Saturday, April 18, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-১১


ভুলেছে নিজের ঘর...

সামনে কাগজের প্লেটে সম্ভবত ভাত। মগ্ন হয়ে তিনি সবজির প্যাকেটটা খুলছিলেন। মনে হয় তার বাঁধনটা একটু জোর হয়ে গিয়েছিল। সহসা মুখ তুলে একবার তাকিয়ে আবারও মুখটা নামিয়ে নিলেন। কোনো চিত্র-সাংবাদিকের লেন্স তার দিকে তাক করা। বুঝতে পারেননি। আরও একবার মুখ তুলে তাকালেন। মৃদু হাসলেন। বড়ো সরল, নিষ্পাপ সে হাসি। ভোরের স্নিগ্ধ শিশিরের মতো। রোদে পুড়ে যাওয়া তামাটে মুখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি। লাজুক দৃষ্টি ছুঁড়ে আবারও মন দিলেন সবজিতে।
    ক্যামেরা ঘুরছে একদিক থেকে আরেক দিকে। গ্রীষ্মের দুপুর। সূর্যের প্রখর তেজ। কোথাও সামান্যতম ছায়া নেই। সারি সারি কয়েকটি দোকান। সবগুলির সাটার বন্ধ। সেই সব দোকানের সামনে সামান্য যে একফালি চাতাল তাতে পেছনটা কোনোরকম ঠেকিয়ে বসে আছে কয়েকজন। কেউ পা ছড়িয়ে দিয়ে ওই চাতালের ওপর কাগজের প্লেট রেখে খাচ্ছেন। কেউ বা কোলের ওপর প্লেট তুলে নিয়েছেন। বেশিরভাগেরই মুখ রোদে পুড়ে ঝলসে গেছে। অথচ কারও মুখ দেখে বোঝার ওপর নেই তারা ক্লান্ত কিংবা বিধ্বস্ত। উল্টে অদ্ভুত এক তৃপ্তি সকলের চোখে-মুখে।
    ক্যামেরা ঘুরছে। একজনকে দেখা গেল ওই প্রখর রোদ্রে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে সামনে একটা ভাঙাচোরা ভ্যানের ওপর প্লেট রেখে ব্যস্তভাবে খাচ্ছেন। কেউ আবার রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে এক হাতে প্লেট ধরে খাচ্ছেন। বিবরণ শুনে সহজেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চির পরিচিত রাস্তার চাল চুলোহীন মানুষদের কথা। কিন্তু এরা তা নন। এদের কেউ আধা সামরকি বাহিনির জওয়ান তো কেউ পুলিশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছবিটির ভিউজ হয় প্রায় ২৫ লক্ষ। ছবিটি যে কোনো মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতে বাধ্য। এদেরও বাড়ি আছে। থাকার জায়গা আছে। বসে খাওয়ার জায়গাও আছে। কিন্তু আজ বসে আয়েশ করে খাওয়ার সুযোগ কিংবা সময় কোনোটাই নেই তাদের। রৌদ্র-দগ্ধ দুপুরে, গায়ে ভারী ইউনিফরম চাপিয়ে কোনোরকমে দুটি নাকে-মুখে গুঁজে নিচ্ছেন। খাওয়া হয়ে গেলে মুখ ধুয়েই পাশে রাখা লাঠিটা নিয়ে রৌদ্র মাথায় করে আবারও যে যার কাজে লেগে পড়বেন। ডিউটি করছেন এরা। কেবল ডিউটি করছেন এরা? না, এটাকে ডিউটি না বলে ত্যাগ বলাই ঠিক হবে। এতো একটি ছবি মাত্র। এরকম কত শত সহস্র ছবি ছড়িয়ে আছে সারা দেশে তার সঠিক হিসেব আমরা পাবো না কোনোদিন। এদের বর্ণনা করতে গেলে শব্দের ভান্ডারেও হাহাকার জাগে। কী বলব এদের---জাতির যোদ্ধা নাকি মানবতার ঈশ্বর? করোনা মানুষকে গৃহবন্দী করে দিয়েছে। আর এইসব মানুষেরা নিজের ঘর ভুলে এখন পথকেই আপন করে নিয়েছেন। মৃত্যুর আতঙ্কের অন্ধকার থেকে মানুষকে বাঁচার আলোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, ভরসা জোগাচ্ছেন। কোটি কোটি ভারতবাসী তাই আজ এদের কৃতজ্ঞচিত্তে অভিবাদন জানাচ্ছে।      
    পুলিশ মানে ভয়। কেন জানি না, মনের মধ্যে এরকমই একটা ধারনা আমার আছে। তখন ক্লাস ফাইভে পড়িএকদিন স্কুল ফেরৎ দেখি গ্রামের একটি লোককে পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেলোকটি খুব ভালো। পরে জেনেছি তার পাশের বাড়ির লোক জায়গার গণ্ডগোল নিয়ে তার নামে থানয় মিথ্যে অভিযোগ করেছিল। রাস্তায় যেতে যেতে লোকটি হাউহাউ করে কাঁদছিল। তার বাড়ির লোকেরাও পেছনে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছিল আর পুলিশকে বলছিল ছেড়ে দিতে। কিন্তু পুলিশের চোখ-মুখ কঠিন, ভালেশহীন। গ্রামের লোকের এদিক ওদিক ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। ভয়ে সবাই ফিসফাস করে কথা বলছিল। কিন্তু কেউ পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। সেদিনের ওই ঘটনা আর পুলিশের কঠিন চোখ-মুখ দেখে পুলিশ সম্পর্কে মনের মধ্যে যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল তা অনেকদিন কাটাতে পারিনি।
    পুলিশকে নিয়ে এই ভয় অনেকেরই আছে। পাশাপাশি পুলিশকে অনেকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে। অনেক ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপও করে। তাদের অনেক খারাপ দিকের কথাও বলে। খারাপ কোথায় বা নেই? ভলো-খারাপ সব জায়গায় আছে। সেসব বিতর্কে না গিয়ে আজ বরং কিছু আলোর কথা বলি।
    বিশ্ব জুড়ে করোনার দাপট ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের দেশে প্রথম করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখ। তরপর থেকে করোনার প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। করোণার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন সারা দেশে। পরে তা বেড়ে হয়েছে ৩ মে পর্যন্ত। নিত্যাবশ্যকীয় কিছু জিনিসে ছাড় ছাড়া বাকি সব বন্ধ। এমনকি সমস্ত রকম পরিবহন ব্যবস্থাও বন্ধ। মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না বেরোতে।    
    লকডাউন যাতে ঠিকঠাক হয় তার জন্য প্রধান ভূমিকা নেয় পুলিশ। বিশেষ করে একেবারে শুরুর দিকে পুলিশ ছিল বেশ কড়া বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজ না হলে শক্ত হাতে লাঠি ধরে। এর ফলে অন্যায়কারী যেমন মার খেয়েছে তেমনি কোথাও দোষ না করেও মার জুটেছে। এত মানুষ। ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা যদি সমস্ত নির্দেশ ঠিকঠাক পালন করতাম তাহলে হয়তো এই ভুল কম হত। পুলিশকে এত কড়া হতে হত না। দেখা গেছে একজনের দোষের কারণে নির্দোষ ব্যক্তিও সাজা পেয়েছেন। পুলিশের সেই রুদ্রমূর্তি দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন কতগুলি বার্তা ছড়িয়ে পড়ে---‘টসে জিতে ব্যাটিং করছে পুলিশ, গেইল এর রেকর্ড ভাঙার চার ছক্কার মার চলছে’; ‘বাড়িতেই থাকুন পুলিশ টসে জিতে ব্যাটিং করছে। আর প্রচুর ৪/৬ মারছে’; ‘সাবধান টসে জিতে ব্যাটিং করছে পুলিশ মামুরা’; ‘সাবধান টসে জিতে পুলিশ মামারা ব্যাটিং-এ। ভাবছিলাম টেষ্ট খেলবে কিন্তু পুরাই টি-টুয়ান্টির মতো মারা শুরু করছে’; ‘করোনা লীগে টসে জিতে ব্যাটিং করতে নেমেছে পুলিশ। পাশাপাশি টসে হেরে গিয়ে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমজনতা।’; ‘…বাড়িতে থাকুন.. টসে জিতে পুলিশ কিন্তু ব্যাটিং করছে তাও power play তে! সব বলেই free hit.’
    এইসব মেসেজগুলো বেশ মজাদার হলেও এর মধ্যে অনেকটাই ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ জড়িত। আর পুলিশকে নিয়ে ব্যাঙ্গের ব্যাপারটা নতুন কোনো কথা নয়। পুলিশরা নিজেরাও সেটা ভালো করেই জানেন। যাই হোক, লক-ডাউনের শুরুর দিনগুলিতে অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি পুলিশের রুদ্র মূর্তি। কিন্তু কেন তাদের এমন মূর্তি ধারন করতে হল? আগেই বলেছি এর দায় কিন্তু অনেকটা আমাদেরই। তবে একথাও অস্বীকার করা যাবে না, প্রথম কদিন পুলিশের ওই রুদ্রমূর্তি দেখা গিয়েছিল বলে বহু মানুষ রাস্তায় বেরোতে সাহস পায়নি। এমনকি অনেকে ছোটোখাটো প্রয়োজন থাকা সত্বেও ঘরেই থেকেছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউন কতখানি জরুরি তা ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি। তাই পুলিশের ওই কঠোর প্রয়াসের মধ্যে আসলে একটা ভালো বার্তাই ছিল। কেননা ভালো কথায় বোঝার মতো মানুষ অনেকেই নেই। বিশ্বের উন্নত দেশেগুলির অসহায় অবস্থা, মৃত্যু মিছিল দেখেও অনেক মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনতার অভাব। একটা ডোন্ট কেয়ার মনোভাব। এসবই পুলিশকে বাধ্য করে কঠোর হতে। কেননা তখন হাতে আর তেমন বিকল্প পথ ছিল না।
    তবে এটাও ঠিক প্রথমদিকে পুলিশের এমন কিছু কাজ নজরে এসেছে যা মেনে নেওয়া যায় না। কোথাও মারের ব্যাপারটা অমানবিক হয়েছে। কোথাও দেখা গেছে যে সব কাজ বা পরিষেবায় ছাড় দেওয়া হয়েছে, পুলিশ সেখানেও বাধা দিয়েছে। রাস্তার পাশে কিছু কাঁচা সবজি নিয়ে বসেছে এক গরিব ব্যবসায়ী। পুলিশের মার খেয়ে তাকে প্রাণ হাতে করে ছুটতে দেখা আর ছোটো ছোটো বাঁধাকপিগুলোকে লাঠিধারি পুলিশের ফুটবলের মতো করে লাথি মেরে রাস্তায় ছুঁড়ে দেওয়া---এই দৃশ্য অত্যন্ত অমানবিক ও নিন্দদনীয়। মানছি যারা ওই এলাকার দায়িত্বে ছিলেন তাদের কাছে হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা পরিস্কার ছিল না কিন্তু মানবিক বোধটা থাকা জরুরি ছিল। লকডাউনের বাজারে যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেখানে সেগুলোকে এভাবে নষ্ট না করে সেই গরিব ব্যবসায়ীকে ভালো কথায় তুলে দেওয়া যেতে পারত। এইরকম বিক্ষিপ্ত কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের অতি সক্রিয়তা দেখা গেছে যেটা সমর্থনযোগ্য নয়।
    যাই হোক, এরপর আমরা দেখি পুলিশের বদলে যাওয়া ছবি। হঠাৎ করে যেন শান্ত হয়ে যায় পুলিশ আর পুলিশ নরম হতেই দেখা গেল রাস্তায়, বাজারে মানুষের ঢল। লকডাউন যেন একটা উৎসব। আর তা দেখতে রাস্তায় নেমে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। এসব দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবারও ক্রিকেটীয় পোস্ট হয়েছে। ‘পুলিশের ব্যাটিং শেষ, জনতা ফিল্ডিং করতে দলে দলে মাঠে নেমে পড়েছে।’ কথাটা মজার শোনালেও বাস্তবে দেখা যায় করোনাকে পরোয়া না করে তথাকথিত দুঃসাহসী মানুষেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন কোনো প্রয়োজন ছাড়াই। তাদের এমন অবিবেচকের মতো কাজ দেখে, অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে কাতর আবেদন করেছে পুলিশকে শক্ত হওয়ার জন্য। এটা ঠিক পিঠে লাঠির বাড়ি পড়লে তার ব্যাথা একদিন কমে যাবে কিন্তু যদি একজনও করোনা আক্রান্ত হয়ে যায়, শুধু তার তো ক্ষতি হবে না, তার পরিবার সহ সমাজের কত কত মানুষের জীবন যে প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়াবে তার ইয়ত্তা নেই। যাই হোক, এরপর আমরা পুলিশকে আর আগের সেই মুডে দেখতে পাই না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা হাল ছেড়ে দেন। বরং পুলিশকে আমরা দেখি একেবারে অন্যরকম ভাবে।
    লকডাউনে মানুষের বাইরে যাওয়া আটকাতে গ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ মোতায়েন হয়। গ্রীষ্মের এই প্রখর দাবদাহে আমরা যখন গৃহবন্দী তখন দেখা যায় এক জায়গায় তারা ঠায় দাঁড়িয়ে ডিউটি করে যাচ্ছে। মাথার ওপর সামান্য ছাতাটুকুও নেই। ছাতা মাথায় দিয়ে ডিউটি করার সুযোগ যে এখন নেই। মাইক নিয়ে প্রচার তো আছেই, সেই সঙ্গে সঙ্গে ভিড় দেখলে মানুষকে গিয়ে বোঝানো। দাগ কেটে দিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে দেওয়া। বিনা প্রয়োজনে কেউ বাইরে বেরোলে তাদের নরমে-গরমে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো। কোথাও দেখা যায় পুলিশ উদ্যোগ নিয়ে রাস্তার ওপর সচেতনতার বার্তা লিখছেন যাতে করে মানুষ রাস্তায় বেরোলে সেটা দেখে যেন সচেতন হয়। করোনা নামটা শুনেই যখন আমরা কাবু, তখন পুলিশ করোনা হেলমেট পড়ে রাস্তায় নেমে মানুষকে বোঝাচ্ছেন।
    করোনার কারণে আমরা গৃহবন্দী কিন্তু পুলিশের ঘরে বসে থাকার উপায় নেই। তাদের ডিউটি করতে হচ্ছে। কিন্তু সেই ডিউটির মাঝে এমন কিছু ছবি আমরা মাঝে মাঝে দেখতে পাই যাতে করে তাদের মানবিকতার দিকটা সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। দেশব্যাপী অসংখ্য এমন কাজের মধ্যে দু-একটি না বললেই নয়। গোপী বোস লেনে একা থাকেন ৭২ বছরবয়সি বৃদ্ধা ভগবতী দে। একে লকডাউন চলছে তার ওপর তিনি অসুস্থ। বাইরে বেরোতে পারছেন না। এদিকে ঘরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। খবর পেয়ে সার্জেন্ট তার দলবল নিয়ে ছুটে যান তার বাসায়। তাকে থানায় নিয়ে আসেন। পুলিশ শুধু তার খাওয়ার ব্যবস্থা নয়, আরও বারো দিনের রেশন সহ তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ৮০ বছরের অঞ্জলি সেন থাকেন কসবায়। স্বামী মারা গেছেন। একাই থাকেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ। অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন। খবর পেয়ে দলবল নিয়ে হাজির হন এস-আই। তাকে উদ্ধার করে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তারপর ঔষধ, খাওয়ার, ফল প্রভৃতি দিয়ে তাকে বাসায় পৌঁছে দেন।
    রাস্তার পাশে বসে দুই বৃদ্ধ ভিখারি। একজনের পায়ের অবস্থা দেখে পরিস্কার ঠিকঠাক চলাফেরাই করতে পারে না। একদল পুলিশ গিয়ে তাদের একটা আচ্ছাদনের নীচে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। তাদের হাত ভালো করে পরিস্কার করে দেয়। একজন পুলিশ নিজের হাতে তাদের খাওয়ার পরিবেশন করে।
    ভিন রাজ্যের আধা সামরিক বাহিনির এক সেনাকে দেখা যায় টিফিন বক্স আর প্যাকেটে করে খাওয়ার নিয়ে গিয়ে রাস্তার অসহায় মানুষদের খাওয়ার দিচ্ছেন। বাক্সের আয়তন আর প্যাকেট দেখে মনে হয় নিজের খাওয়ারটাই বোধহয় তুলে দিয়েছেন অভুক্ত লোকগুলির জন্য।
    এক মহিলার ভাইয়ের অপারেশন। রক্ত চাই। কিন্তু রাস্তায় যানবাহন নেই। ব্ল্যাড ব্যাংকে যাওয়ার কোনো পথ না পেয়ে মহিলাটি অসহায় কাঁদতে থাকেন। জানতে পেরে একদল পুলিশ এগিয়ে আসেন। একজন মোটর বাইকে বসিয়ে মহিলাটিকে ব্ল্যাড ব্যাংকে নিয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা মেটে না। যে গ্রুপের রক্ত দরকার সেটা সেই মুহুর্তে ব্ল্যাড ব্যাংকে নেই। সমাধান করেন পুলিশই। সেখানেই কর্তব্যরত এক পুলিশ রক্ত দেন।
    ঈষিতা দাস নামে এক মহিলা সন্তানসম্ভবা। ১৬/১০ সাউথ ট্যাংরা রোডে বাপের বাড়িতে ছিলেন। মাঝরাতে প্রসব বেদনা ওঠে। বাড়ির লোক কোনোরকমে একটা গাড়ি ঠিক করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু মাঝপথে গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। পরিবারের লোকেরা যখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তখন ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হন পুলিশ। ওখানে কর্মরত এক পুলিশ কনস্টেবল ফোন করে ট্যাংরা থানায় জানান ব্যাপাটা। খবর পেয়ে একজন মহিলা কনস্টেবলকে নিয়ে ওসি ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রিজন ভ্যান। তাতে করে মহিলাটিকে পৌঁছে দেন আর জি কর হাসপাতালে। এইভাবে কোথাও ইটভাঁটার শিশুদের কাছে খাওয়ার পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ, কোথাও নিজেরা ফান্ড করে অসহায় মানুষের হাতে চাল-ডাল তুলে দিচ্ছেন, কখনও বা ভিন রাজ্যের আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য খাওয়া-পোশাকের ব্যবস্থা করছেন, কখনও রাস্তার কুকুরদের জন্য খাওয়ার তুলে দিচ্ছেন। এগুলো কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। বিশ্ব বিপর্যয়ের মুখে সংকটের ঘন অন্ধকার যখন ছেয়ে ফেলেছে আমাদের, তখন গোটা দেশ জুড়ে এভাবেই মানবিকতার উজ্জ্বল মুখ হয়ে হাজির হচ্ছেন পুলিশ। সব খবর আমাদের কাছে আসে না, আসবে না ও হয়তো।
    মানবিক দিকগুলি ছাড়িয়ে এবার একটু অন্য দিকে দেখা যাক। দোকানে দোকানে ঘুরছে পুলিশ। দেখছেন কোথাও কোনো কালোবাজারি হচ্ছে কি না। বেআইনি মজুত হচ্ছে কিনা। মানুষকে নরমে গরমে বোঝাচ্ছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন কেউ অসুস্থ কিনা। বাইরে থেকে কেউ গ্রামে এসেছে কিনা। সেরকম হলে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। বাইরে থাকা আসা মানুষদের ওপর অনেক জায়গায় নানারকম খারাপ ঘটনা ঘটে। মানবিক দৃষ্টিতে ব্যাপারগুলো সামলানোর কাজ করেনই পুলিশই।
    অতি সম্প্রতি পুলিশের কিছু কাজ আমাদের মন কেড়ে নিয়েছে। দেশএর বিভিন্ন রাজ্যের পাশাপাশি কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকে শুরু করে জেলাগুলিতেও আমরা এই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। লকডাউনে আমরা গৃহবন্দী। ঘরে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে একরাশ আতঙ্ক আর ভয়। এসব মনের ওপর চাপ ফেলছে। মানুষকে চাপমুক্ত করতে এবং তাদের মধ্যে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে পুলিশকে আমরা দেখতে পাচ্ছি একেবারে নতুন ভূমিকায়। এলাকায় এলাকায় গিয়ে পুলিশ গান গাইছেন। যে হাতে লাঠি বন্দুক থাকে, সেই হাতে মাইক্রোফোন। কোথাও বিখ্যাত সব গানের প্যারোডি, কোথাও নিজেরাই গান লিখে সুর দিয়ে করোনার সচেতনতার বার্তা দিচ্ছেন। আবার কখনও গলায় ভেসে আসছে পিট সিগারের সেই বিখ্যাত গান We Shall Overcome (আমরা করব জয়)। গানের সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে, মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছেন। বলছেন, কোনো ভয় নেই। আপনারা ঘরে থাকুন। আমরা তো বাইরে আছি আপনাদের জন্য। কয়েকটা দিন একটু কষ্ট করুন। যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের জানান। আমরা সবসময় আছি আপনাদের পাশে।
    ভাইরাসের ভয়ে আমরা বাইরে আছি। তাদের ভয় নেই? করোনা কি তাদের আক্রমণ করবে না? জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা এই কাজ করে চলেছেন দিনের পর দিন। তাদের এমন প্রয়াসে মানুষ যে খুশি তা তাদের চোখমুখ দেখলেই বোঝা যায়। পুলিশের গান শুনে তারা বাড়ির ব্যালকনিতে কিংবা উঠোনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। হাততালি দিচ্ছেন, কেউ গানে গলা মেলাচ্ছেন গুন গুন করে। অনেকেই মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে পুলিশদের শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতার বার্তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সচেতন থাকার দায়িত্ব তো আমাদের। আমরা নিজেরা সচেতন থাকব পাশাপাশি সেই বার্তা অন্যদের দেব। পুলিশের কী দায় পড়েছিল এভাবে আমাদের জন্য পথে নেমে গান করার? এটা কি তাদের ডিউটি? কেন তারা এমন করছেন? যাতে করে আমরা ভালো থাকি। আমরা ভালো থাকলে সমাজ ভালো থাকবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে ডাক্তার-নার্সরা দিনরাত যেমন লড়াই করেছেন এই রোগের বিরুদ্ধে, পুলিশের লড়াইটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রশাসনিক কঠিন দায়িত্ব সামলেও এরা অনেকটাই চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করছেন। চিকিৎসকরা রোগের বিরুদ্ধে লড়ছেন আর পুলিশ লড়াই করছেন যাতে করে মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত না হয়। এই কাজে তারা যত বেশি সফল হবেন ডাক্তার, নার্সদের কাজও অনেকটাই সহজ হবে। হাসপাতালে যত ভীড় কম হবে ডাক্তার-নার্সরা অনেক ভালো পরিষেবা দিতে পারবেন আমাদের। আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসা পরিষেবা খুব কম। রোগ যদি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে দেখা যাবে নূন্যতম চিকিৎসা পরিষেবাও পাবে না অনেকে। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাবে। যে ভয়ানক ছবি আমরা দেখছি বাইরের তথাকথিত উন্নত দেশগুলিতে। তাই পুলিশ আপ্রাণ লড়াই করছেন রোগ সংক্রমণ ঠেকানোর। মানুষকে নানাভাবে বুঝিয়ে, সচতেন করে তাদের ঘরের মধ্যে থাকার কথা বলছেন। বাইরে বেরোলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। একটাই উদ্দেশ্য, রোগ যাতে না ছড়িয়ে পড়ে। সেই নিরিখে এরা এখন কেবল পুলিশ নন, একপ্রকার চিকিৎসকও। সমাজ-চিকিৎসক। চিকিৎসকেরা রোগীর পরিষেবা দিচ্ছেন। এরা লড়াই করছেন যাতে কেউ রোগী না হয়ে যায়। পাশাপাশি টানা গৃহবন্দী থাকতে থাকতে মানুষেরা যে মানসিক চাপের শিকার হচ্ছেন তার থেকেও তাদের মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। আমাদের দেশ যদি এই মারণ ভাইরাসের বিপর্যয় রুখে দিতে পারে তাহলে চিকিৎসকদের যেমন কৃতিত্ব থাকবে, তেমনি করে পুলিশের কৃতিত্বও কম নয়। কিন্তু এদের কথা হয়তো সেভাবে লেখা থাকবে না।
    বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখা কয়েকটি ছবির কথা না বললেই নয়। রাতে ফাঁকা রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের নীচে রাতেরখাওয়া খাচ্ছেন এক পুলিশ। কোনো এক পড়ন্ত দুপুরে কয়েকজন কনস্টেবল একেবারে রাস্তার ওপর বসে পাতায় করে খাওয়ার খাচ্ছেন। দুজন পুলিশ সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত এক জায়গায় ডিউটি করছেন। দেখা গেল পাশের ফ্ল্যাট থেকে কিছু মহিলা তাদের জন্য খাওয়ার, জল এনেছেন। কেননা তারা দেখেছেন এতক্ষণ টানা ডিউটি করা পুলিশগুলো কিছু খায়নি। এইসব মানুষদের একটা ঘর আছে। সেই ঘরে তাদের প্রিয়জন আছে। কিন্তু সেখানে ফেরার সুযোগ নেই তাদের। আমাদের জীবনের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে পথই এখন তাদের সংসার। তাছাড়া ফেরার ছবিটাও কি সুন্দর? যারা হয়তো কিছুদিনের জন্য বাড়ি ফিরতে পেরেছেন, তারা কি বাড়ির লোকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশতে পারছেন? একটা ভয় কি তাদের মধ্যে কাজ করছে না? বাড়ির লোকেরাও কি তাকে দেখে একটু ভয় পাচ্ছে না? একটা ছবির কথা না বললেই নয়। সম্ভবত ডিউটি থেকে দুপুরে খাওয়ার জন্য ফিরেছেন একজন পুলিশ। বাড়ির সামনে উঠোনে বসে তিনি খাচ্ছেন। তার ছোট্ট মেয়েটা বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণতা মাখা অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে অচেনা বাবার দিকে। এ কেমন বাবা! তাকে কাছে ডাকছে না! আদর করছে না! তাকে একটু খাইয়ে দিচ্ছে না! ছবিগুলো দেখলে চোখে না জল এসে উপায় নেই। এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু মহৎ ত্যাগের কথাগুলো কোথাও লেখা থাকবে না। অথচ এটাই সত্যি বিশ্ব বিপর্যয়ের এই ভয়াবহ অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যখন ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠছি তখন এইসব মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী কাজটাই না করে যাচ্ছেন! অনেকেই বলতে পারেন এটা ওদের ডিউটি। সেটা মেনে নিয়েও বলা যায়, শুধুই কি ডিউটি? ওদের চোখ-মুখের দিকে তাকালে কি মনে হয় না, পেশাগত ডিউটির বাইরে গিয়ে ওদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে এক আশ্চর্য আলো। যে আলোয় ফুটে ওঠে অসম্ভব এক জেদ ও স্বপ্ন---মানুষকে ভালো রাখার, সমাজকে ভালো রাখার, দেশকে ভালো রাখার। বুকের মধ্যে অসীম দুঃসাহস আর প্রত্যয় নিয়ে, হার-না-মানা মানসিকতায় ওরা আজ যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন কেবল ডিউটি পালন করার জন্য নয়, সমাজের এই ভয়ানক শত্রুকে পরাজিত করে মানুষকে আবারও একটা সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার জন্য।
    যুদ্ধ চলছে, ভয়ানক যুদ্ধ। ডাক্তার-নার্সরা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন। আর পুলিশেরা কাজ করছেন শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখার। আমরাও এই যুদ্ধের এক একজন সৈনিক। ডাক্তার-নার্স-পুলিশের মতো আমাদেরও নিজ দায়িত্বে সচেতন হই তাহলে এইসব মানুষগুলির ওপর চাপ একটু কম পড়বে। এই সময় এদের সুস্থ থাকা ভীষণ জরুরি। এদের সুস্থ রাখার দায়িত্ব আমাদেরও। আমরা যদি তা করতে পারি, তাহলে সত্যিই একদিন আমরা এই ভয়ংকর শত্রুকে নির্মূল করে জয়ের হাসি হাসতে পারব। সেদিন আমাদের এই প্রিয় দেশ আবারও জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে।

১৮ এপ্রিল, ২০২০।

No comments:

Post a Comment