না সকলের মুখ ঢাকা, মাস্ক কিংবা কাপড়ে পরিচিত অনেককে সহসা চেনাই যায় না সবাই ধীর পায়ে আসছে, কাজ মিটিয়ে চলে যাচ্ছে কোনো তাড়াহুড়ো নেই অপেক্ষার জন্য কারও বিরক্তি নেই, অভিযোগ নেই ব্যতিক্রমী দু-একজন বাদে বাক্য বিনিময়ের মুহূর্ত নেই সে তাগিদও নেই উভয়পক্ষের বাচ্চাদের মিড ডে মিলের বরাদ্দ নিয়ে চলে যেতে পারলেই যেন তারা বাঁচে আমরাও যেন কোনারকমে দিয়ে দিতে পারলে স্বস্তি পাই সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মানছি আমরা, নিঃসন্দেহে কিন্তু সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে আমি কি ভয় পাচ্ছি না? ওর শরীরে ভাইরাস নেই তো? কোনো কারণে দূরত্বের ব্যবধান কমে গেলে কি আঁতকে উঠছি না মনে মনে? এই ভয়টা কি বিপরীত পক্ষের মনেও কাজ করছে না আমার সম্বন্ধে? অজান্তেই কি আমরা একে-অপরকে সন্দেহ করছি? মনের মধ্যে সন্দেহের ভাইরাস এই ভাইরাস খুব বিপজ্জনক করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হয়তো একদিন আবিস্কার হবে কিন্তু চোখের সামনে এমন ভয়ানক বিশ্ব মহামারী কিংবা অতিমারী দেখার পর আমরা কি আমাদের মনের মধ্যেকার ভাইরাসটাকে তাড়াতে পারব খুব তাড়াতাড়ি? বিভিন্ন গবেষণা বলছে আগামী কয়েক বছর আমাদের এরকমই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এভাবে সেশ্যাল ডিসটেন্সিং মান্য করতে হবে কত বছর? সঠিক হিসাব কেউ জানে না যত বছরই হোক না কেন, এভাবে ডিসটেন্সিং মেনটেন করতে করতে সত্যি সত্যি আমাদের মধ্যে সোশ্যাল ডিসটেন্স তৈরি হয়ে যাবে নাতো? আজকের এই যে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং-এর কথা বলা হচ্ছে, অনেকের মতে এটা আসলে ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে তবে একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে ফিজিক্যাল  নয়  আমরা আসলে সোশ্যাল ডিসটেন্সিংই মান্য করছি আর আগামী সময়ে সেটা হয়তো আরও প্রকট হবে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনটেন করে আমরা হয়তো ভালো থাকব কিন্তু একে অপরের থেকে দূরে সবে যাবো না তো? মাঝে মাঝে এই প্রশ্নগুলো মনের মাঝে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়হয়তো এসব প্রশ্নগুলো অবান্তর হয়তো এ-আমার দুর্বল, ভীতু মনের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু আমরা সবাই চাই, যে নতুন পৃথিবী আসছে আগামীর জন্য সে পৃথিবী হোক সমস্ত ভাইরাস মুক্ত
    কাজ চলছে প্রায় নীরবে সময় বয়ে যাচ্ছে সহসা দেখি দু-একটি ছাত্রছাত্রী লাইনের কাছাকাছি গেটের কাছাকাছিও দু-একজনকে ঢুকতে দেখলাম এমনিতে লকডাউনে ঘরের বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই। তার ওপর সরকারি নির্দেশ আছে ওদের কোনোমতেই স্কুলে আসা যাবে না। বকাঝকা করে বাড়ি চলে যেতে বলে সবাইকে গেটের বাইরে পাঠিয়ে দিই তারা যায় তো একটু পরে আবারও দু-একজন ঢুকে পড়ে আবারও তাদের বিদায় করি কোনো কোনো অভিভাবক নিজেই তার ছেলে কিংবা মেয়েটিকে সঙ্গে করে এনেছেন তাদের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করি সবমিলিয়ে আমরা জনা চারেক স্কুলের গেট পাহারা দেওয়ার মতো লোক কোথায়? তাছাড়া শুধু গেট আগলে কি সবাইকে আটকানো যায়? ফাঁক ফোকরের তো অভাব নেই যাই হোক, এইভাবে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ঢুকে পড়া এবং তাদের বিদায় করার পর্ব বেশ কয়েকবার চলে বাড়ি চলে যেতে বললেও কাউকে কাউকে দেখা যায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে
    অনেকটা সময় পার হয়ে যায় হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠি একসঙ্গে প্রায় পাঁচ সাতজন ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়েছে স্কুলের ভেতর আরও আশ্চর্যের ব্যাপার তিনটে মেয়ের পরনে স্কুলের ইউনিফরম দুটো ছেলে শুধু স্কুল ইউনিফরমই পরে আসেনি পিঠে ব্যাগও রয়েছে। মিড ডে মিলের বরাদ্দের পাশাপাশি সমস্ত শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব বিষয়ের এক সেট করে প্রশ্ন দিচ্ছিলাম বাবা-মায়েদের হাতে। সেই প্রশ্ন নেওয়া বাহানায় তারা একেবারে সাজসজ্জা সহ হাজির। আগে স্কুলে কোনো ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত হলে, ইউনিফরম না পরলে বকাঝকা করতাম আর আজ বকাঝকা করছি তার ঠিক বিপরিত কারণে সময়ের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি একেবারে গেটের বাইরে বার করে দিই রাস্তায় না দাঁড়িয়ে বাড়ি চলে যেতে বলি কিন্তু তাদের যেন যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই ফিরে আসতে গিয়ে একটা ভাবনা ভেবে চমকে উঠি
    বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য আর ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমরা ওরা না থাকলে বিদ্যালয়ের কোনো মূল্য নেই আমাদেরও কোনো ভূমিকা নেই বিদ্যালয়ে ওদের অধিকার সবার আগে অথচ এখন ওদের এখানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই স্কুল চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের গেট বন্ধ থাকে যাতে ছেলেমেয়েরা কোনোভাবে বিদ্যালয়ের বাইরে যেতে না পারে আর আজ, আমি নিজেই তাদের জোর করে বের করে দিচ্ছি সেই গেট দিয়ে নিয়ম নির্দেশিকার কথা ওরা জানে কিনা জানি না ওরা শুধু জানে এই বিদ্যালয় ওদের বিদ্যালয়ের গেট খোলা থাকলে এখানে ঢোকার অধিকার ওদের আছে দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস স্কুলে আসতে পারেনি ওরা তাই আজ স্কুল খোলা থাকার খবরে ছুটে এসেছে ইউনিফরম না পরলে স্কুলে ঢোকা যায় না তাই হয়তো কেউ কেউ একেবারে সাজসজ্জা করেই এসেছে গেটের বাইরে গেলে যাদের কপালে বকুনি জুটত, আজ গেটে ঢোকার কারণে সেই শাস্তি হচ্ছে হয়তো একটু অবাক ওরা, বিভ্রান্তও নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় তারা হয়তো সেই কথাই বলছে ফিরে আসতে গিয়ে তাই থমকে দাঁড়ালাম
    গত ১৪ মার্চ রাজ্য সরকার স্কুল বন্ধের ঘোষণা করেন। ওই দিন ঘোষণার কিছু আগে করোনা সচেতনতার বার্তা দিতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সেমিনার করেছিলাম সেদিন সিরিয়াস হয়ে ওদের অনেক কথা বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু সেভাবে ভয় ছিল না মনে। একটা বিশ্বাস কাজ করছিল মনে, আমাদের দেশে তেমন কিছু হবে না কিন্তু এতদিনে সমস্ত ভাবনাচিন্তা একেবারে বদলে গেছে বিশ্ব বিপর্যয় দেখছি। দেখছি আমাদের দেশ কিংবা রাজ্যের চেহারা। আর এসব দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে চেপে বসেছে একটা আতঙ্ক শুধু নিজের নিরাপত্তা নয়, অন্যের নিরাপত্তার জন্যও আমাদের সরকারি স্বাস্থ্যবিধি কোনোভাবে অমান্য করা উচিৎ নয়। ওদের এইভাবে বাইরে আসা ঠিক হয়নি। দাঁড়িয়েছিল ওরা। ওদেরকে পুনরায় বোঝাই সমস্ত নিয়মকানুন মানতে বলি। যত কষ্ট হোক বাড়িতে থাকার কথা বলি। চুপচাপ শুনে যায় ওরা।
    কথা ফিরে আসব এমন সময় একজন সহসা বলে, ‘স্যার স্কুল খুলবে না? আমরা স্কুলে আসব না?’ দেখলাম বাচ্চা একটি মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে তার মুখটা কেমন বিষণ্ণ তার চোখে-মুখে কোনো উচ্ছলতা নেই কেমন যেন বিমর্ষ, বিষণ্ণ জিজ্ঞাসা নয়, তার প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠেছে একটা ব্যাথাতুর আকুতি ওরা ছুটি পেতে ভালোবাসে তাই বলে এত দীর্ঘ নয়। বুঝতে পারি ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছে ওরা এতো ছুটি নয়, একপ্রকার নির্বাসন
    ওরা স্কুলে আসতেই অভ্যস্ত বিদ্যালয় ওদের কাছে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, ওদের মুক্তির আকাশ এখানে কেবল পাঠদান নেই, আছে হৈ-হুল্লোড়, বন্ধুদের সাথে মজা, দুষ্টুমি; টিফিনের মিড-ডে মিল, গেটের পাশের ফুচকা, আচার, মশলা মুড়ি; খেলার মাঠ—ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি, স্কিপিং কিংবা দৌড়োদৌড়ি...আরও কতকিছু ছোটোখাটো তবুও বেশ মধুর পাশাপাশি একসাথে স্কুল আসা, বিশেষ করে স্কুল শেষে হৈ-হুল্লোড় করে একসাথে বাড়ি ফেরার মজাই আলাদা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে স্কুলের গেট ওদের জন্য বন্ধ অনেকদিন বন্ধুদের সাথে দেখা, গল্পগুজব সবকিছু বন্ধ ওরা চঞ্চল, ভালোবাসে ছুটতে বিদ্যালয় বঞ্চিত এমন বন্দী জীবন ওদের কাছে অসহনীয় একদম ভালো নেই ওরা এটা হয়তো সবার অজান্তে ওদের মনে বিরাট চাপ সৃষ্টি করে চলেছে যে চাপ থেকে মুক্ত হওয়া বেশ কঠিন
    করোনার বিপর্যয়ের কথা ওরাও কমবেশি জেনে গেছে মহামারী কিংবা অতিমারী ব্যাপারটা সম্পর্কে সঠিক ধারনা হয়তে ওদের নেই কিন্তু এটা ওরা বুঝতে পারছে করোনা নামক ভাইরাসটি খুব ভয়ংকর বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত চলছে মৃত্যু মিছিল এসব জানে ওরা সেই সঙ্গে সঙ্গে জীবনে প্রথমবার দেখছে এতদিন স্কুল বন্ধ থাকা এটা জানে না কবে স্কুল খুলবে হয়তো এমনও ভাবছে আদৌ স্কুল খুলবে তো? পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না তো? হারিয়ে যাবে না তো স্কুল জীবনের আনন্দের দিনগুলি---স্কুলের প্রেয়ার হল, স্যার ম্যাডামের ক্লাস, দুপুরের মিড ডে মিল, খেলার মাঠ? ফিরে পাবে তো প্রিয় বন্ধুবান্ধব, রোজকার মজা আর আনন্দের মুহুর্তগুলো?
    ওরা স্কুলে ফিরতে চায় ওরা ফিরে পেতে চায় ওদের স্বাভাবিক স্কুল জীবন কিন্তু সময় বড়ো খারাপ এখন পৃথিবীর এই গভীর অসুখ কবে সারবে জানা নেই অদৃশ্য শত্রু কোথায় লুকিয়ে আছে কেউ জানে না যতদিন না পরিস্থিতি অনুকূল হয় ততদিন স্কুলের গেট ওদের জন্য বন্ধ থাকবে তাই আপাতত ওদের ঘরেই থাকতে হবে আগে জীবন, তারপর অন্য সবকিছু একটা ক্ষত বিক্ষত মন নিয়েও বেঁচে থাকা যায় কিন্তু জীবনটা যদি না থাকে! তাই স্কুলে দরজা এখনই খোলা হবে না তাদের জন্য
    আকাশে মেঘ আবারও জড়ো হচ্ছিল একটু একটু করে। দেখতে দেখতে ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় গোটা আকাশ। কাজকর্ম শেষ করে সবে উঠেছি এমন সময় জোর বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিচ্ছিল স্কুলের খোলা বারান্দা। হয়তো ফেরার আগে সে মুছে দিয়ে গেল ধুলোর বুকে এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা বিষণ্ণ অধ্যায়। মেঘলা বিকেলে যখন গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম পুনরায় তখন আশেপাশে কেউ নেই। সেই আগের মতো শূন্যতা। বৃষ্টিভেজা বিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে আগের মতো। একদম একা।
    এতো কেবল একটি স্কুলে কথা নয়। সমস্ত স্কুলেরই আজ এই ছবি। বড়ো বিষণ্ণ এই ছবি। কিন্তু সময় বদলাবে নিশ্চয়ই বদলাবে কোনো অন্ধকারই চিরস্থায়ী নয় অনন্তকাল ধরে কোনো ঝড় চলতে পারে না একদিন ঝড় থেমে যাবে শান্ত হবে প্রকৃতি পৃথিবীর বুকে অন্ধকার কেটে আসবে নতুন আলো যে আলোয় বিষণ্ণ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এখনকার স্কুলগুলো আবারও জেগে উঠবে প্রাণের মূর্ছনায় সেদিনের প্রত্যাশায় বিদ্যালয়গুলিও আকুল প্রতীক্ষায়

২১ এপ্রিল, ২০২০।

No comments:

Post a Comment