ঈশ্বর নন, ওরা মানুষ...

আমাদের
মধ্যে অনেকে ঈশ্বর বিশ্বাস করেন, অনেকে করেন না। যে যার
বিশ্বাস তার নিজের মতো। আমি কারও বিশ্বাস নিয়ে কিছু বলতে চাই না।
ঈশ্বর কিংবা ধর্মীয় উপাসনা নিয়ে যে যার নিজের মতো বিশ্বাস করার অধিকার রয়েছে।
আমাদের দেশের সংবিধানে যে ছয়টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল ধর্মীয়
স্বাধীনতার অধিকার (২৫ থেকে ২৮ নং অনুচ্ছেদ)। যেখানে বলা
হয়েছে দেশর প্রতিটি নাগরিক জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে নিজ নিজ ধর্ম আচরণ করতে পারবে। তাই যে যার মতো করে ধর্মাচারণ করতেই পারেন।
আবার কেউ ধর্ম বা ঈশ্বর বিশ্বাসী নাও হতে পারেন। একের বিশ্বাস
নিয়ে অন্যের কিছু বলার অধিকার নেই। নিজ
নিজ বিশ্বাসের নিরিখে যুক্তি খাড়া করে অন্যকে ভুল প্রমাণিত করা কিংবা তাকে আঘাত
দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। যাই হোক, এই লেখার বিষয় মানুষের ধর্মবিশ্বাস নয়। ধর্ম আর বিজ্ঞান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করে কিছু
মানুষ কোনো একটি বিশেষ যে সিদ্ধান্তে আমাদের মন আকর্ষণ করতে চাইছে সেটাও আমার
লেখার বিষয় নয়। আমি লিখতে চাইছি সেইসব মানুষদের কথা যারা এই ভয়ংকর
বিপর্যয়ে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে চলেছেন।
করোনা
ভাইরাস মোকাবিলার প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী একদিনের জনতা কার্ফুর ডাক
দিয়েছিলেন এবং দেশবাসীকে অনুরোধ করেছিলেন ওই দিন বিকাল পাঁচটায় শাঁখ, ঘন্টা
বাজাতে। না থাকলে থালা বাজাতে। হাতে তালি
দিতে। করোনা মোকাবিলায় যাঁরা একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে
লড়াই করছেন যাকে বলে Front-Line Warrior (এই লেখা কেবল চিকিৎসাক্ষেত্রে জড়িতদের নিয়ে) তাদের সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা
জানাতে। সমগ্র দেশবাশী বিপর্যয়ের সময় এক আছে, পাশাপাশি সেই সব
সৈনিকদেরও পাশে আছে, এমন একটা বার্তা তিনি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, আজও হচ্ছে, আগামী দিনেও হয়তো হবে। সেসব বিতর্কের কথা এখানে থাক। এই সিদ্ধান্ত
ঠিক না বেঠিক আমি জানি না। কিন্তু দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে আমি সেদিন বাড়ির ছাদে উঠে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে
হাততালি দিয়েছিলাম আর মনে মনে আকুলভাবে প্রার্থনা করেছিলাম ওই সব বীর যোদ্ধারা
যেন ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। ওরা যেন হেরে না যান। আমি জানি আমার
এই নীরব বার্তা কারও কাছে পৌঁছোবে না, পৌঁছোয়ওনি। কোথাও যেন মনে
হচ্ছিল এ-বার্তা আসলে নিজেকেই দেওয়া। নিজের দুর্বল মনে একটু সাহস ফিরিয়ে আনা।
সত্যি বলতে কি, ওই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক অনুভব হচ্ছিল নিজের মধ্য।
মনে হচ্ছিল আমি একা নই। এও বুঝতে পারছিলাম কোনো এক জায়গায় গিয়ে আমরা সবাই এক।
ধর্ম, অর্থ, রাজনীতি সবকিছু ছাড়িয়ে অদ্ভুত এক মানবতার ঐক্য অনুভব করেছিলাম নিজের
মধ্যে। আর তখন মনের মধ্যে বারবার একটাই ভাবনা ঘোরাফেরা করছিল, সত্যিই তো এরাই আমাদের একমাত্র
ভরসা। এরা ছাড়া আমাদের পাশে আর
কে আছেন? তবুও এদেরকে আমি ঈশ্বর বলতে রাজি নই।
ওরা ঈশ্বর
নন। জানি আমার কথা কারও খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু এই
মতামত আমার একান্ত ব্যক্তিগত। ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেডিক্যাল
স্টাফ সকলেই ভয়ংকর এই যুদ্ধে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে চলেছেন।
তাদের আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। সকলের জন্য
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা কামনা করি। তবুও আরও অনেকের মতো তাদের ঈশ্বর বলতে পারি না।
পূর্বেই
বলেছি যে যুদ্ধ ওরা লড়ছেন সেটা ভয়ংকর। প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি। ইতিমধ্যেই
আমরা জেনেছি সারা বিশ্বে অসংখ্য চিকৎসক ও চিকিৎসাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এই যুদ্ধে তাদের সামর্থ খুব সীমিত এবং সীমাবদ্ধ।
হাতে নির্দিষ্ট কোনো অস্ত্র নেই। প্রতি পদে পদে নানাবিধ প্রতিকূলতা।
এতকিছু সত্বেও তারা লড়াই করছেন। আত্মবিশ্বাসমাখা কন্ঠে আমাদের বার্তা দিচ্ছেন---‘এই
যুদ্ধ আমরা জিতবই। করোনাকে আমরা হারাবোই।’
ভাইরাসের ভয়ে আমরা যখন প্রতিটি মুহূর্তে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে ঘরের মধ্যে সময় কাটাচ্ছি,
তখন একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তারা আমাদের জীবনের আশ্বাস দিচ্ছেন, আমাদের
বেঁচে থাকার ভরসা জোগাচ্ছেন। বলছেন, ‘আপনারা ঘরে থাকুন। বাইরে তো
আমরা আছি। এ-যুদ্ধে আমাদেরই জয় হবে। We shall overcome.’ তাদের গলার আত্মবিশ্বাসী
সুর শুনলে আমাদের দুর্বল মনও চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
যুদ্ধটা
ওরা লড়ছেন। সংসার, পরিজন থেকে দিনের পর দিন দূরে থেকে, অদৃশ্য শত্রুর মাঝে দাঁড়িয়ে
যারা আমাদের কাছে জীবনের জয়গানের বার্তা পাঠান, তাদের যদি এককথায় ঈশ্বর বলে দিই,
তাহলে তাদের এই লড়াই, অকুতোভয় মানসিকতা, তাদের মহত্ব আর ত্যাগকে বোধহয় ছোটো
করা হবে। ঈশ্বর কেমন আমি দেখিনি। কিন্তু আমরা
বিশ্বাস করি ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে যাকে আমরা ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলি।
ঈশ্বরের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। কিন্তু যারা এই ভয়ংকর লড়াইটা লড়ছেন তাদের কাছে কি
কোনো ঐশ্বরিক কিংবা অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে? নেই। থাকলে তো এই
আতঙ্ক আর হাহাকারের প্রহর গুনতে হত না। আবার
ঈশ্বর তো সর্বশক্তিমান। তার অসীম ক্ষমতা। কিন্তু এইসব মানুষ কি সেই সেই অসীম
ক্ষমতার অধিকারী? একদমই
নয়। তাদের ক্ষমতা অনেকটাই সীমিত এবং সীমাবদ্ধ। তবুও তারা লড়াইয়ের ময়দান থেকে
পিছিয়ে আসেননি।
সত্যিই, তাদের
কাছে লড়াই করার মতো নির্দিষ্ট অস্ত্র নেই। শত্রু অদৃশ্য এবং
অনেকটাই অচেনা। যাকে নিধন করার হাতিয়ার খুঁজতে খুঁজতে গবেষকদের দিনরাত
একাকার হয়ে যাচ্ছে। আর সেই শত্রুর কাছে ওরা হার মানেননি। লড়াই চালিয়ে
যাচ্ছেন। ভাইরাসের মারণ থাবায় অনেক মানুষ
যেমন মারা গেছেন, তেমনি অসংখ্য মানুষকে তারা এই ভাইরাসের গ্রাস থেকে ছিনিয়ে পুনরায়
নিয়ে এসেছেন সুস্থ জীবনের আলোয়। এ-কোনো
ঐশ্বরিক কিংবা অলৌকিক কাজ নয়। এ-কাজ দুঃসাহসিক, আতিমানবিক। আর এই জায়গায়
দাঁড়িয়ে তাদের ঈশ্বর বলে দিলে আমার মনে হয় তাদের এই অতিমানবিক, দুঃসাহসিক লড়াইকে
ছোটো করা হয়। এভাবে তাদের প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয় না। নিজেদেরই
একজন ভেবে মানুষের মধ্যে থেকে যদি তাদের বিচার করি তাহলে অনুধাবন করতে পারব আমাদের
মতো একজন হয়েও তারা আলাদা, অনন্য এবং অসাধারণ। আমার মনে হয় তারা এক-একজন বীর
যোদ্ধা, অসম সাহসী সেননী। যারা জেদ, সদিচ্ছা আর হার-না-মানা মানসিকতাকে সম্বল
করে লড়াই করতে করতে সাধারণ মনুষ থেকে ঈশ্বরভাবে নিজেদের স্থাপিত করেছেন। এমন ঈশ্বর
যাদের দেখা পেতে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে যেতে হয় না। তারা থাকেন
আমাদের আশেপাশে, আমাদের মাঝে। আমার মতে তারা ঈশ্বর নন, ঈশ্বর-মানুষও নন।
তাঁরা হলেন মানুষ-ঈশ্বর।
শেষে একটি কথা না
বললেই নয়। ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মের একটি সম্পর্ক রয়েছে। ধর্ম নিয়ে
বিস্তারিত কোনো আলেচনায় না গিয়ে খুব সংক্ষেপে একটি কথা বলার, ধর্ম হল সেই জিনিস
যা মানুষকে তার নিজের কর্ম এবং কর্তব্যপথে সুন্দর ও সুচারুভাবে চালিত করে।
স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, “ধর্ম হল এমন একটি ভাব যা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।”
বর্তমান কঠিন সময়ে যে মানুষেরা বহুবিধ প্রতিকূলতা সঙ্গে নিয়ে এই অসম যুদ্ধে নিজ
নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন তারা নিজেদের অজান্তেই আমাদের
কাছে মানুষ থেকে দেবত্বে উন্নীত হয়েছেন। আর একটি কথা, ঈশ্বর শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা
হল, যিনি সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন। আমাদের কাছে জীবনের থেকে সুন্দর আর কী হতে পারে? আর বর্তমানের বিশ্ব বিপর্যয়ের মুখে দাড়িয়ে
বিশ্বব্যাপী মৃত্যু মিছিল দেখেতে দেখতে আমরা আরও বেশি বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছি
জীবন কত সুন্দর। এই অশান্ত সময়ে চিকিৎসাক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত ওই সকল মানুষেরা
জীবনের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার যে চেষ্টা করে চলেছেন, সে তো সুন্দরেরই ফুল
ফোটানোর কাজ। সেই নিরিখে যদি বিচার করি, তাহলে নিজের মতামত থেকে সরে এসে তাদের
ঈশ্বর বলতে হয়তো বাধা থাকে না।
No comments:
Post a Comment