খাঁচা ভাঙার
গল্প...

সমাজ থেকে জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথা অনেকদিন আগেই উঠে গেছে। কিন্তু
নানাভাবে সমাজে যে একটা সূক্ষ্ম কিন্তু স্পষ্ট বিভাজন রেখা রয়েছে সেটা আমরা
অস্বীকার করতে পারি না। বিশেষ করে কাজের নিরিখে একটা ভেদাভেদ রয়েছে। সমাজে যারা
খুব ছোটোখাটো কাজ করে তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, নীচু চোখে দেখার একটা
প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে। সাফাইকর্মীদের ব্যাপারে আমাদের অনেকের মনোভাব সেরকমই।
শহর, আধা-শহর এলাকায় সাফাইকর্মীরা প্রতিদিন সাফাইয়ের কাজ করে। বাড় বাড়ি থেকে
আবর্জনা নিয়ে যায়। রাস্তার আবর্জনা পরিস্কার করে। এইসব সাফাই কর্মীদের আমরা
অনেকটাই ‘নোংরা’ বলে
ভাবি। তাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বটা কেবল ফিজিক্যাল নয়, বেশিরভাটা মনের। আমরা তাদের
তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি, অনেকটা নীচ চোখে দেখি। অথচ আমরা এটা ভেবে দেখি না, যে
আবর্জনা তারা সাফাই করছে সেই আবর্জনা আমরাই সৃষ্টি করছি। এটাও ভুলে যাই এটা করে
তারা আমাদের বাড়ি তথা এলাকার পরিবেশ সুন্দর, সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর রাখার কাজ করছে।
যাই হোক, আসল কথায় আসি। আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের কাঁটা ক্রমশ চেপে
বসছে। করোনার মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে প্রথমে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন
ঘোষণা করেন। পরে যা বেড়ে হয়েছে ৩মে পর্যন্ত। লকডাউনের কারণে মানুষ গৃহবন্দী।
নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বেরোয় না। তবে চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাকর্মী,
পুলিশ, প্রশাসনের লোকেরা কিন্তু ঘরে বসে নেই। সে সুযোগও তাদের নেই। বিশ্বব্যাপী
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ময়দানে নেমে যুদ্ধ করছেন তারা। তাদের মতো সাফাইকর্মীদেরও ঘরে
বসে থাকার উপায় নেই। এই যুদ্ধে তারাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
করোনা অতি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস কিন্তু অত্যন্ত ভয়ানক। তার হাত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য যে সব স্বাস্থবিধি মানার দরকার তার মধ্যে অন্যতম হল পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা।
শুধু নিজে বা নিজের বাড়ি নয়, পুরো এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার, জীবানুমুক্ত
করা দরকার। তাই ভাইরাসের ভয়ে আমরা গৃহবন্দী হলেও তাদের কিন্তু প্রতিদিন কাজ করতে
হচ্ছে। এ-কেবল পেশাগত ডিউটি পালন নয়। তার থেকে অনেক বড়ো কাজ করছেন তারা। এলাকা
পরিস্কার রাখার মাধ্যমে তারা জীবানুকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াসে সামিল হয়েছেন। তাই
আজ তারা কেবল সাফাইকর্মী নন, করোনা যুদ্ধের তারাও এক-একজন সৈনিক।
সাফাইকর্মীরা এখন কেবল সাফাইয়ের কাজ করছেন না। পাশাপাশি মানুষকে
বোঝাচ্ছেন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে, সচেতন থাকতে। ঘরের বাইরে অকারণে না বেরোতে।
মানুষকে করোণা নিয়ে সচেতন করতে প্রশাসনিক স্তরে নানা উদ্যোগ আমরা দেখছি। ইতিমধ্যে
আমাদের নজর কেড়েছে পুলিশের মিউজিক থেরাপি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশকর্মীরা
গান গেয়ে সাধারাণ মানুষদের মধ্যে যেমন করোনা সচেতনতার বার্তা দিচ্ছেন তেমনি করে
তাদের একঘেঁয়েমি কাটানোর চেষ্টা করছেন, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা
করছেন। অর্থাৎ পুলিশও অনেকটা চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করছেন। ঠিক একই প্রয়াস দেখা
গেল সাফাই কর্মীদের মধ্যেও। আমাদের রাজ্যের এক পৌর এলাকায় গত ৮ এপ্রিল ওয়ার্ডের
পৌরপিতার নেতৃত্বে একশজন সাফাইকর্মী গান গেয়ে মানুষদের করোনা সচেতনতার বার্তা
দেন। গানটা এইরকম---“মানুষ করোনার জন্য, মানুষ বাঁচার জন্য, একটুখানি ঘরের ভিতর,
থাকতে সে কি পারে না।” উল্লেখ্য এই গানটি লিখেছেন একজন সাফাইকর্মী। সত্যি
সাফাইকর্মীদের এই মহতী উদ্যোগকে কুর্ণিশ জানাতে হয়। তাদের এই প্রয়াশ বহু মানুষের
মন কেড়ে নিয়েছে।
তবে গানটা ফ্যাক্টর নয়। মানুষ সত্যি সত্যি বুঝতে পারছে এই ভয়ংকর সংকটময়
পরিস্থিতিতে ওই সাফাইকর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে কাজ করে চলেছেন তার
তুলনা হয় না। তাই মুখে প্রকাশ না করলেও অনেকেই হয়তো মনে মনে উপলব্ধি করতে পারছেন,
যে মানুষগুলোকে এতদিন তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছেন, সেটা বোধহয় ঠিক হয়নি।
মনে মনে তাদের এখন কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় আমরা দেখতে পাচ্ছি
সাফাইকর্মীদের এই কাজকে নানাভাবে সম্মান জানাচ্ছেন মানুষ। মিডিয়ার দৌলতে কয়েকটি
এমন খবর আমরা জানতেও পেরেছি।

“Pleased to see the
applause & affection showered by people of Nabha on the sanitation worker.
It’s heartening to note how adversity is bringing out the intrinsic goodness in
all of us. Let’s keep it up & cheer our frontline warriors in this War
Against #Covid19.”

এইসব ছোটো ছোটো ঘটনাগুলো আমাদের মনকে নাড়িয়ে দেয়। করোনার
অতিমারীতে গোটা পৃথিবীটাই কার্যত আইসিইউ তে চলে গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে মানুষের
জীবন। করোনা মানব সভ্যতাকে চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অনেক কিছু
হারিয়েছি আমরা, আগামী দিনে হারাতে হবে আরও অনেক কিছু। কিন্তু এই বিপর্যয়ের
তাৎক্ষণিক কিছু ভালো ফলও দেখা যাচ্ছে। একটু আধটু হলেও আমরা তা অনুধাবন করতে
পারছি। যার মধ্যে অন্যতম হল মানুষের মনের উদারতার প্রকাশ। সংকীর্ণতার খাঁচা ভেঙে
মানুষের এই যে বেরিয়ে আসা, এতো আমাদের সত্তার উত্তরণ, মহতের দিকে যাত্রা। জীবন
এমন সংকটের মুখে না এসে দাঁড়ালে আমারা কি মনের সংকীর্ণতার খাঁচা ভেঙে বেরোতে
পারতাম?
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘খাঁচা’ গল্পের নায়ক অর্কপ্রভ কিন্তু খাঁচা
ভেঙে বেরোতে পারেনি। পরিস্থিতি তাকে কিছুটা উদ্বুদ্ধ করেছিল খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে
আসার কিন্তু শেষমেষ নিজের খাঁচার মধ্যে আটকে যায় সে। দিবাকরের সেবা শুশ্রূষায় তার জ্ঞান
ফিরে আসে। জ্ঞান ফেরার পর সে দ্রুত বাড়ি ফিরে যায়। তার মনোভাব কিন্তু থেকে যায়
আগের মতোই। এই ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখিকা আমাদের দেখাতে চেয়েছেন তথাকথিত উচ্চ
শ্রেণির মানুষের খাঁচাবদ্ধ জীবন। বুঝিয়ে দিয়েছেন একটা গণ্ডীর মধ্যে তাদের যত
আস্ফালন। সেই পরিচিত অভ্যস্ত জগতের বাইরে তারা অত্যন্ত অসহায় ও দুর্বল।
আমরাও আমাদের পরিচিত, অভ্যস্ত জগত থেকে এখন দূরে। এমন অচেনা জীবন-প্রবাহে সত্যিই আমরা খুব অসহায়
বোধ করছি। একরাশ আতঙ্ক নিয়ে অজানা এক অভিষ্যেতর দিকে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে
যেতে যেতে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছি। কথায় আছে ডুবন্ত মানুষ বাঁচার জন্য
খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে। তেমনি করেই কি আমাদের দুর্বল মন জীবনের আকুল প্রত্যাশায়
সেইসব মানুষগুলোকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতে চাইছে কিংবা আপন ভাবতে চাইছে যারা এই
জীবন-প্রবাহকে টিকিয়ে রাখার জন্য সামনে থেকে লড়াই করে চলেছেন? একি তাদের প্রতি
অন্তরের শ্রদ্ধা ও সম্মাননা জ্ঞাপন নাকি আমাদের দুর্বল মনের অসহায়ত্ব আর তাৎক্ষণিক
আবেগের বহিঃপ্রকাশ? সত্যিই কি আমরা মনের সংকীর্ণতার খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছি?
একদিন যখন করোনার থেকে মুক্ত হব আমরা, সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে তখনও
আমাদের এই মনটা বেঁচে থাকবে তো? বেঁচে থাকবে তো ওইসব মানুষদের প্রতি আমাদের বদলে
যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গী? নাকি, আবারও আমরা নিজেদের ঢুকিয়ে নেব আপন আপন খাঁচার মধ্যে? এই
প্রশ্নের জবাব দেবে সময়।
তবে শেষ করার আগে একটা কথা বলি। মারণ ভাইরাস করোনা আমাদের জীবন
থেকে যেমন কেড়ে নিচ্ছে অনেক কিছু, সভ্যতার অগ্রগতির ধারাকে পিছিয়ে দিচ্ছে কয়েক ধাপ; পাশাপাশি আমাদের দিয়ে যাচ্ছে
অনেক কিছু। পৃথিবীর বুকে জীবনের অস্তিত্বের ধারাকে সুদূর প্রসারী করার, জীবন
ছন্দকে স্বাভাবিক রাখার প্রকৃত পথের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে সে। এখন দেখার আমরা এর
থেকে কতটুকু শিক্ষা নিতে পারি। অন্ধকার যত গাঢ়ই হোক না কেন, তার মধ্যে কোথাও না
কোথাও থাকে কিছু আলোর বার্তা। করোনার মধ্যেও তা অবশ্যই আছে। সেসব বিশদে না গিয়ে
একটা কথা বলি, করোনা মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে অপরের জন্য ভাবনার কথা। এটাই তো
একটা বিরাট ব্যাপার।
এইসব সাফাইকর্মী থেকে শুরু করে যারা সমাজের ছোটোখাটো কাজকর্ম করে
তাদের আমরা খুব একটা ভালো চোখে দেখি না। কিন্তু সমাজে তাদেরও বিরাট ভূমিকা
রয়েছে। যেটা স্বাভাবিক সময়ে আমরা বুঝতে পারি না কিংবা বুঝতে চাই না। তাই এদের
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয়, মানুষের চোখে দেখা উচিৎ। এদের জন্য শঙ্খধ্বনি কিংবা
পুষ্পবৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দরকার নেই টাকার মালার। এদের প্রতি একটু ভালো মনোভাব
দেখানোই হবে এদের প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, এদের কাজের প্রতি মর্যাদা প্রদান। করোনা
পরবর্তী বিশ্বে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে সেই বোধটা জাগিয়ে রাখতে পারি সেটাই হবে
আমাদের খাঁচাভাঙর গল্প, জীবনের উত্তরণের কাহিনি। আর তা যদি না হয়, তাহলে আমরা ওই
গল্পের অর্কপ্রভর মতো হয়ে যাব। তবে আমরা আশা করব খাঁচা ভেঙে এই যে বেরিয়ে আসা তা
আমাদের সত্য ও বাস্তবতার আলোক উপলব্ধির পথে চালিত করবে।
ভয়ংকর ভাইরাস আমাদের আজ আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জীবনের
আয়না। যে আয়নার সামনে দাঁড়ালে কেবল নিজের প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে না। দেখা যায় আরও
অসংখ্য প্রতিবিম্ব। কিছু স্পষ্ট, কিছু অস্পষ্ট। আর সমস্ত প্রতিবিম্বগুলো এক হয়ে
মিলেমিশে একটা ‘আমি’ দাঁড়িয়ে থাকে অসংখ্য ‘আমি’র মধ্যে। করোনা-উত্তর বিশ্বে জীবনকে
বাঁচতে হবে নতুন ভাবনায়। যেখানে আমাদের জন্য রয়েছে অত্মবিশ্লেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ
অধ্যায়।
১৯ এপ্রিল, ২০২০।
No comments:
Post a Comment