Friday, April 3, 2020

নির্বাসনের রোজনামচা-২



জীবন যখন গল্পকেও হার মানায়....

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ঠাকুমার দিকে চেয়ে আছে শর্মি আর সঞ্জুঠাকুমার প্রিয় দুই নাতি নাতনি। বয়স সাত-আট বছর। তাদের চোখে একরাশ অবিশ্বাস বিস্ময়। ঠাকুমার কথা তারা একদম বিশ্বাসই করতে পারছে না। কী করে বিশ্বাস করবে! এমন কথা কি কউ বিশ্বাস করতে পারে? না ঠাকুমার ঝুলি তারা পড়েনি। রূপকথার রাজা-রানী, রাক্ষস-খোক্ষস কিংবা পরীদের গল্প তারা শোনেনি। তবে এদের কথা তারা জানে না এমন নয়। একটু-আধটু জানে। সেইসঙ্গে এটাও তারা জানে যে এসব আসলে আজগুবি কথাবার্তা। যতই ছোটো হোক, বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়ে তারা। এই বয়সেও তারা বুঝতে পারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নততর রূপ প্রযুক্তিনির্ভর জীবন উন্নত থেকে আরও উন্নত হয়েছেপৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে মানুষের পাড়ি দেওয়ার কথা এখন আর গায়ে রোমাঞ্চ জাগায় না। বরং এটা ভেবে তারা কল্পনায় উত্তেজিত হয়, হয়তো সত্যি সত্যি কোনোদিন এই পৃথিবী ছাড়িয়ে সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহেও মানুষ বসবাস করবে। পৃথিবীর সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হবে। কল্পবিজ্ঞান গল্পে পড়া কথাগুলো সত্যি হয়ে দেখা যাবে সত্যি সত্যি মানুষ ছুটি কাটাতে আত্মীয়বাড়ি যাওয়ার জন্য কিংবা ভিনগ্রহে বেড়িয়ে আসার জন্য অনলাইনে স্পেশশিপের আগাম টিকিট বুকিং করে রাখছে। আর এসবে তারাও যদি অংশ নিতে পারে, তাদের কোনো প্রতিবেশী যদি ভিনগ্রহে বাস করে কিংবা তারা নিজেরা যদি সেই ভিনগ্রহের বাসিন্দা হতে পারে, তাহলে জীবনটা কী চমৎকার না হবেই, এসব ভাবতে ভাবতে তারা উত্তেজিত রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ে। এরকম আরও কতকিছু তাদের মাথায় খেলা করে।
    না, এটা কোনো কল্পবিজ্ঞানের লেখা নয়। এমন নয় আজ থেকে একশো বছর পরের কোনো সময়ে গিয়ে কোনো কাহিনির প্রেক্ষাপট খাড়া করছি। এই লেখা এই শতাব্দীর। তবে হ্যাঁ, সময়ের থেকে কিছুটা এগিয়ে। ধরা যাক, দশ-বিশ বছর পেরিয়ে। সেটাও আবার অনেকটা বাধ্যবাধকতার কারণে। কেননা আজকের সময়ে কোনো চরিত্র নিয়ে এই লেখার শুরুটা লেখা যায় না। কেননা বর্তমান প্রজন্মের প্রায় সবাই, বিশেষ করে যারা একটু আধটু বুঝতে শিখেছে তাদের কাছে নতুন করে কিছু বলার নেই। কেননা তারা জানে পুরো ব্যাপারটা। তাই সময়ের থেকে একটু এগিয়ে যেতে হল।
    সে যাই হোক, ঠাকুমার কথা তাদের বিশ্বাস হয় না। শর্মি বলে, ঠাকুমা, তুমি আমাদের ছোটো ভেবে কি বোকা ভেবেছ? এমন কখনও হয় নাকি?
    হয় নাকি মানে! সত্যিই হয়েছিল
    ধুস, তুমি মিথ্যা বলছ আমাদের বোকা বানাতে চাইছ সঞ্জু প্রতিবাদ করে।
    তোদের কাছে আমি মিথ্যা বলতে পারি? তাহলে ধরা পড়ে যাবো না? আমার কথা বিশ্বাস না হয় তোদের বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করবি।
    শর্মি আর সঞ্জু কিছুতেই মানতে পারে না ঠাকুমার কথাগুলো। আবার পুরোপুরি উড়িয়েও দিতে পারে না। এটা সত্যি ঠাকুমা কোনোদিন তাদের মিথ্যা কথা বলে না। কিন্তু এ-আবার কী কথা! তারা বইতে পড়েছে পৃথিবীতে দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক রূপের কথা তারা জানে। কিন্তু ঠাকুমা এসব কী বলছে! সত্যিকারের বিশ্বযুদ্ধ নাকি এই পথিবীতে একবারই মাত্র ঘটেছিলতাও খুব বেশিদিন নয়, মাত্র কয়েক বছর আগে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধ যেখানে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ জড়িয়ে পড়েছিলসে নাকি এক অদ্ভুত যুদ্ধ। যে যুদ্ধে কোনো দেশ কারও বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। কেউ কারও বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করেনি। তা কখনও হতে পারে! তারা মানতে পারে না। যুদ্ধ মানে তো অস্ত্রের ব্যবহার। আর মানুষের হাতে এত এত ভয়ংকর, আধুনিক অস্ত্র থাকতেও তারা ব্যবহার করেনি! এমনটা কী করে হয়! অস্ত্র যদি যুদ্ধেই না লাগে তাহলে অস্ত্র তৈরির দরকারই বা কেন? তাছাড়া অস্ত্র ছাড়া কি যুদ্ধ করা যায়?
    তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না সারা বিশ্বের একটা বিরাট অংশের মানুষ মাসের পর মাস নিজেদের গৃহবন্দী করে রেখেছিল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল। জীবন থমকে গিয়েছিল। স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলরাস্তাঘাটে কোনো যানবাহন চলত না। নদীতে জাহাজ কিংবা আকাশে উড়োজাহাজ, কিছুই না। পৃথিবীটা সহসা থমকে গিয়েছিল।
    এরকমটা হতে পারে! আজ যখন মানুষ প্রায় প্রতিদিন হুসহাস করে মহাকাশে যান পাঠাচ্ছে, সেই মানুষ মাত্র কয়েক বছর আগে সব ছেড়েছুড়ে একেবারে স্বেচ্ছা নির্বাসনে! তাও আবার এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে যে নাকি এতটাই ক্ষুদ্র তাকে দেখার জন্য শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। সত্যিই আশ্চর্য। মানুষের এত ক্ষমতা অথচ সামান্য এরকম একটা ক্ষুদ্র প্রাণীর বিরুদ্দধ মানুষ লড়াই করতে পারল না!
    ঠাকুমা বলে, প্রকৃতির কাছে মানুষের ক্ষমতা সামান্য
    শর্মি আর সঞ্জুর বিশ্বাস হয় না। তাদের মনে হয় ঠাকুমা ভুল বলছে। বয়স হয়েছে, হয়তো সেই জন্য।
    ঠাকুমার আর নাতি-নাতনির মধ্যে নির্ভেজাল তর্ক শুরু হয়ে যায়। চলতে থাক এই তর্ক। আমরা তো জানি সত্যিটা কি। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আগামীও একদিন এই সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে।

    যাই হোক, শর্মি কিংবা সঞ্জুর বিশ্বাস না হওয়া স্বাভাবিক। তারা তো আগামীর বর্তমানের আলোকবঞ্চিত। কিন্তু আমরাও কি কখনও বিশ্বাস করতে পেরেছিলাম, এমন কোনোদিন আসবে যেদিন স্বাভাবিক জীবন ছন্দ ভুলে আমরা আশ্রয় নেব ছোট্ট ঘরের মাঝে? একটি কথা এখন প্রায়শই শোনা যায় বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু এখন নিজের ছোট্ট ঘরটাই আমার পৃথিবী, আমার বেঁচে থাকার নিরাপদ আশ্রয়।
    বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে আমাদের জীবন। কিন্তু পুরোপুরি ভয়মুক্ত হয়নি কখনও। যেভাবে দেশে দেশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়ছে, মারাত্মক সব অস্ত্র তৈরি হচ্ছে, অকস্মাৎ যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তাতে মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয়, কখনও নিজের অজান্তেই হয়তো কোনো অস্ত্রের আঘাতে পৃথিবী থেকে ছুটি হয়ে যাবে। সেই ২০১২ খ্রিস্টাব্দে মায়া ক্যালেন্ডারের ভয়ংকর হিসাবেও মনের মধ্যে ভয় জমে গিয়েছিল। তখনও মনে হয়েছিল হয়তো সত্যি সত্যি ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। আবার এখন প্রায়শই গ্রহাণুর হানার খবরে চমকে উঠি। কোনোদিন কোনো এক বিরাট গ্রহাণু এসে পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে মানব সভ্যতা। এই ভয়ও মাঝে মাঝে পাই। এরকম আরও কতকিছু ভয়ের উপকরণ মাঝে মাঝে হাজির হয়। কিন্তু সত্যি সত্যি ভয় পেতাম কি? কেননা সেসব খবরেও জীবন থমকে যায়নি। যেমনটা এখন হচ্ছে।
    সত্যিই এখন এক ভীষণ ভয় নিয়ে দিন কাটছে। ভয়ের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি রোজকার জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো। এখন সম্পূর্ণ গৃহবন্দী। জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ঘরের মধ্যে। এতো আসলে একপ্রকার নির্বাসন। বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া চার দেওয়ালের ক্ষুদ্র গণ্ডীতে। স্বেচ্ছা নির্বাসন বলে যতই ব্যাপারটা হালকা করতে চাই না কেন কিংবা নিজের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে যাই না কেন, আসলে ভয় পেয়েছি। আর আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এই ভয়ের সঙ্গে যতটা না মৃত্যু জড়িয়ে আছে তার থেকে বেশি জড়িয়ে একরাশ আতঙ্ক আর অবিশ্বাস। একটা অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস। কখন, কোথা দিয়ে কীভাবে যে শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়বে তা কেউ জানে না। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো অস্ত্র নেই। তাকে হারানোর একটাই অস্ত্র, কিছুতেই তাকে কাছে আসতে দেওয়া যাবে না। প্রতিটি মুহূর্তে তাই একটা অবিশ্বাস, আমার অজান্তে আমার আশেপাশে হাজির হয়ে যায়নি তো ছোট্ট সেই ভয়ংকর দানব? ভয়টা এখানেই। মৃত্যু ভয়ের থেকেও যে ভয় আরও মারাত্মক। এ-এমন এক ভয় যা জীবনের ছন্দকে নষ্ট করে দেয় প্রতিটি মুহূর্তে। এমন এক অদ্ভুত জীবন যা নিজের কাছেই অচেনা হয়ে ওঠে। জানি না এরকম জীবন চলবে কতদিন। প্রতিটি মুহুর্তে নিজের সঙ্গে কঠিন লড়াই। বাইরে শত্রু, ঘরেও। নীরবে চলছে স্নায়ু যুদ্ধ। সময় এখন ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
    জীবনের ছন্দ থমকে গেছে। কিন্তু তার সাথে সাথে ভাবনারা যদি থমকে যায় তাহলে হয়তো জীবনটাই বোঝা হয়ে উঠবে নিজের কাছে। তাই এই অদ্ভুত অবসরে, তথাকথিত নির্বাসনের দিনগুলিতে, রোজকার দেখা টুকরো টুকরো কিছু ছবি লিখে রাখার চেষ্টা এই ডায়েরিতে।
    বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। বই পড়া, লেখালিখিতেও ঠিকঠাক মন বসছে না। মাঝে মাঝেই ছদ্ন হারিয়ে যাচ্ছে। দেখব না দেখব না করেও বেশ কিছুটা সময় চলে যায় টিভির পর্দায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায়। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং নয়, আসলে আমরা ফিজিক্যাস ডিসটেন্সিং মেনটেন করছি। সামাজিকভাবে আমরা কাছাকাছি আছি, থাকবও। সত্যি কথা বলতে, দূরে দূরে থেকে আজ আমরা একসূত্রে নিজেদের বাধার চেষ্টা করছি। এই প্রথম বোধহয় আমাদের প্রায় সকলের ভাবনা, চিন্তা আর মিলেমিশে একাকার। তাহলে কী করে বলে আমরা দূরে দূরে আছি? আসলে আমরা এখন আরও বেশি কাছাকাছি আছি।

No comments:

Post a Comment