Tuesday, April 14, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-৯


পয়লা বৈশাখ, একলা নয়...

অস্পষ্ট এক গানের সুরে ঘুমটা ভেঙে গেল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, সুর ভাষা কোনোটাই ঠিকমতো বুঝতে পারা গেল না। ‘এসো হে বৈশাখ কি?’ খুব সম্ভবত তাই হবে। আজ পয়লা বৈশাখ না? মনে হতেই হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। বছরের নতুন দিন। চ্যানেলে চ্যানেলে নিশ্চয়ই নানা অনুষ্ঠান। সোজা গিয়ে বসলাম টিভির সামনে। কিছু একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না। মাঝপথে দেখছি বলে কি? কিন্তু সবকিছু কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে কেন? কেউ একজন যেন কথা বলছে। একটা অস্পষ্ট মুখ, বেদনার ছায়া মাখা। কিছু বলছেন তিনি। মানুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন কি? কথাগুলো স্পষ্ট হচ্ছে না। কী বলছেন তিনি? কান খাড়া করি। অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ কানে আসে। করোনা, মহামারী, লকডাউন, একুশ দিন...! আজকের দিনে এ-আবার কী কথা! এভাবে কেউ শুভেচ্ছা জানায়! ভাবনাগুলো কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে। একটু গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে গায়ে যেন বিদ্যুতের ছ্যাঁকা খাই। সঙ্গে সঙ্গে চেতনা ফিরে আসে। দেখি বিছানায় আছি তখনও। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই। পাশের ঘর থেকে টিভির অস্পষ্ট শব্দ কানে আসছে। দূর থেকেও বুঝতে পারি শব্দগুলোর মধ্যে কোনো গানের সুর নেই। বৈশাখ এসেছে মাঝ রাতে, নীরবে। সকালেও তার অস্তিত্বের আলাদা কোনো টের পাই না। তখনই খেয়াল হয় আজ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার কথা।
    অবশেষে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি। করোনার কোপে বিপর্যস্ত পৃথিবী, কাঁপছে গোটা দুনিয়া ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয় করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ২৪ মার্চ প্রথম দফায় একুশ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন সারা দেশে ভারতবাসীর কাছে এমন অভিজ্ঞতা সম্ভবত এই প্রথম যখন কার্যত গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে গেছে, সিংহভাগ মানুষ গৃহবন্দী সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ। করোনা নামক অদৃশ্য ভয়ানক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে সমস্ত ভারতবাসী। জীবনের লড়াই। বেঁচে থাকা ও বাঁচানোর লড়াই। কারও জানা নেই এই লড়াই কতদিন চলবে বড়ো কঠিন এই লড়াই। হার বা জিত নয়, আমাদের একটাই মন্ত্র এই লড়াই আমরা জিতব, আমাদের জিততেই হবে। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ নয়। বেশ কঠিন। এই কঠিন লড়াই জিততে গেলে ধাপে ধাপে পেরোতে হবে অনেকগুলি অধ্যায় তেমনি এক অধ্যায়ের শেষ হল আজ প্রথম একুশ দিনের লকডাউনের আজ শেষ দিন তবে এখনি এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি নেই কাল থেকে আবারও শুরু হচ্ছে এক নতুন অধ্যায় নতুন করে আরও ঊনিশ দিনের লকডাউন যা চলবে আগামী ৩ মে পর্যন্ত এমনটা যে ঘটবে তার ইঙ্গিত গত কয়েকদিনে পাওয়া যাচ্ছিল। ঘোষণাটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আগেই ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি দুঃখপ্রকাশ করে কাতর অনুনয়ের সুরে রাজ্যবাসীকে বলেছিলেন এবারের নতুন বছর আপনারা বাড়িতেই কাটান। এদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও উঠে এল নতুন বছরের কথা। দেশবাসীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করে তিনি আহ্বান জানালেন এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। সংকল্পিত করলেন সবাইকে এই লড়াই জেতবার।
    বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটা এভাবেই শুরু হল বলা যায়। এ-এক অচেনা, অদ্ভূত যাত্রা। ১৪ এপ্রিল। দীর্ঘ কয়েকদিন ধরে এই দিনটা আমাদের ভাবনায় বারবার এসেছে, এই কারণে নয় যে এদিন বাংলা নতুন বছর শুরু হচ্ছে। গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমাদের বার-তারিখর আর হিসেব নেই, মাঝে মাঝে বরং গুলিয়েই যাচ্ছে। বাংলা নতুন বছর নিয়েও তেমন কারো মাথাব্যাথা নেই। নতুন বছর মানে তো এক নতুন আলো। সময় যখন আটকে গেছে ঘন অন্ধকারে, অস্তিত্ব যখন মুখোমুখি ঘোর বিপর্যয়ের সেখানে নতুন বছর নিয়ে আলাদা করে ভাবনাচিন্তা যেন অনেকটাই বিলাসিতা। তবুও দিনটা বারবার মাথার মধ্যে এসেছে, কেননা এদিন ২১ দিনের লকডাউনের শেষ দিন। তারপর কী হবে? এই তারপর কী হবে’র ভাবনাতেই ১৪ এপ্রিল দিনটা মাথার মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছিল। আমরা তো ভুলতেই বসেছিলাম আজকের দিনটা বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন, যে দিনটা বাঙালীরে কাছে আলো আর আবেগের। তাই তো প্রতিবারই বেশ ঘটা করেই তার আগমন ঘটে। কিন্তু এবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
    কোথা দিয়ে একটি বছর বিদায় নিয়ে নতুন বছর এসে ঢুকে পড়ল আমরা বুঝতেই পারলাম না। আমাদের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম কোনো পুরোনো বছরের এমন নিঃশব্দ বিদায় আর নতুন বছরের উদাসীন আগমন। তার জন্য সাজানো নেই কোনো বরণডালা। নেই শাঁখের মাঙ্গলিক সুর। আবেগ উচ্ছ্বাসহীন নতুন বছরের আগমন অনেকটা যেন রবাহুতের মতো। ভীষণ একা। শুভ-অশুভের দোলাচলে নতুন বছর কার্যত শুভেচ্ছাহীন।
    একটা বছর বিদায় নিয়ে চলে গেল। বর্ণময় চৈত্র একেবারেই বিবর্ণ, প্রাণহীন। উল্টে তার গায়ে মৃত্যু আর ভয়ের কালো ছোপ। রঙের উৎসব শেষ হতে না হতেই নতুন করে উৎসবের প্রস্তুতিতে মেতে ওঠে বাঙালি। চৈত্রের প্রায় প্রথম সপ্তাহ থেকে দোকানে দোকানে শুরু হয়ে যায় চৈত্র সেল। দোকানে ভিড় জমায় মানুষ। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের চোখে-মুখে ঠিকরে পড়ে খুশির আলো। জামা-কাপড়, জুতো থেকে শুরু করে সোনার গহনা, মানুষের মধ্যে জিনিস কেনার ধুম পড়ে যায়। বাঙালির কাছে এটাও একটা উৎসব। চৈত্র সেলের মধ্য দিয়ে পরোক্ষে বেজে ওঠে নতুন বছরের আগমনী সুর।
    চৈত্র মানে শুধু চৈত্র সেল নয়। চৈত্র মানে চড়ক, গাজন। কিন্তু এবার চড়ক নেই, গাজন নেই। গাজনের আগে ঢোল ডুগডুগি বাজিয়ে শিব-দূর্গা সেজে বাড়ি বাড়ি সাহায্য চাইতে আসা মানুষগুলোও নেই। মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালা নেই। মন্দিরের দরজা বন্ধ, বাজারে ডাবের দোকান নেই, মিষ্টির দোকানে ব্যস্ততা নেই, শাড়ি পরতে অনভ্যস্ত মেয়েদের নতুন শাড়ি পরে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে থমকে যাওয়ার অস্বস্তি নেই। একইরকম শাড়ি পড়ে মাথায় ঘটি নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে জল ঢালতে যাওয়ার বহু পরিচিত দৃশ্যগুলো এবার উধাও। রাস্তায় কান পাতলে শোনা যায় না সেই পরিচিত সুর ‘ভোলে বাবা পার করেগা’ কিংবা ‘বোম বোম ভোলে’ আওয়াজ। শূন্য রাস্তা, নীরব বাতাস।
    পৃথবীর আজ গভীর অসুখ। চৈত্র হারিয়েছে তার চেনা রূপ। এ-চৈত্র বড়োই অচেনা, প্রাণহীন। করোনাবিদ্ধ জীবন এখন গৃহবন্দী। গুটিকতক অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের দোকান ছাড়া বাকি সব বন্ধ। রাস্তায় মানুষ নেই। যে দিনটা মানুষের ভিড়ে গমগম করে উঠত গলি থেকে রাজপথ আজ তা একেবারে শুনশান, নিষ্প্রাণ। মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে খুশি। আতঙ্ক আর উদ্বেগ নিয়ে মানুষ এখন জীবনের মন্ত্র উচ্চারণ করছে আকুল হৃদয়ে। ভয়, আতঙ্ক আর অবিশ্বাস নিয়ে অচেনা চৈত্র শূন্যতার হাহাকারে লিখে গেছে বর্ষ বিদায়ের সুর। যে সুরের পরে লেখা নেই আগামীর আগমনী গান।
    বাঙালীর কাছে নতুন বছর একটি উৎসব। বিভিন্ন জায়গায় নানাবিধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ মেতে ওঠে বর্ষবরণের উৎসবে। এদিন সকালে পুন্যস্নান সেরে, নতুন পোশাক পরে মানুষ তাদের আরাধ্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করে সুখ ও সমৃদ্ধির। ব্যবসায়ীদের কাছে এই দিনটি খুবই পবিত্র। দোকানে দোকানে হালখাতার সূচনা হয়। ব্যবসায়ীরা সকালে স্নান সেরে লক্ষ্মী কিংবা গনেশের কাছে প্রার্থনা করে তাদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির। মন্দিরে মন্দিরে ভীড় জমে যায়। ফুলের মালা, রঙীন কাগজ, বাহারী আলোয় সেজে ওঠে দোকান। ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় মিষ্টির প্যাকেট, নতুন বছরের ক্যালেন্ডার। কেউ কেউ উপহারও তুলে দেয়। মানুষের মধ্যে পাঁজি কেনার ধুম পড়ে যায়। বেনীমাধব শীল, গুপ্ত প্রেস, প্রীতম বাগচি. রাজেন্দ্র লাইব্রেরি প্রভৃতি রকমারি পঞ্জিকা দোকানে স্তূপ হয়ে থাকে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। এদিন কোথাও কোথাও আবার ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। গ্রাম-বাংলায় পয়লা বৈশাখের সকালে, সূর্য ওঠার অনেক আগে মাঠে, বাড়ির উঠোন কিংবা বাগানে বিভিন্ন গাছগাছালি দিয়ে আগুন জ্বালানোর রীতি দেখা যায়। নববর্ষের প্রথম সূর্যোদয় দেখা অনেক জায়গায় পুন্য কাজ বলে মনে করা হয়। প্রথম দিনটা মানুষ চায় শান্তিতে, ঝগড়া-বিবাদহীন কাটাতে। অনেকের বিশ্বাস বছরের প্রথম দিনটা ভালোভাবে কাটলে গোটা বছরটা ভালো কাটবে।
    নতুন বছরের প্রথম দিনের সেই চেনা ছবিটা এবার হারিয়ে গেছে। বর্ষশেষের রাতে টিভির পর্দায় নেই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। গানে-কথায় মুখরিত হয়ে মানুষের সময় এগোয়নি মধ্যরাতের দিকে, নতুন বছরের ঠিক সূচনায় তাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। করোনার গ্রাসে হারিয়ে গেছে সমস্ত উচ্ছ্বাস আর আবেগ। রাত জেগে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেখা মানুষগুলো এবার অনেকেই রাতে নিউজের চ্যানেলে চোখ রাখেনি ভয়ে, আতঙ্কে। করোনায় বিশ্ব বিপর্যস্ত। উন্নত দেশগুলো অসহায়, দিশাহারা। বিশ্ব জুড়ে মৃত্যু মিছিল। দেশেও করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এই ভয়াবহ ছবি মানুষকে টিভি থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
    নতুন বছরের সকাল মানে এক ঝলমলে রোদ্দুর। কিন্তু সেই ছবিটা এবার আর নেই। সারি সারি দোকান ধুলোর আস্তরণ মেখে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো সাজ ওঠেনি তাদের গায়ে। কেউ কেউ হয়তো কোনোরকমে দোকানটা একটু সাফসুতরো করে ধুপ, প্রদীপ দিয়েছে। ব্যাস ওটুকুই। এবার আর হালখাতা কেনার ধুম নেই। অধিকাংশ মন্দিরের দরজা মানুষের জন্য বন্ধ। যে গুটিকতক মানুষ হালখাতা কিনেছেন পুজো করতে গিয়ে তারা সমস্যায় পড়েছেন। কোথাও কোনো উৎসব নেই, বইপাড়ায় হুল্লোড় নেই, বিভিন্ন প্রকাশনা অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা নেই, মাছ-মাংসের দোকানে ভিড় নেই, মিষ্টির দোকানে মানুষের উপস্থিতি নেই। রাস্তা আছে মানুষ নেই, একে-অপরকে জড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় নেই। তবে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটা হারিয়ে যায়নি পুরোপুরি। নতুন বছরে গ্রিটিংস কার্ড দেওয়ার চল অনেক আগেই প্রায় উঠে গেছে। প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তে শুভেচ্ছাবার্তা এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আগের মতো সেই উচ্ছ্বাস আর নেই। প্রতিটি শুভেচ্ছাবার্তায় জড়িয়ে গেছে এক বিষণ্ণ সুর, আগামীর আলোর আকুল প্রার্থনা।
    করোনার মহামারীতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। মানুষ এখন গৃহবন্দী। একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস মানুষকে আজ একা করে দিয়েছে। পরিবারের মধ্যে কাটাতে কাটাতেও মানুষ যেন ভেতরে ভেতরে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। জেট যুগের বাসিন্দা হয়ে মানুষ যতই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ুক না কেন, পরিবারের বাইরেও প্রত্যেকের নিজের নিজের মতো একটা জগৎ রয়েছে। যেখানে সে নিজেকে আলাদা করে খুঁজে পায়। কিন্তু করোনার ত্রাস মানুষের জীবনে লক্ষণরেখা টেনে দিয়েছে। বাইরের দরজা বন্ধ করে তাকে একা করে দিয়েছে।
    সময়ের নিয়মে একটি বছর শেষ হয়ে নতুন বছর এসেছে। কিন্তু নববর্ষের এই শুরুর দিনটা কেবলি একটা দিন মাত্র। এর মধ্যে কোথাও কোনো শুভ নেই। উল্টে একটা অজানা অশুভ ছায়া যেন জড়িয়ে আছে এর গায়ে। নিজের বিবর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে একা একা সে হেঁটে গেছে সকাল থেকে দুপুর, বিকেল থেকে সন্ধ্যায়। সেও বোধহয় চায় এই অচেনা দিনটা কেটে যাক তাড়াতাড়ি। যেন পালিয়ে বাঁচতে চায় সেও। এমন নিঃসঙ্গ, অনাদর দিন তারও কি ভালোলাগে? অনেকেই তাই বলছে, আজ পয়লা বৈশাখ নয়, নয় ১লা বৈশাখও; আজ বৈশাখ আসলে একলা—একলা বৈশাখ।
    কিন্তু সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি নতুন বছর আজ একলা? প্রত্যেক বছর বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটা বিভিন্নজনের বিভন্নরকম ভাবে কাটে। উৎসব, অনুষ্ঠান, আমাদের চাওয়া-পাওয়া, প্রার্থনা কিংবা নতুন দিনের নেওয়া সংকল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। কিন্তু এবার? আমরা সকলেই এখন চাইছি, করোনার এই ত্রাস থেকে মুক্ত হোক পৃথিবী। সুরক্ষিত হোক আমাদের জীবন। ফিরে আসুক বেঁচে থাকার স্বাভাবিক ছন্দ। প্রার্থনা করছি, যে সকল মহান যোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছেন করোনাকে পরাজিত করে জীবনকে জিতিয়ে আনার জন্য, তারা যেন ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। তারা যেন হেরে না যান। সকলেই চাইছি যে গবেষকরা করোনার প্রতিষেধক আবিস্কার করার চেষ্টায় আছেন, তারা যে দেশেরই হোক না কেন, তারা যেন সফল হন। এখন এটাই আমাদের রোজকার প্রার্থনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনটিও নিশ্চিতভাবে তার ব্যতিক্রম নয়। বছরের এই প্রথম দিনে এই একই প্রার্থনাগুলো কি আমাদের মনে বারে বারে ফিরে আসেনি? অবশ্যই এসেছে। তার মানে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ আজকের দিনে একই ভাবনা, বোধ ও সংকল্পে একাকার। এভাবে আর কখন আমরা সবাই একসাথে মিলে এমন ইতিবাচক ভাবনায় এক হয়েছি? মিলিতভাবে সংকল্প নিয়েছি যুদ্ধ জয়ের? ‘আমি’ থেকে এখন আমরা অনেক বেশি করে ‘আমরা’ হয়ে গেছি। গৃহবন্দী হয়ে দূরে সরে গেছি একে-অপরের থেকে ঠিকই, কিন্তু আসলে আমরা মানসিকভাবে একে-অন্যের অনেক কাছাকাছি এসে গেছি। এটা ঠিক এবারের নতুন বছরের প্রথম দিনটা একেবারেই অচেনা। এমন দিন আমরা চাই না। কিন্তু কী করা যাবে। জীবনে অনেক সময় এমন কিছু পরিস্থিতি আসে যেটা আমাদের মেনে নিতে হয়। বাড়ির কারও অসুখ করলে আমরা কষ্ট পাই। আমাদের অনেক হিসেব বানচাল হয়ে যায়। পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ। তার জন্য এলোমেলো হয়ে গেছে অনেক কিছু। পৃথিবীর অসুখ হলে আমরা ভালো থাকব কী করে? তবে বাড়ির লোকের অসুখ করলে আমরা মানসিকভাবে জোটবদ্ধ হই, মিলিতভাবে তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করি। তেমনি করে আমাদের সকলের এখন একটাই প্রার্থনা সেরে উঠুক আমাদের প্রাণের পৃথিবী। বন্ধ হোক মৃত্যু মিছিল। সুস্থ ও স্বাভাবিক হোক জীবন। আজকের এই বিশেষ দিনে যে যার আরাধ্য ঈশ্বরের কাছে ব্যক্তিগত প্রার্থনা জানানোর পাশাপাশি অবশ্যই করে চাইছে করোনা থেকে মুক্ত হোক আমাদের পৃথিবী। আমাদের সেই মাঙ্গলিক নীরব মন্ত্রোচ্চারণের সুর অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে রেখেছে বছরের প্রথম দিনটিকে। তার সাথে সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের হৃদেয়র শুভ ইচ্ছা, আশা আর আকাঙক্ষা। তাই আজকের দিনে আমরা অনেক বেশি করে জড়িয়ে আছি বছরের প্রথম দিনটির সাথে হয়তো অন্যান্য বছরগুলির থেকেও বেশি করে। তাই কী করে বলি পয়লা বৈশাখ আজ একলা?
    আজ পয়লা বৈশাখ কিংবা বলা যেতে পারে ১লা বৈশাখ কিন্তু বৈশাখ আজ একলা নয় মোটেই।

১৪ এপ্রিল, ২০২০।


No comments:

Post a Comment