ঈশ্বরকে
আশীর্বাদ করা যায় না....

অর্পণের
সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন বুঝিয়ে বলতে পারব না। ও আমার ছাত্র
নয়। আমার ভাইও নয়। কিন্তু কেউ একজন তো বটেই। বয়সের ব্যবধান
অস্বীকার করে অর্পণকে বন্ধু বলতে আমার কোনো বাধা নেই। কলেজ জীবন থেকে
ছাত্রপড়ানো শুরু। দীর্ঘ বেকারত্ব জীবনে কত ছাত্রছাত্রীকে যে পড়িয়েছি তার হিসেব
নেই। তাদের অনেকেই আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত। আশ্চর্যের বিষয় সেইসব
পুরোনো ছাত্রছাত্রীদের অনেকের সঙ্গে এখনো নিয়মিত যোগাযোগ আছে। প্রথমদিকের
ছাত্রছাত্রীরা দাদা বলেই ডাকত। যাই হোক, তাদের সঙ্গে যে একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক
গড়ে উঠেছিল তা আজও রয়ে গেছে।
অর্পণের
সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একটু অন্যভাবে। আমাদের একটি সংগঠন আছে ড্যাফোডিল নামে। অখণ্ড
মেদিনীপুর জেলার প্রথম কুইজ ক্লাব। সৌমাল্য, উত্তরণ, শুভ্র, অতনু, নির্মাল্য,
প্রিয়ঙ্কর, কল্যাণ এরকম কিছু সদ্য উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ছেলে এই সংগঠন গড়ার
উদ্যোগ নেয় এবং আমাকে তাদের সঙ্গে নেয়। তারপর থেকে এর সঙ্গে আমি গভীরভাবে জড়িয়ে
পড়ি। আমার ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও আরও অনেক ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন
সময়ে এই সংগঠনে যোগ দিয়েছে। অর্পণ তাদেরই একজন।
অর্পণ
মেধাবী। খুব ভালো ছবিও আঁকে। অত্যন্ত ভদ্র,
বিনয়ী আর ধীরস্থির। এককথায় খুব ভালো ছেলে। আমাকে খুব
শ্রদ্ধাও করে। এখনও মনে পড়ে একবার বইমেলায় ও আমাকে খুব আগ্রহ সহকারে ডেকে
নিয়ে গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আমার মা আপনার সঙ্গে
দেখা করতে চায়।’ দেখা করার পর
ওর মা বলেছিল, ‘আপনার কথা
ছেলের মুখে অনেক শুনেছি।’ আমাকে নিয়ে
বলার মতো কিছু নেই আমি জানি। সবটাই
অর্পণের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।
খুব বেশি
না হলেও আমার বাড়িতে বেশ কয়েকবারই এসেছে অর্পণ। নিয়মিত
কথাবার্তা না হলেও যোগাযোগ আছে। শেষবার আমার বাড়ি আসে সম্ভবত এ-বছর বিজয়া দশমীর দিন।
তখনই আমরা ওকে হবু ডাক্তার বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিলাম। ডাক্তারির
ছাত্র আর্পণ। পাশ করার আর মাত্র কয়েকটা মাস বাকি ছিল।
মাস দুই
আগেও নয়, ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয় অর্পণ।
লেখে, “Passed the final year of MBBS. It’s
Arpan Bera from today and forever. The hard work of 4.5 years pays off. Thanks
to my parents, professors, friends and well-wishers who helped me and kept me
motivated. It’s one of the best days in my life.” পোস্টের সঙ্গে
একটা লাল-কালো কলমের ছবি। তাতে লেখা DR. ARPAN. ‘আলোকময়
হোক আগামীর পথচলা’ বলে সেদিনই ওকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম।
না দেখতে পেলেও ওর আনন্দ আর খুশিমাখা উজ্জ্বল মুখটা আমি স্পষ্ট অনুধাবন করতে
পারছিলাম।
সেদিনের পর
আর অর্পণের সঙ্গে কথা হয়নি। তারপর সময়গুলো অদ্ভুতভাবে দ্রুত বদলে যায়।
পঁচিশে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ। ভারতবর্ষের
বুকে এমনকিছু ব্যাপার ঘটতে থাকে যার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না।
এতদিন শুনে আসছিলাম চীনে করোনা নামে এক ভাইরাসের আক্রমণে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত,
মারাও গেছে অনেক মানুষ। চীন ছাড়িয়ে আরও কিছু কিছু দেশে তার তাণ্ডব শুরু
হয়েছে। আমরা তখনও সেভাবে ভয় পেতে শুরু করিনি। যদিও আমাদের
দেশেও তার আগমনের বার্তা পৌঁছে যায়। আমরা স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছি, আনন্দ করেছি, রংয়ের
উৎসবে আনন্দে মেতেছি সবকিছুই হয়েছে। কিন্তু মার্চ গড়াতে না গড়াতে একটা অশুভ ইঙ্গিত আসতে
শুরু করে। আমাদের রাজ্যের বেশকিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ
হয়ে যাওয়ার খবর কিছুটা নাড়িয়ে দেয় আমাদের। মাস্ক ব্যবহার, নিয়মিত হাত ধোওয়া,
নাকে-মুখে হাত না দেওয়া এইসব নির্দেশ আসতে থাকে। উদ্বেগ একটু
বাড়লেও তখনও ততখানি ভয় পাইনি। রোজকার কাজকর্ম করে গেছি। এরই মধ্যে মার্চের বারো-তেরো তারিখে সরকারি নির্দেশ
আসে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে করোনা বিষয়ে সচেতনতা সেমিনার করার। ১৪ মার্চ সেমিনার করে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই জানতে
পারি সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে মার্চের ৩১ তারিখ পর্যন্ত স্কুল বন্ধ। পরে সেই
সময়সীমা বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এবার মনের মধ্যে একটা
আতঙ্ক এসে দানা বাঁধতে শুরু করে। তবুও সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শুনে মনে হয়েছিল
বোধহয় ঠিক হল না। আর একটু অপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো হত।
কিন্তু দিন কয়েক গড়াতে না গড়াতে বুঝতে পারি আমার বা আমাদের ভাবনা কতখানি ভুল ছিল।
যেদিন এই
ঘোষণা হল সেদিন স্কুল ফেরত আমি কলকাতা যাই। ফিরে আসি তিনদিন পর।
এর মধ্যে করোণার ভাবনা আমাদের রাজ্যে জোর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে।
আমরা ভয় পেতে শুরু করেছি। দেখতে দেখতে রাজ্য তথা গোটা দেশে অনেককিছু ঘটে যেতে
থাকে। এক এক করে সমস্ত বোর্ডের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু তখনও পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা বাতিল হয়নি।
শরীরটা কদিন ভালো যাচ্ছিল না। এদিকে মাধ্যমিকের খাতা দেখা আর স্ক্রটিনির দায়িত্ব
রয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারি নির্দেশ মেনে স্কুলেরও কিছু কাজ করতে
হচ্ছে। কলকাতায় ছেলে আর স্ত্রী। না পারছি
কলকাতা যেতে, না পারছি ওদের ফিরে আসতে বলতে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ
এমন হতে থাকে সত্যি সত্যি খুব ভয় পেতে শুরু করি। এরই মধ্যে
কলকাতায় প্রথম করোনা পেশেন্ট ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য সেই ছেলেটি প্রথম এম-আর বাঙ্গুরে যায়।
আর আমার ছেলে এম-আর বাঙ্গুরের প্রায় কাছাকাছি থাকে। ওই হাসপাতালের সামনে দিয়ে ওকে
পরীক্ষা দিতে যেতে হয়। এই ব্যাপারটা টেনশান বাড়িয়ে দেয়। দুশ্চিন্তায় রাতে ঠিকঠাক
ঘুম হত না। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী একদিনের জনতা কার্ফু ঘোষণা করেন।
ব্যাপারটা কি আমার ধারনা ছিল না। কিন্তু এই কার্ফু জারি হতে বুঝতে পারি ব্যাপারটা
কতটা সিরিয়াস। ইচ্ছে করছিল পরীক্ষা না দিয়েই ছেলেকে ফিরে আসতে বলি।
সত্যি বলতে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। যাই
হোক, শেষমেষ ২১ তারিখ পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা হয়। ছেলেরা ফিরে
আসে ওইদিন। মানসিক একটু
শান্তি খুঁজে পাই।
জনতা
কার্ফুর পরপরই দেশে লকডাউন ঘোষণা হয়। একেবারে গৃহবন্দী জীবন। একেবারে
অন্যরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। ঘরে বসে বই পড়া, লেখালিখি, মাঝে মাঝে টিভি দেখা আর
স্যোশাল মিডিয়ায় উঁকিঝুকি মারা, এইভাবে সময় কাটছিল। না, তখনও আমার
অর্পণের কথা মনে পড়েনি। সহসা একদিন ফেসবুকে ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা এক নার্সের পোস্ট
পড়লাম। স্বামী, সংসার আর সন্তান ছেড়ে তাকে ডিউটি করতে হচ্ছে।
তবুও তিনি লিখেছেন, ‘আমরা
বাইরে আছি। আমাদের ঘরে থাকার উপায় নেই। কিন্তু
আপনাদের সে সুযোগ আছে। আপনারা ঘরে থাকুন। আপনারা ঘরে
থাকলে আমাদের কাজ সহজ হবে।’ তার লেখাটা
পড়ে সত্যি মনটা খারাপ হয়ে যায়। বুঝতে পারি তার মতোই কত নার্স, ডাক্তার আজ এমন
ত্যাগ স্বীকার করে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে চলেছেন। আর তখনই মনে
পড়ে অর্পণের কথা। মনটা চঞ্চল হয়ে উঠে। একটু খারাপও লাগে এতদিন
তার কথা কেন মনে পড়েনি ভেবে। তক্ষুণি তাই মেসেজ করি।
একটু পরে
অর্পণের জবাব এল, ‘স্যার ভালো
আছি। আমাদের ডিউটি অফ নেই। কাজ চলছে।
আমিও কাজ করে যাচ্ছি।’ অর্পণ জানতে
চাইল আমি কেমন আছি ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের কথা জানিয়ে ওকে বললাম, ‘ভালো থেকো।’ এর থেকে বেশি কিছু কী লিখব ভেবে পেলাম না।
অর্পণ লিখল, ‘স্যার অনেক ভয় নিয়ে
কাজ করছি। আশীর্বাদ করবেন।’
মেসেজটা
পড়ে বুকটা কেমন করে উঠল। কী জবাব দেব প্রথমটা ভেবে পাচ্ছিলাম না।
হাত স্থির হয়ে গেছে। বুকের মাঝে ভাষাও যেন হারিয়ে গেছে।
কিন্তু কিছু তো লিখতে হয়। তাই দুচারটে কথা লিখি। শেষে বলি, ‘ভয় পেয়ো না। তোমরা ভয়
পেলে আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব। সচেতন থাকো সবসময়। সব ঠিক হয়ে
যাবে।’
কথাগুলো
বলা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তবটা অনেক কঠিন। গৃহবন্দী
থেকেও যে ভাবে আতঙ্ক আর অবিশ্বাসের জীবন কাটাচ্ছি তাতে করে যারা একেবারে
যুদ্ধক্ষেত্র দাঁড়িয়ে লড়াই করছে, সেই সমস্ত ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা-কর্মীদের অবস্থাটা কেমন সহজেই অনুমান করা যায়।
অথচ সেইসব মানুষগুলোই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছেন। আর
আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলছেন, ‘এ-লড়াই আমরা জিতবই।’ এদের মনে কি
ভয় নেই? নিশ্চয়ই আছে।
কিন্তু সেই ভয়কেও ওরা হারিয়ে দিয়েছেন। এদের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ঠ নয়।
অর্পণ
বাচ্চা ছেলে। কিন্তু আমি জানি ও ভয় পায়নি। ও-আমাকে যে
কথাটা বলেছে সেটা একান্ত আপনজনের মতোই বলেছে। কথা বলার সময়
আমার এক ভাই বা বন্ধুর মতো হয়ে নিজের উদ্বেগের কথা আমাকে বলেছে।
কিন্তু প্রকৃত লড়াইয়ের ময়দানে ও আর পাঁচজনের মতোই সাহসী। আর আমার কাছে
ও যে ভয়ের কথা বলেছে আমি জানি আর কিছুদিন পরে ওটাও আর মনের মধ্যে থাকবে না।
কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি পোস্ট করেছে অর্পণ। PPE ঢাকা গোটা শরীর। শুধু চোখ দুটো বাদে
আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। লিখেছে, “Duty hours wearing PPE in this scorching summer is one
of the challenging jobs I faced in my life.” সত্যি একটা
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ওরা। বুঝতে পারি কী কঠিন এই পরিস্থিতি। ডাক্তার-নার্সরা এখন
এইরকম চ্যালেঞ্জিং জীবন কাটাচ্ছেন। করোনা ভাইরাস বিশ্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। উন্নত
দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। আমাদের চিকিৎসক-নার্সেরা আত্মবিশ্বাসমাখা সুরে
বলছেন, করোনাকে আমরা হারাবোই। পুরো চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের
মুখোমুখি। সেই চিকিসা বিজ্ঞানের একটি অংশ অর্পণও। তাকে তো চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে।
শুধু একটা
কথা ভেবে খারাপ লাগে, সদ্য ডাক্তারি পাশ করতে না করতেই জীবনের এক চরম কঠিন পরিস্থতির
মুখোমুখি হতে হয়েছে ওকে। এই কঠিন সময়গুলো ভালোভাবে উতরে যাক ওরা, এই কামনা
করি। শুধু অর্পণ নয় ওদের মতো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যারা পেশাগত
জীবনের শুরুতেই এমন কঠিন পরিস্থির মধ্যে পড়েছে তাদের সকলের জন্য রইল একরাশ
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। ভালোভাবে যেন ওরা এই কঠিন সময়গুলো পার করতে পারে।
তবে
অর্পণের কথাগুলো মনে পড়লে সত্যি সত্যি মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
আর ওর শেষ কথাটা মনে পড়লে বুকের মাঝে অদ্ভুত একটা কষ্ট অনুভব হয়। নিজেকেই অসহায়
লাগে। অর্পণ আমার থেকে খুব ছোটো। দেখা হলে এখনও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
কিন্তু সেদিন ওর কথা শুনে আশীর্বাদ করতে পারিনি। বলেছিলাম, ‘আশীর্বাদ নয়, অনেক অনেক ভালোবাসা আর
শুভেচ্ছা জানাই।’
আমার সেই
মেসেজের কোনো জবাব দেয়নি অর্পণ। হয়তো আমার জবাবে সে ক্ষুন্ন হয়েছে। কিন্তু আমার
স্থির বিশ্বাস একদিন অর্পণ ঠিকই বুঝতে পারবে, ঈশ্বরকে আশীর্বাদ করার ক্ষমতা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই।
১০
এপ্রিল, ২০২০।
No comments:
Post a Comment