Friday, April 10, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-৭


করোনার ১০০ দিন ও ভারত....


৯ এপ্রিল, ২০২০
বেশিদিন আগের কথা নয় বিগত বছরের শেষদিন অর্থাৎ ২০১৯-এর ৩১ ডিসেম্বর। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত বারোটা ছুঁই-ছুঁই আমরা সবাই অধীর আগ্রহ আর চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে, রাত্রির গভীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আসবে একটি নতুন দিন। অন্যান্য দিনের থেকে এই দিনটি আলাদা কেননা এই দিনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে একটি নতুন বছর নতুন বছর মানে এক নতুন অধ্যায়। অতীতের চাওয়া-পাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করে সুখ-দুঃখের আলো অন্ধকার মাখতে মাখতে নতুন করে স্বপ্ন দেখার দিন, সংকল্প নেওয়ার দিন। তাই বছরের এই দিনটি যতই শেষের দিকে এগোতে থাকে আমাদের আবেগ আর উত্তেজনার পারদও ক্রমশ একটু একটু করে বাড়তে থাকে।

    যাই হোক, ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল একে-অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় ভরে উঠতে থাকে ডিজিট্যাল ইনবক্স সোশ্যাল মিডিয়ার পাতাও তখন নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তায় উপচে উঠছে কোথাও গানবাজনা, কোথাও বা পার্টি হোক না ইংরেজি নতুন বছর, আমাদের দেশের সংস্কৃতিতেও সেটা মিশে গেছে বেশ গভীর ভাবে বিশেষ করে শহরজীবনে ইংরেজী নতুন বছরের এক আলাদা মাত্রা রয়েছে এককথায় উৎসবমুখর মধ্যরাত কিন্তু আমরা তখন ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ৩১ ডিসেম্বরের পরের দিনটি ১ জানুয়ারি ছিল না। আসলে দিনটা ছিল ১ এপ্রিল এপ্রিলের প্রথম দিন আমাদের কাছে April Fool Day নামে পরিচিত। আমরা নানাভাবে একে-অপরকে বোকা বানাই। নির্ভেজাল সেই বোকা বানানোর খেলায়ও থাকে রাশি রাশি মজা ২০২০-এর সেই প্রথম দিন যখন আমরা, ‘নতুন বছর সকলের ভালো কাটুক’, ‘আলোকময় হোক আগামী জীবন’, ‘জীবনের চাওয়া পূর্ণ হোক’ ইত্যাদি বার্তায় একে-অপরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি তখন বুঝতে পারিনি সময় নীরবে আমাদের কী বোকাই না বানিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব-বিপর্যয়ের বার্তা নিয়ে নীরবে হাজির হয়েছে করোনা নামে এক মারণ ভাইরাস। আমরা তার টেরও পাইনি।
    প্রসঙ্গত বলার, করোনা ভাইরাস একেবারে নতুন কিছু নয় বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে প্রথম এই ধরনের ভাইরাস আবিস্কৃত হয় এটি একটি বিশেষ শ্রেণীর ভাইরাস যা মানুষের শ্বাসনালীকে আক্রমণ করে সাধারণ সর্দি-কাশি, গলাব্যাথার মতো এর উপসর্গ ধীরে ধীরে এই ভাইরাসের বিভিন্ন প্রজাতি আবিস্কার হতে থাকে এই প্রজাতির মারাত্মক ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে ‘এসএআরএস-সিওভি’ (২০০৩), ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’ (২০০৪), ‘এমইআরএস-সিওভি’ (২০১২) প্রভৃতি এই রোগের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, সর্দিকাশি, হাঁচি, গলা ব্যাথা প্রভৃতি।
    ২০১৯-এর ডিসেম্বরের রাত্রি বারোটা বাজার প্রায় বারো ঘন্টা আগে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান শহরে এক নতুন ধরনের ভাইরাস আক্রমণের কথা জানতে পারে চীন যদিও এর আক্রমণ শুরু হয়েছিল আরও কিছু আগে কিন্তু এই রোগটি অনেকটাই নিউমোনিয়া রোগের মতো হওয়ায় চীনের ডাক্তাররা এটিকে সেরকম রোগ বলেই ভেবেছিল কিন্তু ক্রমশ তারা বুঝতে পারে এই নিউমোনিয়া নতুন ধরনের। পূর্বোক্ত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের থেকে এর বৈশিষ্ট্য কিছু আলাদা চীনের সরকার নড়েচড়ে বসেন। চীনের উহান শহরের হোলসেল সি ফুড মার্কেটে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে এবং দেখা যায় যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা কোনো না কোনোভাবে ওই মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত। দ্রুত চীন সরকার এই ভাইরাস দমনে নেমে পড়ে এবং এই জায়গাটিকে প্রায় সিল করে ফেলা হয়। যাই হোক, চীনে যখন এইসব হচ্ছে আমরা সাধারণ ভারতীয়ারা এসবের কিছুই জানতাম না। সুদূর চীনের কোনো এক শহরে এক নতুন ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়েছে তা নিয়ে আমাদের ভাবনার মতো কিছু ছিল না।
    যাই হোক, জানুয়ারির ৭ তারিখে চীন নিশ্চিত করে এটি একটি নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা এই নতুন করোনা ভাইরাসটির নামকরণ করেন কোভিড-১৯। ধীরে ধীরে উহান ছাড়িয়ে চীনের আরও কিছু জায়গায়ও এই ভাইরাসের আক্রমণের খবর আসে। চীনের বিজ্ঞানীরা দিনরাত এক করে গবেষণা করতে থাকেন এই রোগটির সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে। ওই মাসের ১৩ তারিখে থাইল্যান্ডে এই ভাইরাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন কোভিড-১৯ কেবল উহান বা চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তা ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নড়েচড়ে বসেন তারা।
    সময় এগোতে থাকে। চীনের উহান শহরে হুহু করে বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই খবর টিভি, খবরের কাগজের মাধ্যমে আমাদের দেশেও পৌঁছতো শুরু করে। সেই সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানতে পারি চীনের বাইরে আরও বেশকিছু দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও এই ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয়। সেই মতো কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার নানাবিধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়। বিদেফেরৎ যাত্রীদের থার্মাল টেস্টি করা, কোনো উপসর্গ থাকলে টেস্ট করা, আইসোলেশান, কোয়ারেন্টাইন প্রভৃতি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নতুন বছরের প্রথম মাসের শেষে দেখা যায় চীন সহ ২০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। প্রথম প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ, চীনের হুহু করে আক্রান্ত হওয়া আর মৃত্যু মিছিল দেখে আমরা তেমন গা না করলেও করোনা ক্রমশ বিস্তার আমাদের মনেও একটু একটু করে দাগ ফেলতে শুর করে।
    ভারতবর্ষে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩০ জানুয়ারি। চীনের উহান শহর ফেরৎ কেরলের এক ছাত্রের শরীরে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। তিনজনই কেরালার বাসিন্দা। চীনের ঊহান শহর থেকে তারা দেশে ফিরেছিল। ২ মার্চ কেরলের বাইরে দিল্লি ও তেলেঙ্গানায় একজন করে করোণা সংক্রমণ ধরা পড়ে। অর্থাৎ আমাদের দেশে করেনার এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বিস্তার শুরু হয়। এই সময় ভারতে করোনা সংক্রমণের হার তেমন দ্রুত না হলেও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত এবং ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনা। তবুও ব্যাপারটা আমাদেরকে সেভাবে ভাবিয়েছিল বলে মনে হয় না। আমরা সাধারণ মানুষেরা ভেবেছিলাম আমাদের দেশে হয়তো এর প্রভাব তেমন মারাত্মক হবে না। একটা তথ্য ঘোরাফেরা করছিল। এই ভাইরাস বেশি গরমে বাঁচতে পারে না। এমনিতেই যে কোনো ভাইরাস গরমে কাবু হয়ে যায়। এমনকি দূরদর্শনে কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মন্তব্য শুনছিলাম ভারতে এই সময় যা গরম তাতে করে এই ভাইরাস সেভাবে আক্রান্ত করতে পারবে না। এই ব্যাপারটাও আমাদেরকে কিছুটা আস্বস্ত করেছিল। অথচ এই সময় চীনে প্রায় ৫০০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, মারা গেছে চোদ্দশ-এর কাছাকাছি মানুষ। ফেব্রুয়ারির শেষে চীনে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০,০০০ আর মৃত্যু ২,০০০ ছাড়িয়ে যায়। চীনের বাইরেও আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে করোনার মারাত্মক প্রভাব দেখা যেতে শুরু করে। তখনও এই ভাইরাস আমাদের মনে সেভাবে বোধহয় ভয়ের ছাপ ফেলতে পারেনি। তবে এই নিয়ে আমাদের দেশে সচেতনতা জোরদার হয়।
    করোনা ভাইরাসের কোনো টীকা এখনও আবিস্কার হয়নি। তাই এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায় হল এই ভাইরাসকে কোনোভাবে শরীরের মধ্যে আসতে না দেওয়া। এই রোগের প্রধান উপসর্গগুলির কথা আগে বলেছি। হু-এর নির্দেশনুক্রমে এই ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু নির্দেশাবলী মানার কথা বলা হয়। ঘন ঘন সাবান দিয়ে ভালো করে কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাত ধোওয়া, মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হাঁচি-কাশির সময় কনুই দিয়ে মুখ ঢাকা, জময়েত এড়িয়ে চলা প্রভৃতি। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলি ওই ফেব্রুয়ারির শেষদিকেও করোনা নিয়ে আমরা সেভাবে ভাবিনি, ভয় পাইনি। আমরা রোজকার কাজকর্ম যেমন করি সেভাবেই করে গেছি। এমনকি ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে মার্চ শুরু, করোনা যখন বিশ্বে ত্রাস হিসেবে দেখা দিতে শুরু করেছে, তখনও আমরা আনন্দ-উৎসব থেকে বিরত থাকিনি। যতটা না সচেতনতার উপায়গুলো মেনেছি তার থেকে বেশি একে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেছি।
    যাই হোক, মার্চের ৯ তারিখের হিসেবে দেখা যায় ভারতবর্ষের ১১ টি রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪ জন যাদের মধ্যে ১৬ জন বিদেশী। দিন পাঁচেকের মধ্যে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৪ তে। দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১২ মার্চ। মারা যান সৌদি আরব থেকে ফেরা কর্ণাটকের ৭৬ বছর বয়সি এক বৃদ্ধ। দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটনা ঘটে দিল্লিতে। ৬৮ বছরের এক বৃদ্ধা মারা যান। তখনও আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কোনো করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। ইতিমধ্যে ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই ভাইরাসের আক্রমণকে বিশ্ব মহামারীর আখ্যা দেয়। এই প্রথম আমরা সাধারণ নাগরিকেরা যারা কমবেশি একটু খবরাখবরের সঙ্গে যুক্ত বোধহয় একটু একটু করে ভয় পেতে শুরু করি।
    করোনা নিয়ে সবাইকে সচেতন করতে নানারকম ব্যবস্থা নেয় বিভিন্ন রাজ্য সরকার। আমাদের রাজ্যে প্রচার, বোঝানোর পাশাপাশি প্রচারপত্র বিলি প্রভৃতি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সরকারি নির্দেশে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বোঝানোর জন্য সেমিনারের আয়োজন হয়। এককথায় করোনা নিয়ে আমরাও একটু গুরুত্ব দিতে শুরু করি। ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষার কথা ভেবে ইতিমধ্যে বেশকিছু বেসরকারি বিদ্যালয় স্কুল বন্ধের ঘোষণা করে। রাজ্য সরকার ১৪ তারিখ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রথমে ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্কুল বন্ধের ঘোষণা করে। পরে সেটা বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে সরকারি নির্দেশ মেনে স্কুল থেকে তাদের আভিভাবকের হাতে চাল আলু তুলে দেওয়া হয়। ২২ মার্চ দেশের প্রধানমন্ত্রী একদিনের জন্য জনতা কার্ফু ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে তিনি জনসাধারণের কাছে অনুরোধ করেন করোনা যুদ্ধে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছে তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে বিকেল পাঁচটার সময় শাঁখ-ঘন্টা বাজাতে এবং হাততালি দিতে। এই দিনের হিসেবে দেখা যায় ভারতের ২৩ টি রাজ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৬০ (৪১ জন বিদেশি) এবং মারা যাওয়ার সংখ্যা ৭। পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা ৪।
    পশ্চিমবঙ্গে প্রথম আক্রান্তের ঘটে ১৮ মার্চ। লন্ডন ফেরৎ রাজ্যের এক আমলার পুত্র প্রথম আক্রান্ত হয়। তার বেশকিছু হঠকারি কাজে গোটা রাজ্য জুড়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। ইতিমধ্যে অন্যান্য বোর্ডের সমস্ত পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জয়েন্ট, আইআইটি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। ২১ মার্চ রাজ্য সরকার উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়। ২৩ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করেন। প্রথমে পৌর এলাকার মধ্যে সেটা চালু বলে ঘোষণা করা হলেও পরে তা প্রায় সমগ্র রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য হয়। মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখতে রাস্তায় নামে পুলিশ। বোঝাবুঝিতে কাজ না হলে পুলিশ শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে।
    ২৪ মার্চ দেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২১ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেন। এইরকম অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে প্রথম। একমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসে ছাড় ছাড়া সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। ভ্যান, টোটো থেকে শুরু বাস, ট্রেন, মেট্রো সমস্তরকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২৫ তারিখ থেকে আর্ন্তজাতিক উড়ানের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পরে আন্তঃরাজ্য উড়ান চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্তব্ধ হয়ে যায় জীবন। সম্পূর্ণ অচেনা এক আতঙ্কময় পরিবেশ। চেনা জীবন নিজেদের কাছেই কেমন অচেনা হয়ে ওঠে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমাদের দেশে চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলির তুলনায় খুব কম। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ শুরু করে চিকিৎসা পরিষেবা বৃদ্ধির দিকে। নতুন নতুন করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র, আইসোলেশান সেন্টার ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টার গড়ে ওঠে। আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেড়ে গেলে যাতে মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যায় তার জন্য বেশকিছু ট্রেনের কামরাকে প্রস্তুত করে লক্ষাধিক করোনা চিকিৎসা সেন্টার গড়ে তোলা হয়। আরও নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকে। মার্চের শেষে গিয়ে ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৯৭। মাত্র একদিন পর অর্থাৎ এপ্রিলের ১ তারিখ সংখ্যাটি একলাফে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮৩৪ জন। পরেরদিন ২০০-এর কিছু বেশি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু তারপর থেকে প্রতিদিন ৫০০-এর উপরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৭৮৯ জন। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১০০। পরেরদিন (৮ এপ্রিল) ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর ৯ এপ্রিল, করোনা সংক্রমণের ১০০তম দিনে ভারতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৮৬৫ জন, মৃত ১৬৯ জন। এদের মধ্যে সেরে ওঠার সংখ্যা ৪৭৭। সবেচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মহারাষ্ট্রে (৯৪৬) তার পরে রয়েছে তামিলনাড়ু (৭০৯)।
    আগেই বলেছি পশ্চিমবঙ্গে প্রথম করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। মার্চের শেষে এখানে করোণা আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ ছাড়িয়ে যায়। এপ্রিলের ২ তারিখে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৫৩, মৃত ৩। আর এর ঠিক সাতদিন পর অর্থাৎ করোনার শততম দিনে এই রাজ্যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০৩। এর মধ্যে সেরে উঠেছেন ১৬ জন এবং মৃত ৫।
    করোনার শততম দিনে যদি বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে যে ছবি উঠে আসে তা খুব ভয়াবহ। সারা বিশ্ব জুড়ে বিপর্যয় তো বটেই সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক আর মৃত্যুর একটা শীতল পরিবেশ। গোটা বিশ্ব জুড়ে হাহাকার। বিশ্বের ২০৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। উন্নত দেশগুলির অসহায় অবস্থা দেখে শিউরে উঠতে হয়। এই দিন সারা দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৫,৮৯,৩৭২ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯৪,৯৫১ জন এবং সেরে উঠেছেন ৩,৫৩,১৫১ জন। আক্রান্তের নিরিখে সবাইকে ছাপিয়ে গেছে আমেরিকা (৪,৬০,০২৯)। ইতালি ছাড়িয়ে যা বর্তমানে করোনার ভরকেন্দ্র। এরপর রয়েছে যথাক্রমে স্পেন (১,৫২,৪৪৬), ইতালি (১,৪৩,৬২৬), ফ্রান্স (১,১৭,৭৪৯), জার্মানি (১,১৫,৫২৩) প্রভৃতি দেশ। মৃত্যুর হিসেবে সবার ওপরে ইতালি (১৮,২৭৯), তারপর আমেরিকা (১৬,৩৭৪) ও স্পেন (১৫,২৩৮)।
    করোণা যে কতটা ভয়ংকর তা আর বুঝতে বাকি নেই কারও। লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। মৃত্যুর যেন মিছিল লেগে গেছে বিশ্ব জুড়ে। এর শেষ কবে এবং কোথায় জানা নেই। বিজ্ঞানীরা দিনরাত এক করে লেগে রয়েছেন এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিস্কার করার জন্য। এরমধ্যে কিছুটা সাফল্যের খবর এলেও এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু হয়নি। আর যদি বিজ্ঞানীরা সফলও হন তাহলেও সেই প্রতিষেধক বাজারে আসতেও অনেক সময় লাগবে। তার আগে করোনা পৃথিবীতে কতখানি বিপর্যয় ঘটাবে তা এখনই অনুমান করা সম্ভব নয়। করোনা ঠেকাতে এখন একটাই উপায় সরকারি সমস্ত নির্দেশ ও স্বাস্থবিধি মেনে চলা। যার মধ্যে অন্যতম হল সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বা ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং বজায় রাখা।
    তবে আশার খবর এই যে করোনা ভাইরাসের আঁতুড়ঘর চীন ইতিমধ্যে ভাইরাস মোকাবিলায় প্রায় সফল। সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষে পৌঁছোয়নি আর মৃত্যুও সাড়ে তিনহাজারের নীচে। উহান, যেখানে এই ভাইরাসের জন্ম ও প্রকোপ, ৭৬ দিনের লকডাউনের পর তা আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে আক্রান্তের বিক্ষিপ্ত খবর এলেও চীনের জীবনযাত্রা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আশাকরি এইভাবেই আমাদের দেশ তথা গোটা বিশ্বও হয়তো একদিন করোনার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে। আমরা সেই দিনের দিকে তাকিয়ে ।
    তবে শেষে যে কথা বলার, সামান্য একটি অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস মাত্র একশো দিনেই বুঝিয়ে দিয়েছে কী ভয়ংকর তার ক্ষমতা। তার প্রকোপ থেকে যবেই আমরা মুক্তি পাই না কেন, তারপর যে সময় আসছে তা মোটেও সুখকর নয়। এই মহামারী সারা বিশ্বে যে আর্থিক বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে তার থেকে মুক্তি পেতে কত সময় লাগবে সেটা আগামী সময় বলবে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় একটা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা।
    যাই হোক, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের একমাত্র প্রার্থনা, করোনার এই নিষ্ঠুর গ্রাস থেকে মুক্ত হোক গোটা পৃথিবী, জীবন হোক সুরক্ষিত। কেননা জীবনের থেকে সুন্দর আর কিছু নয়। দেখা যাক কী অপেক্ষা করে আছে আগামীর জন্য। তবে আমরা আলোর প্রত্যাশী। অন্যান্য অনেক বিপর্যয়ের মতো এই বিপর্যয়ও আমরা ঠিক কাঠিয়ে উঠব।
    আমরা করব জয় । আমরা করব জয় নিশ্চয়ই।

No comments:

Post a Comment