জেগে আছেন ঈশ্বর....

স্পষ্টভাবে
এই বক্তব্যের মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের একটি ব্যাপার জড়িয়ে আছে। কেউ
বিশ্বাস করেন, কেউ করেন না। উভয়ের বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে, সেই ব্যাপরটা দূরে
সরিয়ে রেখে একটু গভীরভাবে আলোচনা করে দেখা যেতেই পারে। তাহলে কোনো একটি
নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আটকে না থেকে আমরা হয়তো নিজেরাই নিজেদের বক্তব্যের ঠিক-ভুল
আপনা থেকেই অনুধাবন করতে পারব।
প্রথমত যে
কথা বলার, যারা এই কথা বলছেন তারা কেন বলছেন? কেন তারা আজ ঈশ্বরের দিকে আঙুল তুলে
বিজ্ঞানের গুণকীর্তন করছেন? তাদের বক্তব্যের পেছনে অবশ্যই যুক্তি আছে। আমি সেই
যুক্তির মধ্যে ঢোকার আগে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। এই সময় হঠাৎ করে ঈশ্বরের দিকে
কেন আঙুল উঠছে? করোনা আজ বিশ্বকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এমন
তো নয়, এই রোগ আসার আগে আমাদের আর কোনো রোগ ছিল না? অসুখ-বিসুখে মারা যাওয়ার
ঘটনা ঘটত না? সারা বিশ্বে নানাবিধ অসুখ-বিসুখে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়।
এখনও হারাচ্ছে। সে তুলনায় করোনায় মৃত্যুর হার অনেক কম। স্টাটিসটিক্স নাকি তাই
বলছে। মৃত্যু নিয়ে আমি কোনো তুলনা টানতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, করোনার
প্রকোপ আমাদের সভ্যতাকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর আগেও
আমাদের পৃথিবী সুন্দর ও নীরোগ ছিল এমনটা নয়। পৃথিবীর এখন গভীর অসুখ। সেটা আজ নয়
অনেকদিন থেকেই। আমরা জেনেও না জানার ভান করে ছিলাম, হয়তো আছিও। করোনা নামক
অতিমারী আমাদের চোখের সেই ঠুলিটা খুলে দিয়েছে। বিপর্যস্ত আমরা কেউ কেউ তাই এখন
ঈশ্বরের দিকে আঙুল তুলে বিজ্ঞানের গুনকীর্তন করছি। কিন্তু একবারও কি প্রশ্ন করেছি,
কেন বিজ্ঞানকে আজ এভাবে জেগে থাকতে হয়েছে?
থাক ও
প্রসঙ্গ। যে কথা বলছিলাম। কেউ কেউ কেন আজ ঈশ্বরের দিকে আঙুল তুলেছেন? করোনা
ভাইরাস ভারতবর্ষে আক্রমণ করা শুরু করতেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, কলেজ,
অফিস, আদালত, শপিং মল, পার্ক, দর্শনীয় স্থান, মিউজিয়াম প্রভৃতি। প্রথমে একদিনের
জনতা কার্ফু। পরে একুশ দিনের লকডাউন ঘোষণা হয়। জরুরি পরিষেবা ছাড়া সমস্ত যানবাহন,
এমনকি বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ সব বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের তালিকায় এক এক করে যুক্ত হতে
থাকে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়গুলি। বিপদে পড়লে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ
ঈশ্বরকে স্মরণ করেন। উপাসনালয়ে যান, পূজা-প্রার্থনা করেন। বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য
যে যার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন। আর এখন, যখন জাতির জীবনে নেমে এসেছে ঘোর
বিপর্যয়, সভ্যতা মুখোমুখি ভয়ংকর সংকটের তখন মানুষ চাইলেও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে
যেতে পারছেন না। কেননা সেসবের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই অনেকেই প্রশ্ন করছেন,
ঈশ্বরের তো অসীম ক্ষমতা। তিনি তো মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তাহলে তার ঘরের
দরজা কেন মানুষের জন্য বন্ধ হবে? ভাইরাসের বিপদ থেকে কেন তিনি মানুষকে রক্ষা করতে
পারছেন না? তাই তাদের বক্তব্য ঈশ্বর এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে
এই ঘোর বিপর্যয়ের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন ডাক্তার-নার্সেরা
(বাকিদের কথা অন্য সময় বলব)। কোনো ঐশ্বরিক কিংবা অলৌকিক ক্ষমতা নয়, বিজ্ঞান
(চিকিৎসা বিজ্ঞান)-এর সীমাবদ্ধ ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে তারা লড়াই করে চলেছেন। তাই
তাদের বক্তব্য জেগে আছে বিজ্ঞান। তাদের কথার সারমর্ম এই, ঈশ্বর ঘুমিয়ে গেছেন কারণ তিনি
হেরে গেছেন। যদি শেষমেষ জয় আসে সেটা আসবে বিজ্ঞানের হাত ধরে। এই মন্তব্য নিয়ে
কোনো বিতর্কে না গিয়ে একদম সহজ কথায় বলি, আমরা এখন চেয়ে আছি বিজ্ঞানের দিকে।
ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে সবাই, যারা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তাকিয়ে
আছি তাদের দিকে। এমনকি যারা ঘোরতর ঈশ্বর বিশ্বাসী, তারাও হয়তো তাদের আরাধ্য
দেবতার কাছে এমন প্রার্থনা করছেন---হে ঈশ্বর বিজ্ঞানকে জিতিয়ে দাও তুমি। করোনা
যুদ্ধের সেননানীরা যেন হেরে না যায়। যে গবেষকরা দিনরাত গবেষণা করছেন করোনার টিকা
বা প্রতিষেধক আবিস্কার করার জন্য তারা যেন সফল হন। অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে কৃপা
প্রার্থনা করেও তারা কিন্তু শেষমেষ সেই বিজ্ঞানের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার সাফল্যের
পথে চেয়ে আছেন। ঈশ্বরকে বলছেন বিজ্ঞানকে জিতিয়ে দিতে। এমনকি কোনো কোনো
বিজ্ঞানমনস্ক মানুষও হয়তো কাজের সাফল্যের জন্য নিজের আরাধ্য ঈশ্বরের কাছে
প্রার্থনা করছেন। কেননা বিশ্বাস এমন এক জিনিস যা অনেক সময় যুক্তির ব্যাখ্যা মানে
না। সে যাই হোক, প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসে থাকুন। আমরা অন্তর দিয়ে
প্রার্থনা করি আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান যেন শেষমেষ সাফল্যের হাসি হাসতে পারে।
করোনা নামক এই অদৃশ্য ভয়ংকর দানবকে হারিয়ে দিতে পারেন। দেশ তথা বিশ্বের অধিকাংশ
মানুষের সম্ভবত এটাই এখন একমাত্র প্রার্থনা।
অনেকে
মন্তব্য করেছেন ঈশ্বরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে কারণ ঈশ্বরেরা এখন সাদা পোশাক পরে,
গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে হাসপাতালে কাজ করছেন। হাসপাতালগুলিতে যারা কাজ করছেন তারা
ঈশ্বর নন, তারাও মানুষ। তারা এক-একজন অসম সাহসী সেনানী। করোনা কতখানি ভয়ংকর তা
বুঝতে কারও বাকি নেই। এর বিরুদ্ধ নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই। উন্নত দেশগুলির তুলনায়
আমাদের দেশের চিকিৎসা পরিকাঠামো অনেক অনুন্নত এবং প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। এরপর
রয়েছে আরও অনেক প্রতিকূলতা। এতকিছু সমস্যা নিয়েও তারা লড়াই করে যাচ্ছেন। আমরা যখন
নিজেদের ঘরে আটকে থাকতে থাকতে কাহিল হয়ে পড়ছি, নিজেদের ক্ষোভ-যন্ত্রণা প্রকাশ
করছি, সরকারি নিষেধ অমান্য করে অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হচ্ছি, তখন ওইসব
মানুষগুলো পরিবার পরিজন থেকে দূরে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে চলেছেন। চাইলেও
তারা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নিজের মতো করে সময় কাটাতে পারছেন না। শুধু তো লড়াই
নয়, এই কঠিন সময়ে তারা যে ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন তার জন্য কোনো প্রশংসাই
যথেষ্ট নয়। সমগ্র দেশবাসী এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সেইসব
মানুষেরা আমাদের থেকে বেশি ভালো করে জানেন কত ঝুঁকির মধ্যে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত
কাটাতে হয়। তবুও যুদ্ধের ময়দান থেকে তারা আত্মবিশ্বাসী গলায় আমাদের বার্তা
দিচ্ছেন, ‘আমরা জিতবই। করোনাকে
আমরা হারাবোই।’ ভয়কে সরিয়ে রেখে যারা আমাদের কাছে এমন বার্তা পৌঁছে দেন, তাদের
কোন নামে ঠিকঠাক ডাকা যায় বুঝতে পারি না। কিন্তু তারা যে সাধারণ মানুষ নয়, এটা
নিশ্চিত। আমার চোখে তারা অতিমানব। অনেকের চোখে তারা ঈশ্বর। সেই সব ঈশ্বরের চোখে
আজ ঘুম নেই। তাই যে সমস্ত মানুষ দাবি করছেন বিজ্ঞান জেগে আছেন অর্থাৎ মানুষরূপী এই
ঈশ্বরেরা জেগে আছেন, তাদের দাবি অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত। আমার মনে হয় এই নিয়ে কোনো
বিতর্ক হতে পারে না।
এইসব
অতিমানবদেব কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মান জানিয়েও একটা প্রশ্ন করতে চাই, সত্যি সত্যি কি
ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়েছেন? প্রথম কথা, উপাসনালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে মানে কি ঈশ্বর
ঘুমিয়ে গেছেন? ঈশ্বর কি কেবল ওইসব উপাসনালয়ের মধ্যেই রয়েছেন? এই উপাসনালয়গুলি কি
ঈশ্বর নিজে বানিয়েছেন? আর ভয় পেয়ে নিজেই এখন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন?
আদপে তা নয়। ঈশ্বরকে কি কোনো নির্দিষ্ট ঘরে আটকে রাখা যায়? যদি যেত তাহলে তো এত
উপাসনালয় গড়েই উঠত না। এসব মানুষেরই তৈরি। মানুষই এসবের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে এবং
সেটা ঈশ্বরের কথা ভেবে নয়, নিজেদের সুরক্ষার জন্য। তাই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আঙুল
তোলা বোধহয় ঠিক নয়।
তাহলে
প্রশ্ন ঈশ্বর এখন কোথায়? তিনি কি আছেন? হ্যাঁ, তিনি আছেন, ভীষণভাবেই আছেন। তিনি
ঘুমিয়ে নেই একদম। কেননা ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাবে।
ঈশ্বর জেগে আছেন। হয়তো নীরবে তিনি কাজ করে চলেছেন আমাদের জন্য আবারও একটা সুন্দর
পৃথিবী উপহার দেওয়ার জন্য। আমার কথা হয়তো কারও কাছে প্রলাপের মতো মনে হবে।
কিন্তু একটু তলিয়ে তো দেখা যেতেই পারে?
‘ঈশ্বর’
শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি ‘ঈষা’ ধাতুর সঙ্গে ‘বরচ’ প্রত্যয়
যোগ করে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি এসেছ। ‘ঈশ’ ধাতুর অর্থ কর্তৃত্ব করা। যিনি সকলের ওপর
কর্তৃত্ব করেন। আমাদের পৃথিবীতে সবকিছুর ওপর কর্তৃত্ব কে করতে পারে? বিজ্ঞান কি? মোটেও তা নয়। বিজ্ঞানের বলে
বলীয়ান হয়ে আমরা প্রকৃতির ওপর যতই আমাদের কর্তৃত্ব ফলাই না কেন, প্রকৃতপক্ষে
প্রকৃতির কাছে আমরা আজও অনেক অসহায়। বিজ্ঞানের কর্তৃত্বেরও একটা নির্দিষ্ট সীমা ও
সীমাবদ্ধতা আছে। প্রকৃতি যদি বিরূপ হয় তাহলে সভ্যতা সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
আর বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ক্ষমতার গর্ব কতখানি অসার সেটা আমরা
ভালোরকম বুঝতে পারছি। জেট যুগের বাসিন্দা হয়েও আমরা গৃহবন্দী হয়ে একপ্রকার স্থবির
জীবন কাটাচ্ছি। বাইরে পা ফেলতে গেলে প্রতিমুহুর্তে গ্রাস করছে একটা আতঙ্ক আর
অবিশ্বাস। আসলে প্রকৃতিই আমাদের কর্তা। সকলের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে একমাত্র
প্রকৃতি।
সনাতন
ধর্মে বলা হয়েছে ঈশ্বর হলেন এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বত্র
বিরাজমান। তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আর দেবতা বলতে ঈশ্বরকে বোঝায় না। দেবতা হল
ঈশ্বরের শক্তি-রূপ। ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির রূপ হিসেবে আমরা বিভিন্ন দেবতার আরাধনা
করি। আমরা যদি এই কথাগুলি একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে বুঝতে পারব এখানে
প্রকৃতি হল ঈশ্বর আর প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি হল দেবতা। সেই শক্তির মধ্যে জীবনের
অপরিহার্য জড় উপাদানগুলি যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সমস্ত জীবকূলও। কালীমাতার সাধক
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও বলেছেন ‘যত্র জীব, তত্র শিব।’ আর তাঁর সুযোগ্য
শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’
তাদের কথাতেও পরিস্কার তারা এই পৃথিবীর মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থানের কথা বলেছেন।
তাছাড়া, সারা পৃথিবীতে একসময়ে সর্বত্র বিরাজ করতে পারে কে? একমাত্র প্রকৃতি।
কোনো
কোনো ধর্মের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ঈশ্বর এই জগত সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এর
প্রতিপালক। ধর্মীয় ব্যাখ্যা ছেড়ে যদি আমরা বিজ্ঞানের আলোয় সৃষ্টির ব্যাখা খুঁজি
তাহলে কী দেখব? জীবের
স্রষ্টা কে? আলো, জল, বাতাস, মাটি প্রভৃতি হল পৃথিবীতে প্রাণের স্রষ্টা আর
প্রতিপালক।
হিন্দু
ধর্মালম্বীরা বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো করেন। ‘দেবতা’ শব্দটি এসেছে ‘দিব’ ধাতু থেকে যার অর্থ ‘দীপ্তি’ বা ‘জ্যোতি’।
এই উজ্জ্বল দীপ্তি বা জ্যোতি আমরা দেখতে পাই প্রকৃতির মধ্যে, তার বিভিন্ন
উপাদানের মধ্যে। প্রকৃতির অপরিহার্য উপাদান আলো, জল, বাতাস, মাটি যা আমাদের বাঁচিয়ে
রেখেছে তার মধ্যে। বিজ্ঞান নিয়ে আমরা যত বড়াই করি না কেন, প্রকৃতি যদি তার এইসব
দান থেকে আমাদের বঞ্চিত করে তাহলে আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। বিজ্ঞানেরও
এখানে কিছু করার নেই। তাই প্রকৃতিকে ঈশ্বর বলতে বাধা নেই।
আমরা যদি অতীতে
চোখ বুলোই তাহলে দেখতে পাবো প্রাচীন মুণি-ঋষিরা প্রকৃতিকেই ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো
করতেন। আগুন, সূর্য, বাতাস, জল প্রভৃতির আরাধনা করতেন। তারা বলতেন এসবের মধ্যেই
ঈশ্বর বিদ্যমান। জীবজন্তু, গাছপালা, পশুপাখি প্রভৃতির মধ্যে ঈশ্বর বিরাজমান। বেদ,
উপনিষদ, পুরাণ প্রভৃতিতে ঈশ্বরের কথা বলা নেই। বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, চর্বাক দর্শন,
সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শনে জগতের স্রষ্টারূপে ঈশ্বরের কথা বলা নেই। বেদে বলা
হয়েছে প্রকৃতিই ঈশ্বর। মণুসংহিতায় পরিবেশ সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সাংখ্য
দর্শনে জগতের স্রষ্টারূপে প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। ভারতের একটি আদিবাসী জাতি
বিষ্ণোই যারা বিষ্ণুর উপাসক। কিন্তু তাদের কাছে প্রকৃতি হল ঈশ্বর। প্রকৃতিই এদের
কাছে শক্তির উৎস। এরা যে ২৯ টি নিয়ম মেনে চলে তাদের মধ্যে অন্যতম হল পরিবেশ রক্ষা।
এসব
দৃষ্টান্ত থেকে আমরা বলতে পারি প্রকৃতিই ঈশ্বর। ঈশ্বর একটি শক্তি। যে শক্তি অসীম।
মানুষ সেই শক্তির আরাধনা করে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসে আরাধনার পথ ভিন্ন। সময়ের
বিবর্তনের ধারায় আমাদের ঈশ্বর-বিশ্বাস ও উপাসনায় নানাবিধ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং
সেটা স্বাভাবিক। আমরা যারা মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী, তারা ভিন্ন ভিন্ন রূপে এই
ঈশ্বরের আরাধনা করি। আমাদের ভাবনা ও বিশ্বাসে ঈশ্বরের ভিন্নভিন্ন রূপ। আমরা যদি
ধরে নিই ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তাহলে এটা মানতেই হবে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির
আগে থেকেই ঈশ্বর বিরাজ করতেন। তখন তো তার থাকার নির্দিষ্টি কেনো স্থান ছিল না।
তার প্রয়োজনও হয়নি। কেননা তিনি সর্বত্র বিরাজমান। আমরাই আমাদের নিজের নিজের
বিশ্বাসে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ কল্পনা করে তার জন্য উপাসনাগৃহ নির্মান করেছি। তাই
উপাসনালয়গুলির দরজা বন্ধ হয়েছে মানে ঈশ্বর ঘুমিয়ে গেছেন এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল।
ঈশ্বররূপী সেই অসীমশক্তি প্রকৃতিতেই বিরাজমান এবং তা প্রবলভাবে।
যাই হোক,
যে কথা বলার। ঈশ্বর নিয়ে আমাদের যে যার বিশ্বাস তার নিজের মতো থাক। কারও বিশ্বাস
নিয়ে কোনোরূপ মন্তব্য করতে চাই না। কেননা গোঁড়ামি না থাকলে প্রত্যেক বিশ্বাসেরই
ভালো দিক আছে, যদি আমরা সেই বিশ্বাসকে ইতিবাচক পথে চালিত করতে পারি। সে প্রসঙ্গ
দূরে সরিয়ে একেবারে সাধারণ কথায় বলি, প্রকৃতির দানে আমাদের জীবন পরিপুষ্ট এবং
প্রতিপালিত। আমাদের ওপর প্রকৃতির প্রভাব অপরিসীম। প্রকৃতিকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব
না। তাই প্রকৃতিকে ঈশ্বর বলতে বাধা থাকতে পারে না। আর সেটা যদি মানি, তাহলে এটা
পরিস্কার ঈশ্বর ঘুমিয়ে নেই একদম। ঘুমিয়ে থাকলে এই সমস্যা আসত না। আসলে তিনি
প্রবলভাবে জেগে আছেন।
দিনের পর
দিন আমরা প্রকৃতির ওপর ভীষণ অত্যাচার করে যাচ্ছি। যথেচ্ছ গাছপালা কাটছি, দূষণ
ঘটাচ্ছি, নির্বিচারে প্রাণীকূলকে ধ্বংস করছি। এর মারাত্মক পরিণাম কি সেটা বুঝেও না
বোঝার ভান করে আছি। সাধারণ কথায় ‘কর্মফল’ বলে একটি শব্দ আছে। তুমি যেমন কাজ করবে তেমন ফল ভোগ করতে হবে।
প্রকৃতির ওপর আমরা যদি নির্বিচারে অত্যাচার করি সেও কি আমাদের ছেড়ে দেবে? কখনইও
নয়। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। যাকে বলে Nature’s Revenge।
প্রকৃতির সেই প্রতিশোধের আঁচ আমরা অনেকদিন থেকেই পেতে শুরু করেছি। অথচ আমরা যদি
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ভালো করে পড়ি তাহলে দেখা যাবে সেখানেও বলা হয়েছে পরিবেশকে
ভালোবাসার কথা, তাকে সুরক্ষিত করার কথা। গাছপালা থেকে শুরু করে ছোটোখাটো
প্রাণীদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। সনাতন হিন্দু ধর্ম, বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা,
বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম প্রভৃতিতে বারবার করে জোর দেওয়া হয়েছে পরিবেশের সুরক্ষার ওপর।
প্রাচীন মুণি-ঋষিরা বলেছেন প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন। বৈদিক মন্ত্রে বলা
হয়েছে মানুষের জীবন প্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বৈদিক সাধনার মূল লক্ষ্য হল
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপন। পরিবেশের অনিষ্ট করলে আমাদের প্রকৃতির
রোষে পড়তে হবে। যুগে যুগে বিভিন্ন মনীষীগণও প্রকৃতি এবং তার উপাদানকে যত্ন নেওয়ার
কথা বলেছেন।
প্রকৃতি
ঈশ্বর কি ঈশ্বর নন, সেটা ছেড়ে এবার একটু ঈশ্বরের কথায় আসি। সেই ঈশ্বর যাকে আমরা
বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন রূপে আরাধনা করি। আমাদের হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন দেবদেবীর
পুজোর চল রয়েছে। যে কোনো পুজোর অপরিহার্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে দুর্বা, তুলসী,
বেলপাতা, জুন নামক ঘাস, ফুল, পঞ্চপল্লব (আম, বট, অশ্বত্থ, ডুমুর, বকুল), তালপাতা ও শরগাছ, কলাগাছ, তুলো, চন্দন কাঠ, নারকেল, ধান, চাল, দুধ, ঘি প্রভৃতি।
সঙ্গে গঙ্গা জল। কেননা গঙ্গার জল পবিত্র। এখন ঈশ্বরকে আমরা যদি কোনো মানুষ বলে
ভাবি আর পুজোআর্চাকে ভাবি জীবনধারন বা বেঁচে থাকা তাহলে কী বুঝতে পারি? এইসব
উপাদানগুলি আমাদের জীবনেও অপরিহার্য। পৃথিবীতে নিজেদের জীবন সুন্দর ও সুরক্ষিত
করতে গেলে আমাদের দূর্বা কিংবা জুনের মতো ক্ষীণ ঘাস লতা থেকে বট-অশ্বত্থের মতো বড়ো বৃক্ষের
প্রয়োজন আছে। খাওয়ার জন্য যেমন ধান, চাল, দুধ দরকার তেমনি দরকার পবিত্র অর্থাৎ
বিশুদ্ধ জল। পাশাপাশি নান্দনিকতার জন্য দরকার ফুল। তার মানে দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর উপাসনার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আমাদের
প্রকৃতির এইসব উপাদানগুলির ওপর নজর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আবার আমরা যদি আমাদের
দেবদেবীদের বাহনের দিকে তাকাই দেখতে পাব অসংখ্য দেবতার বাহন বিভিন্ন পশুপাখি।
সেখানে যেমন সাধারণ ঈঁদুর রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাঘ-সিংহ, ময়ূরের মতো পাখির
পাশাপাশি কাক-পেঁচারাও কোনো না কোনো দেবদেবীর বাহন। তার মানে দেবদেবীরাও
আমাদের এইসব প্রাণীকূলের যত্ন ও রক্ষার ঈঙ্গিত দিয়েছেন। বাহন মানে কেবল বহন করা নয়।
অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি তার পিঠে করে যাত্রা নয়। আমার মনে হয় এইসব পশুপাখিদের বাহন
করে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, আমরা মানুষেরা যতই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হই না কেন,
পৃথিবীতে আমাদের জীবনধারাকে সুন্দরভাবে বহন করতে এইসব পশুপাখিদেরও দরকার। এদেরকে
অস্বীকার করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং, আমরা যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে
দেখতে পাবো ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্যে দিয়েও কোথায় যেন একটা প্রকৃতির বার্তা দেওয়া
হয়েছে। তাকে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে।
সবকিছু
সরিয়ে রেখে বলি, প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করে আমরা নিজদেরই বিপদ ডেকে আনছি। বিজ্ঞানের
বলে আমরা বলীয়ান হয়েছি ঠিকই কিন্তু আমাদের বোধ চেতনা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই
প্রকৃতির ধ্বংস সাধনে আমরা হাতে তুলে নিয়েছি বিজ্ঞানের খড়্গ। তবে বিজ্ঞানকে দোষ
দিয়ে লাভ নেই। বিজ্ঞান কথার অর্থ বিশেষ জ্ঞান। আমাদের সেই জ্ঞানের প্রকাশ কি সত্যি
সত্যি হচ্ছে? আজ পৃথিবীর যে অবস্থা তার জন্য দায়ী কে? আমরাই। বোকা কালীদাসের গল্প
আমরা অনেকেই জানি। সেই কাজ কি আমরাও করছি না? নিজেদের অস্তিত্বের ধ্বংস ডেকে আনে এমন কাজকে বোকামি ছাড়া আর কী বা বলা
যায়? তাহলে কি বিজ্ঞানও ঘুমিয়ে পড়েছে?
আমার মনে
হয় ঈশ্বর কিংবা বিজ্ঞান কেউ ঘুমোয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছি আমরাই। ঈশ্বর এখন ভীষণভাবে
জেগে আছেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে জেগে আছে বিজ্ঞানও। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা লড়াই করে
যাচ্ছে সভ্যতাকে সংকটমুক্ত করার। এই সংকট হয়তো একসময় কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের
ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বা যদি এরপরও না জেগে ওঠে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ঘোর সংকটের
মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। বিখ্যাত মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও
সমাজ সমালোচক নোয়াম চোমস্কি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, করোণা পরবর্তী সময়ে আমাদের
জীবনে দুটি ভয়াবহ পরিস্থিতি আসতে চলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরমাণু যুদ্ধ। বিশ্ব
উষ্ণায়নের মারাত্মক প্রভাব ইতিমধ্যেই আমরা বেশ পেতে শুরু করেছি। আর পরমাণু যুদ্ধ
হলে মানব সভ্যতা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপরও আমরা
নিজেরা দূরে সরিয়ে রাখব আত্মসমালোচনা থেকে?
ঈশ্বর জেগে
আছেন। হয়তো চেষ্টা করছেন নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার, নিজের ক্ষতগুলো যতটা সম্ভব
সারিয়ে তোলার। বিজ্ঞানও জেগে আছে। করে যাচ্ছে মরণপন লড়াই। কিন্তু আমাদের ঘুম
ভাঙবে কবে? করোনারূপী এই
অতিমারী যে বিশ্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে তা কি আমাদের চেতনার ঘুম ভাঙাতে পারবে?
গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন, Force is not a solution. তিনি
বলেছিলেন, “Nonviolence is the
greatest and most active force in the world.” এই সত্য কি আমরা বুঝতে পারব? মারাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় না নেমে, একে
অপরের ওপর আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা না করে আমরা কি এবার বুঝতে পারব সহযোগিতা,
সহমর্মিতা আর সংযমই হল অস্তিত্বের মূল মন্ত্র? তা যদি হয়, করোনার বিশ্ব বিপর্য়য়ের
পরও সেটাই হবে আমাদের বড়ো প্রাপ্তি।
এখন তাই
আমাদেরই ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়। তা নাহলে সত্যি সত্যি একদিন ঈশ্বর ঘুমিয়ে যাবেন।
সেদিন বিজ্ঞানেরও অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। এখন আমাদেরই
সচেতন হওয়া দরকার যেন ঈশ্বরের চোখে ঘুম না আসে।
No comments:
Post a Comment